দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল। মেলার এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত এত বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হচ্ছিল যে তা বলে বুঝানো অসম্ভব। এক কোটি বর্গফুটেরও বেশি আয়তনের জায়গা জুড়ে থাকা ক্যান্টন ফেয়ারের কয়েক হাজার বুথে সাত রাজ্যের নানা পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছিল। চীনের গুয়াংজুর পৃথিবীখ্যাত এই ক্যান্টন ফেয়ারে বিশাল চীনের নানা অঞ্চলের লাখো কারখানায় উৎপাদিত রকমারি পণ্য ঠাঁই পেয়েছে! চ্যাপ্টা নাকের অসংখ্য সুন্দরী প্রতিটি স্টলে। তরুণের সংখ্যাও কম নয়। তারা পণ্যের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। ক্রেতাদের সাথে কথা বলছেন। অর্ডার নিচ্ছেন। আগেই বলেছি এসব পণ্য খুচরো বিক্রি হয়না, হাজার হাজার পিসের অর্ডার দিতে হয়। স্টলে স্টলে হাজারো পণ্য থরে থরে সাজানো থাকলেও ক্যান্টন ফেয়ারে মূলত কারখানার মালিকেরা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির জন্য অর্ডার নেন। স্থানীয় বাজারের জন্যও তারা হাজার হাজার পিসের অর্ডার নিয়ে থাকেন। এখানে পণ্য পছন্দ করবেন, অর্ডার দেবেন। কারখানায় সেই পণ্য তৈরি করে আপনার শহরে কিংবা বন্দরে পৌঁছে দেবে।
সূচ থেকে গাড়ি কী নেই তাদের! বিশ্বের কারখানা খ্যাত চীনের হাজার হাজার ফ্যাক্টরী যে কত পণ্য উৎপাদন করে! কত ধরণের পণ্যের পসরা যে সাজানো হয়েছে!! আপনি কিনেন বা না কিনেন ইচ্ছেমতো সবকিছু দেখতে পারবেন। যতক্ষন ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে পণ্যগুলো দেখে তারপর অর্ডার দিতে পারবেন। অর্ডার না দিলেও কোন সমস্যা নেই। আপনি দেখে শুনে গল্পটল্প করে চা কফি খেয়ে কেটে পড়েন, কেউ আপনাকে কিচ্ছু বলবে না। মেলার স্টলগুলোতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি এবং কারখানার উৎপাদিত নানা পণ্যের ব্রুসিয়ার বিলি করা হচ্ছিল। সাথে নানা উপহার। কোন স্টলে পেনড্রাইভ, কোন স্টলে ব্যাগ, কোথাও কলম ইত্যাদি। আমি দুই তিনটি পেন ড্রাইভ সংগ্রহ করলাম। কায়সার ভাই এবং জুবায়েরও টুকটাক উপহার নিলেন।
কয়েকটি স্টলে চা কফি দিচ্ছিল। কিন্তু আমরা যেহেতু ক্রেতা নয় তাই কোন স্টলে কিছু খেতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু আমার প্রচণ্ড কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। কথাটি বলতে কায়সার ভাই বললেন, চলেন ফুডকোটে যায়। ওরে বাবা, এত বড় আয়োজন। মনে হয় একই সাথে হাজার দশেক মানুষ খেতে পারবেন। অসংখ্য স্টল। সবগুলোতে প্রদর্শিত হচ্ছে খাবার। আমি একটি কফিশপে গিয়ে তিন কাপ কফি নিলাম। কাপ মানে মগ। ওয়ান টাইম। এসব মগে কফি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাওয়া যায়, গাড়ি চালাতে চালাতে খেলেও সমস্যা হয়না। ক্ষুধা না থাকায় অন্য কোন স্টলের দিকে না গিয়ে আবারো মেলার বিভিন্ন পণ্যের স্টলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। হাতের কফির মগ নিয়ে আয়েশি ভাব নিয়ে হাঁটছিলাম।
হঠাৎই আমার চোখে পড়লো। হঠাৎ মানে একদমই হঠাৎ। মেডিকেল ইকুইপমেন্টের একটি স্টলে কাঁচের শোকেসের ভিতরে একটি স্টোথোস্কোপ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নজর পড়ার সাথে সাথে আমার শরীর মন সবই ঝনঝন করে উঠলো! বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো আমার মেয়েটার জন্য। আমার বড় মেয়ে, মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ে। বেশ কিছুদিন আগে সে পিংক কালারের একটি স্টোথোস্কোপ চেয়েছিল আমার কাছে। কিন্তু আমি কোথাও ওই কালারের কোন স্টোথোস্কোপ খুঁজে পাইনি। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা প্রাচ্য যেখানে যখন যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সেখানেই আমি পিংক কালারের একটি স্টোথোস্কোপ খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। এতে করে তার জীবনে আমার কাছে চেয়ে না পাওয়ার কোন রেকর্ড না থাকলেও একটি স্টোথোস্কোপ দিতে না পারার ব্যর্থতা আমাকে কষ্ট দিত। মনে হতো কলজের টুকরা মেয়েটিকে সামান্য একটি স্টোথোস্কোপ দিতে পারলাম না। পিংক কালারের স্টোথোস্কোপ!
