দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমরা যখন পার্ল নদীর জেটিতে পৌঁছলাম তখন সেখানে অনেক লোক। সুসজ্জিত সব নারী পুরুষ। বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তবে অধিকাংশই তরুণ তরুণী। তারা দল বেধে কিংবা জোড়ায় জোড়ায় বেড়াতে বের হয়েছে। ঘাটজুড়ে উৎসবের আবহ। বেড়ানোর মজা শুরু হয়ে গেছে। জেটিতে নোঙর করা কয়েকটি জাহাজ। একটির পাশে অপরটি লাগিয়ে রাখা হয়েছে, তারপাশে অন্যটি। সবগুলো জাহাজই যাত্রীবাহী, ক্রজিং ভ্যাসেল। জাহাজগুলোর ভিতরে বসার চমৎকার ব্যবস্থা, ডেকের উপরও বসার দারুণ আয়োজন। আমরা জাহাজে না চড়েও জেটি থেকে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। এসব জাহাজে কেউ ইচ্ছে করলে ভিতরে বসে নিজের মতো করে নৌভ্রমণ করতে পারেন, আবার চাইলে ছাদেও বসতে পারেন। অবশ্য টিকেরে মূল্যে কোন হেরফের আছে কিনা জানি না।

জাহাজটি নানাভাবে সাজানো। প্রচুর রঙিন বেলুন এবং লাইট লাগানো হয়েছে হেথায় হোথায়। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি লাইট জ্বলছে, আলোর বন্যা চারদিকে। উজ্জ্বলতায় ভরে আছে জাহাজটির সবকিছু, জেটিও।

চীনের গুয়াংজুর পার্ল রিভারে ক্রুজ করার জন্য এসেছি আমরা। আমার সাথে রয়েছেন ইউছুপ আলী ভাইর অফিসের কর্মকর্তা কায়সার ভাই এবং জুবায়ের। আমরা তিনজন জেটির একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। চারদিকে দেখছি। উৎসব যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। মানুষ যে কী আনন্দে আছে!

সিঁড়ির গোড়ায় দুইজন লোক দাঁড়িয়ে হ্যান্ডমাইকে কি কি যেন বললেন। আর ঘাটে অপেক্ষমান লোকজন নড়েচড়ে উঠলেন। বিমানের বোর্ডিং এর মতো জাহাজেরও বোর্ডিং শুরু হলো। টিকেট দেখে দেখে লোকজনকে জাহাজে উঠানো হচ্ছিল। ঘাটে উপস্থিত মানুষগুলোর অনেকেই সিঁড়ির গোড়ার দুজনকে সামনে রেখে লাইন ধরে গেছেন। আমরাও লাইন ধরবো কিনা জানতে চাইলাম। কায়সার ভাই বললেন, এরা পাশের জাহাজের যাত্রী। আগে ওদের বোর্ডিং হবে। এরা শেষে হলে মনে হয় আমাদের জাহাজের লোক উঠাবে। আমরা অপেক্ষা করছিলাম। জেটিতে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে অপেক্ষা। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। জমে উঠতে শুরু করেছে রাত। আর একই সাথে বাড়ছে উজ্জ্বলতা। চারদিকে এত বেশি আলো ঠিকরে পড়ছে যে, একটি সূচ পড়ে গেলে তাও খুঁজে নেয়া যাবে।

আমাদের ডাক পড়লো। কায়সার ভাই এবং জোবায়েরসহ এগিয়ে গেলাম। টিকেট দেখালাম। টিকের একটি অংশ ছিঁড়ে তারা রেখে দিলেন। ভিতরে একটু চোখ বুলিয়ে আমরা সরাসরি জাহাজের ছাদে উঠে গেলাম। ছাদেও বসার চমৎকার ব্যবস্থা। চেয়ার টেবিল। চেয়ারগুলো জাহাজের ছাদের সাথে স্ক্রু দিয়ে সাঁটা। ইচ্ছে করলেও চেয়ার টানাটানি করে নিজের মতো করে বসার সুযোগ নেই। যেখানে যেভাবে চেয়ার রাখা, সেখানেই বসতে হচ্ছে। একটি টেবিলের দু’দিকে ছয়টি করে চেয়ার। দুইটি টেবিল পাশাপাশি লাগানো। অর্থাৎ দু’পাশে বারোজন মানুষের বসার ব্যবস্থা। এরপর রো, হাঁটার পথ। রো’র পরে আবারো টেবিল পাতা হয়েছে। তবে কিনারার টেবিলগুলো সিঙ্গেল। সেখানে দুই পাশে ছয় জনের বসার ব্যবস্থা। চেয়ারগুলোতে সিট নম্বর দেয়া আছে। টিকেটের নম্বর অনুযায়ী বসতে হচ্ছে। জাহাজের লোকজনই সিনেমা হলের টিকেট চেকারের মতো সিট প্ল্যান দেখে যাত্রীদের সিট দেখিয়ে দিচ্ছে। আমাদেরকেও সিট দেখিয়ে দেয়া হলো। তিনজনের সিটই পাশাপাশি।

