দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ আগস্ট, ২০২২ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চমৎকার একটি শপিং মল। মলটির অবস্থান গুয়াংজু শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। অফিস থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমরা মলটিতে এসে ঢুকেছি। বিশাল মল। অসংখ্য দোকান মলটির প্রথম তলা থেকে শুরু করে সবগুলো ফ্লোরে। লিফটের পাশাপাশি স্কেলেটরেও উঠানামা চলছে। দোকানে এবং শোরুম থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। মোলায়েম আলোর বন্যা শোরুমের কেসে কেসে। চাঁদের আলোর মতো মোলায়েম আলো পণ্যগুলোর চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। কত ধরণের পণ্যের পসরা যে সাজানো রয়েছে! কাপড়ছোপড় থেকে শুরু করে থালা বাসন পর্যন্ত! প্রচুর মানুষ কেনাকাটা করছেন। নারী পুরুষ, অধিকাংশই তরুণী। চীনে নারীর সংখ্যা বেশি। তবে অধিকাংশ সংসারেই নারীই কর্তা। সিদ্ধান্তও নেন নারী। বাজার সদাই থেকে কেনাকাটার সবকিছুই নারীর নিয়ন্ত্রণে। সংসারে পুরুষের ভূমিকা বেশ গৌণ, যার প্রভাব দেখা যায় রাস্তাঘাটে, রেস্তোরায়, মলে।
আমাদের কেনাকাটার কিছু নেই, শুধু শুধু হাঁটছি। এদিক ওদিক ঘুরেফিরে নানা কিছু দেখছি! অলস সময় কাটানো কিংবা মানুষ দেখা ছাড়া আমাদের তেমন কিছু করার ছিল না। দেখার জন্য দেখা বলতে যা বুঝাই ঠিক তাই করছি আমরা। চারদিকে রকমারি পণ্যের পসরা এবং কিলবিল করা নারী পুরুষ দেখে দেখে সামনে এগুচ্ছিলাম। এত পণ্য, এত রকমারি জিনিস! সবই চীনে উৎপাদিত! হেন কোন পণ্য নেই যা বিশ্বের কারখানাখ্যাত চীনে তৈরি হয় না। গুয়াংজুর শপিং মলে পণ্যের পসরার বহর দেখে চীনের সাথে বিশ্বের বৈশ্বিকবাণিজ্য কেমন তা বেশ জানতে ইচ্ছে করছিল। চীন পৃথিবীর কাছে কত কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে এবং কত কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে কে জানে! চীনের কী বাণিজ্য ঘাটতি আছে নাকি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত! চীন বছরে কত কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করে জানতে চাইলাম ইউছুপ আলী ভাইর কাছে। তিনি বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা। হেন কোন পণ্য নেই যা চীন রপ্তানি করে না। শিশুদের খেলনা থেকে কবরের কফিন পর্যন্ত সবই চীনের কারখানায় তৈরি হয়। ইউছুপ ভাই বললেন, রান্নাঘরের চুলা থেকে গাড়ি পর্যন্ত কোন কিছুই বাদ নেই। চীনের গার্মেন্টস এবং ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের যে বাজার তার তুলনা পৃথিবীতে নেই বলে মন্তব্য করলেন তিনি। ইউছুপ আলী ভাই বললেন, পৃথিবীর আর কোন দেশেরই বৈশ্বিক বাণিজ্যে এত সমৃদ্ধ অংশীদারিত্ব নেই। তিনি বললেন, চীন বছরে প্রায় সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন সমান এক লাখ কোটি) ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। একই সময়ে চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জ্বালানি, ক্যামিকেল এবং কাঁচামালসহ ২ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এতে করে বিশাল এক বাণিজ্য উদ্বৃত্তের দেশ চীন। বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্য উদ্বৃত্তের দেশ হিসেবে চীন পৃথিবীর সেরা অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।
হাঁটছিলাম আমরা। গল্পে গল্পে সময় পার করছিলাম। ভিতরে ভিতরে খুবই অসহায় লাগছিল। চীন পারলে আমরা পারি না কেন? তাদের এত কিছু থাকলে আমাদেরও কিছু কিছু থাকে না কেন! চীন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, আমরা বিলিয়নও পারি না কেন। বাংলাদেশ মাত্র ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির টার্গেট অর্জন করতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ…।
বেশ জমকালো একটি দোকানে ঢুকলেন ইউছুপ আলী ভাই। দোকানটি ভর্তি নানা গৃহসামগ্রিতে। বিছানার ছাদর থেকে রান্নাঘরের বটি পর্যন্ত সবই রয়েছে। রয়েছে ছুরি কাঁচিসহ নানা কিছু। ইলেক্ট্রিক কেটলি, হিটার, থালা বাসন — হায় হায় কী নেই দোকানটিতে! একই ছাদের নিচে সংসারের সবকিছু! আমি কয়েকটি জিনিস হাতে নিয়ে নড়াছড়া করছিলাম। কিনতে পারলে ভালো হতো! বেশ চকচক করছে কাঁটা-চামুচের একটি সেট। টেবিল ডেকোরেশনের নানা পণ্য এত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে, যেন বর খাওয়ানোর আয়োজন!