আর গুয়াংজুর ক্যান্টন ফেয়ারে কিনা পিংক কালারের স্টোথোস্কোপ শোকেজে সাজিয়ে রাখা হয়েছে! এটি আমাকে নিতে হবে, নিতেই হবে। দুনিয়া উল্টে গেলেও এটা না নিয়ে মেলা ত্যাগ করতে পারবো না আমি। মেয়ের হাতে এটি তুলে দিয়ে বহুদিনের ব্যর্থতার কলংকমুক্ত হবো! কায়সার ভাইকে বললাম, ওটি নিতে হবে। কায়সার ভাই হাসলেন, বললেন, কমপক্ষে ২০ হাজার পিস অর্ডার দিতে হবে। এখানে সিঙ্গেল একটি বিক্রির কোন সিস্টেম নেই, নজিরও আছে বলে মনে হয়না। আমি শুধু বললাম, আমাকে নিতেই হবে।
অনেকদিন ধরে খুঁজে বেড়ানো পিংক কালারের স্টোথোস্কোপ দেখে আমার মন বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠে। আমি হেলেদুলে স্টলটিতে প্রবেশ করলাম। সাথে কায়সার ভাই এবং জুবায়ের। একই সাথে তিন কাস্টমার ঢুকতে দেখে নড়চড়ে উঠলেন স্টলের দুই কর্মী। একজন তরুণ,অপরজন তরুণী, চীনা। স্টলে কোন কাস্টমার ছিল না। তারা বেশ খোশগল্পে মেতে ছিল। আমি মেয়েটির চোখে চোখ রাখলাম। বেশ মোলায়েম করে বললাম, একটি রিকুয়েস্ট করতে চাই। চীনে ইংরেজি ভাষার দুরবস্থা কানে সয়না। ইংরেজির কোন ধারই তারা ধারে না। শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করে, অথচ একটি শব্দ ইংরেজি জানে না, বলেও না। খুব প্রয়োজন হলে দোভাষী দিয়ে কাজ সারেন। নাহয় ম্যান্ডারিন ভাষাতেই চলে ব্যবসা। আপনি ম্যান্ডারিং জানেন না? সেটা আপনার সমস্যা। চীনের অধিকাংশ ব্যবসায়ীর মানসিকতা হচ্ছে-ম্যান্ডারিন শিখে আসুন, ব্যবসা করুন।
যাক, আমি যে তরুণীর কাছে বিগলিত হয়ে রিকুয়েস্ট আছে বললাম, তিনি ইংরেজি বুঝেন। পাল্টা উত্তর শুনে বুঝতে পারলাম যে, তিনি ইংরেজি বলতেও পারেন। তরুণী বিগলিত হলেন। কিছুটা ঝুঁকে গেলেন আমার দিকে। হাত দুইটি সুন্দরভাবে জোড় করে আমার অনুরোধটি কি সেটা শুনতে চাইলেন। তার বিনীত হওয়ার নিয়মটি আমি অনুসরণ করলাম। বললাম, এই স্টেথোস্কোপটি আমি চাই। তরুণী আমার দিকে বেশ নরম করে তাকালেন। তার ধারণা আমি বড় অর্ডার দেয়ার কথা বলছি। তিনি যা বললেন, তার অর্থ হচ্ছে এটার জন্য অনুরোধের কী আছে! আমরাতো এগুলো বিক্রি করতেই মেলাতে এসেছি। তুমি কোনদেশ থেকে এসেছো, কত পিস অর্ডার করতে চাও? আমাদের এই প্রোডাক্ট কিন্তু খুবই ভালো। এবার আমি হাসলাম। একই ঢঙ্গে বিনয়ী হলাম। বললাম, সমস্যাতো সেটাই। আমি শুধু