ডেকের মাঝখানে একটি স্টেজ, ছোটখাটো। সেখানে সাউন্ড সিস্টেমের ডাউশ সাইজের স্পিকার বসানো। প্রচুর লাইট স্টেজে। তবে তখনো কোন অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। কায়সার ভাই বললেন, এখানে নৃত্য, গান, যাদুসহ নানা ধরণের পারফরমেন্স হবে। অপর পাশে ব্যুফে ডিনারের ব্যবস্থা। অবশ্য তখনো খাবার সার্ভ করা হচ্ছে না। জাহাজ চলতে শুরু করার পর শিল্পীদের পারফরমেন্স শুরু হবে।

জাহাজ কখন চলবে? স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নটি করে ফেললাম। কায়সার ভাই জানালেন যে, ঠিক ৭টায় জাহাজ যাত্রা করবে। এক মিনিটও এদিকওদিক হবে না। জাহাজের টিকেটে যা লেখা থাকে তার থেকে একমিনিটও নড়ছড় হয় না। সময়ের ব্যাপারে এরা খুবই সচেতন।

একটু পরেই কথাটির সত্যতা পাওয়া গেল। ঘড়ির কাঁটা ঠিক সাতটা বাজতেই জাহাজের হুইসেল এবং নড়াছড়া টের পাওয়া গেল। ঠিক যেন সাতটার ট্রেন সাতটায় ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। এত নিখুঁতভাবে সময়ের অনুসরণ! ভালো লাগলো। জাহাজটি ঘুরতে শুরু করেছে। কোনদিক থেকে কোনদিকে যাবে কে জানে! অবশ্য তা নিয়ে আমার বা যাত্রীদের কোন মাথাব্যথাও ছিল না। জাহাজটি পার্ল নদীতে ঘুরবে। ঘুরে টুরে আবার এখানে এনে নামিয়ে দেবে। এতে করে জাহাজটি কোনদিক থেকে কোনদিকে যাবে তা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। জাহাজটি জেটি থেকে একটু এগিয়ে নদীর মাঝামাঝিতে চলে আসলো।

পার্ল রিভার চীনের বেশ বড় একটি নদী। এই নদীর অপর নাম ক্যান্টন রিভার। এছাড়া জু জিয়াং , চু কিয়াংসহ বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে পার্ল রিভারের। পাহাড়ে জন্ম নিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরের সাথে মিশে যাওয়া নদীটির দৈর্ঘ প্রায় ২৪শ’ কিলোমিটার। এটির বিভিন্ন অংশের প্রশস্ততা বিভিন্ন ধরনের। তবে আমরা যেখানে ক্রজিং করছি শহরের ভিতরে নদীর দৈর্ঘ্য ৫শ’ মিটারের কম। আমাদের কর্ণফুলী নদীর চেয়ে কম চওড়া। জাহাজ থেকে দুই পাশের সুউচ্চ সব ভবন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। নদীটির গভীরতা কেমন বুঝতে পারছিলাম না। তবে অনেকগুলো ক্রজিং ভ্যাসেল বেশ অবলীলায় গা ভাসিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।

আমাদের জাহাজের স্টেজে আলো বাড়লো। সাউন্ডবঙে টুং টাং করে গিটারের শব্দ জেগে উঠলো। সাথে ড্রামের আওয়াজ। অতপর এক তরুণী এসে অনেকক্ষণ ধরে চিৎকার করলেন। তিনি যতই না কণ্ঠ সাজালেন, তার থেকে ঢের বেশি নাচালেন শরীর। কাপড় ছোপড়ের খুব বেশি বালাই না থাকা শিল্পী বেশ নেচে এবং নাচিয়ে বিদায় নিলেন।

আমাদের জাহাজ চলছিল। ব্যুফে খাবার সার্ভ হয়েছে। স্টার্টার হিসেবে নানাধরনের ভাজাভুজি টাইপের খাবার। খাবারগুলোর নাম টাম জানি না, জানার দরকারও মনে করলাম না। কায়সার ভাই, জোবায়ের যে ডিস থেকে খাবার নিচ্ছিলেন আমিও সেখান থেকে তুলে নিলাম। পাপড়, পাকোড়া, পেঁয়াজু টাইপের স্টার্টার। সাথে স্যুপ।