এটি নিতে চাই, এই এক পিসই। তিনি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। মানে আমার কথা যেন তিনি বুঝতে বা বিশ্বাস করতে পারছেন না। যতটুকু সম্ভব সহজ এবং ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে আমার বড় মেয়ের কথা তাকে শুনালাম। শুনালাম পিংক কালারের একটি স্টেথোস্কোপের জন্য আমার মেয়ের বহুদিনের আগ্রহের কথাও।
তরুণী এমন আচমকা প্রস্তাব শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এমন দুর্বল কাস্টমার পুরো ক্যান্টন ফেয়ারে আর দ্বিতীয়টি যে নেই সেই সম্পর্কে তিনি যেমন নিশ্চিত তেমনি আমিও। কিন্তু আমার তো মেয়ের চাওয়া। যে মেয়ের জীবনে চাওয়ার পরিমাণ এত কম যে হাতের আঙ্গুলে গুনে শেষ করা যায়। আবার এটাও ঠিক যে, এই মেয়ের জীবনের কোনো চাওয়া আমি কোনোদিনই অপূর্ণ রাখিনি। আমার সেই সোনার মেয়েটার একটিমাত্র স্টেথোস্কোপ কিনে দিতে না পারার ব্যর্থতা আমাকে বিভিন্ন সময় কষ্ট দিতো। এমন কষ্ট নিয়ে মেলায় আর কোনো মানুষ ঘুরঘুর করছে কিনা আমার জানা নেই।
তরুণী আমাকে কিছু না বলে এবার তার সহকর্মী পুরুষটির দিকে তাকালেন। কিচির-মিচির করে কি কি সব বললেন। পাল্টা কি কি যেনো বললো তরুণটিও। আমাদের কায়সার ভাই এবং জুবায়ের বহুদিন ধরে চীনে থাকেন। তারা দুজনেরই বেশ রপ্ত চীনা ভাষা। আমার পক্ষ থেকে কায়সার ভাই এবং জুবায়ের তাদের অনুরোধ করলো।
তরুণী এবার আমার দিকে তাকালেন। সরাসরি তাকিয়ে বললেন, আমরা এভাবে বিক্রি করিনা। তবে তুমি যখন তোমার মেয়ের কথা বলছো তাই আমরা এটা তোমাকে দেবো। আমাদের মেলাও আজ শেষ হবে, আমরা চলে যাবো। তাই এটি তোমাকে দিয়ে দিলে আমাদের তেমন অসুবিধা হবে না। তবে তোমাকে এটা পেতে হলে দুইটি শর্ত পূরণ করতে হবে। তার একটি হচ্ছে ডলারে পেমেন্ট দিতে হবে এবং অপরটি হচ্ছে একশ’ ডলার দিতে হবে। এক সেকেন্ড চিন্তা না করে আমি ‘রাজি’ বলে ফেললাম। কায়সার ভাই বললো, বাইরের মার্কেটে এটার দাম ৩০/৪০ ডলারের বেশি হবে না। এত দাম দিয়ে কেনার কি দরকার? আমি কায়সার ভাইকে বাংলায় বললাম, একশ’ ডলার কেনো, এক হাজার ডলার চাইলেও এটা আমি রেখে মেলা থেকে যেতাম না। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতার বুকের প্রদীপ জ্বলুক আমাদের সকল শিশুর অন্তরে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