স্টেজে নৃত্য চলছে। বলিহারি কারবার। প্রচুর লাফালাফি। বেলি ড্যান্সের মতো ব্যাপার স্যাপার। একজোড়া তরুণ তরুণী কি কি সব সুরের তালে বেশ জমিয়ে তুললেন। স্থানীয় তরুণ তরুণীদের অনেককেই বেশ মাতোয়ারা হতে দেখা গেল। জাহাজের ডেকে উদোম নৃত্য। নদীতে ভেসে বেড়ানো অন্য জাহাজগুলোতেও একইভাবে জমকালো আয়োজন চলছে। চড়া শব্দে চলছে গান বাজনা। কোন কোন জাহাজ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।

অনেকক্ষণ ধরে গান বাজনা এবং নৃত্যের পর শুরু হলো যাদু প্রদর্শনী। বেশ উঁচুমাত্রার একটি প্রদর্শনী দেখলাম। অতি আশ্চর্য করে দেয়া চমৎকার কয়েকটি আইটেম মুগ্ধ করলো আমাদের। সদুর্শনা এক তরুণীকে শূণ্যে ভাসিয়ে রাখা, টেবিল শুইয়ে রেখে পেটের মাঝখান দিয়ে কেটে ফেলা, গায়েব করে দেয়ার মতো যাদু। বেশ উচ্ছ্বসিত দর্শক, উচ্ছ্বসিত যাদুকর। তিনি ক্রমাগত লাফিয়ে লাফিয়ে কি কি সব বলছিলেন, দর্শকেরা হাততালী দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। কিছু না বুঝে হাততালী দিচ্ছিলাম আমিও।

ডিনার শুরু হয়েছে। নানা ধরনের ব্যুফে খাবার। যত খুশী নেয়া যায়, খাওয়া যায়। কিন্তু না চেনার কারনে অনেককিছু দেখে শুনে খেতে হচ্ছিল। কায়সার ভাই এবং জোবায়েরের পাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খাবার নিচ্ছিলাম আমি। ব্যুফে ডিনারের পাশাপাশি প্রচুর মদ বিয়ারও মিলছিল। তবে মদ বিয়ারের জন্য আলাদা পেমেন্ট করতে দেখলাম। টিকেটের সাথে ডিনার ফ্রি, নাচ গান ফ্রি। তবে মদ বিয়ারের ফ্রি নয়। চীনারা টাকার পরোয়া কেমন করে জানি না। তবে গত কয়েকদিনে তাদের প্রচুর মদ বিয়ার খেতে দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে পানীয়ের প্রতি প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে তাদের। সারাদিন গ্রিন টি খাওয়া, গরম পানি খাওয়া মানুষগুলোও সন্ধ্যা কিংবা রাতে প্রচুর বিয়ার খান, মদ খান। নিজেদের তৈরি নানা ব্র্যান্ডের মদ ও বিয়ার রয়েছে তাদের।

মদ কিংবা বিয়ার নিয়ে আমাদের তিনজনের কারো আগ্রহ নেই। আমার খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। কায়সার ভাইকে কথাটি বলতে তিনি কোত্থেকে যেন একটি কফির ব্যবস্থা করে ফেললেন। ওয়ান টাইম কাপে কফি। স্বাদ মোটামুটি।

জাহাজ চলছে। সামনের দিকে এগুচ্ছে। নদীর দুইপাশে চমৎকার সব ভবন। বড় বড় ভবনের পাশাপাশি ছোটখাটো বাড়িঘরও রয়েছে। রয়েছে শিশুপার্কের মতো স্থাপনাও। খেলাধুলা কিংবা গল্পগুজব করার জায়গা। নদীর পাড়ে রেস্তোরা, বার, নাইট ক্লাবের আলোর ঝলকানি চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। তবে একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম যে, নদীর পাড়ের বড় বড় ভবনগুলোর গায়ে টিভির পর্দার মতো বিজ্ঞাপন চলছিল। কয়েকটি ভবন নিয়ে একটি পর্দা। বুঝতে পারছিলাম যে, প্রজেক্টের কাজ। কিন্তু কোথায় প্রজেক্টর বসিয়ে কোথা থেকে এমন আলোর খেলা চলছে তা বুঝতে পারছিলাম না। নদীর পাড়ের পুরো শহর যেন টিভির পর্দা। এক একটি পর্দা থেকে কী পরিমান আলো যে ঠিকরে পড়ছিল তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সত্যি, বিষয়টি দেখার, লেখার নয়। লিখে বুঝানো সম্ভবও নয়। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাটগাঁর কইলজা আঁরার আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধঅবৈধভাবে দখলে থাকা জমি উদ্ধারে রেলওয়েকে মনোযাগী হতে হবে