খেয়াল করে দেখলাম যে, চামুচগুলো খুবই মজবুত, সুন্দর এবং মান খুবই ভালো। চীনা মালের মতো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে জাপান কিংবা জার্মানীর কারখানায় উৎপাদিত চামুচ চীন আমদানি করে সাজিয়ে রেখেছে। ইউছুপ আলীর ভাইর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, দেখেন, জাপানের কাঁটা চামুচ বিক্রি করছে এখানে। দরদাম করে দেখেন তো, দুই সেট নিয়ে নিই। ইউছুপ আলী ভাই বললেন, জাপানের হবে কেন? এগুলো চীনেরই প্রোডাক্ট! ওরা পারতপক্ষে জাপান তাইওয়ান কিংবা কোরিয়ার প্রোডাক্ট বিক্রি করে না! আমি কিছুটা হোঁচড় খেলাম। এত সুন্দর চামুচ, এত মজবুত! ইউছুপ ভাই হাতে নিয়ে বললেন, এগুলো চীনের প্রোডাক্ট। ‘চীনের এত ভালো প্রোডাক্ট!’ আমি স্বগোক্তি করলাম।
আমার কথাটি লুপে নিয়ে ইউছুপ আলী ভাই বললেন, কী বলেন, চীনের প্রোডাক্ট খারাপ নাকি? আমি বললাম, চীনের প্রোডাক্ট তো অবশ্যই খারাপ, নিম্নমান। কোনরকমে বানিয়ে ফেলে।
ইউছুপ আলী ভাই হাসলেন। বললেন, ভুল বললেন। চীনের প্রোডাক্ট অনেক ভালো। পৃথিবীর বহুদেশ থেকেই চীনের প্রোডাক্ট ভালো। এদের বহু প্রোডাক্ট জাপানের চেয়েও ভালো! আমি অবিশ্বাসী চোখে ইউছুপ ভাইর দিকে তাকালাম। চীনা মাল জাপানের চেয়ে ভালো! আমার চোখের ভাষা যেন তিনি পড়ে ফেললেন। বললেন, চীনকে তো বিশ্বের কারখানা বলা হয়। পুরো পৃথিবী এখান থেকে প্রোডাক্ট নেয়। কত ধরনের প্রোডাক্ট যে চীনের রয়েছে তা হিসেব করা কঠিন। আমি চীনের নিম্নমানের নানা পণ্যের উদাহারণ দিতে ইউছুপ আলী ভাই বললেন, চীনা পণ্য মানেই নিম্নমানের নয়। চীন অত্যন্ত মানসম্পন্ন পণ্যও তৈরি করে। একই পণ্য কয়েক স্ট্যান্ডার্ডে উৎপাদন করে। উন্নতমানের পণ্যগুলো পৃথিবীর যে কোন দেশের পণ্যকে খুব সহজেই বিট করতে পারে। বিশেষ করে চীন যে সব পণ্য ইউরোপ আমেরিকায় পাঠায় সেগুলোর মান পৃথিবীর সেরাদের চেয়ে সেরা। ইউছুপ আলী ভাই বললেন, অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্যও চীন অনেক ভালো প্রোডাক্ট তৈরি করে। একটি পণ্য এক লাখ টাকা খরচ করেও বানাতে পারে, আবার এক হাজার টাকায়ও হুবহু ওই পণ্যটি বানিয়ে দিতে পারে। এতে পণ্যের বাহ্যিক আবরণে খুব একটা পরিবর্তন আসে না, শুধু মানের হেরফের হয়। এখন আপনি এসে যেভাবে অর্ডার করেন ঠিক সেভাবে পণ্যটি বানিয়ে দেয়া হয়। একটি পণ্য এক লাখ টাকায় যেমন চীন বানাতে পারে, তেমনি ৫ হাজার টাকায়ও পারে। চয়েস আপনার!
বিষয়টি বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম যে, আমাদের দেশে চীনা পণ্যের আমদানিকারকেরা নিজেদের মতো করে অর্ডার দিয়ে কাস্টোমাইজ করে পণ্য তৈরি করিয়ে নেন। যাতে স্বল্পদামে অধিক মুনাফা করা যায়। আর নিম্নমানের এসব পণ্যই চীনের প্রোডাক্ট সম্পর্কে আমার কিংবা আমার মতো অনেকের মাঝে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করেছে।
ইউছুপ আলী ভাই ম্যান্ডারিন ভাষায় কী কী সব বলে আমার জন্য চামুচের সেটটি নিয়ে নিলেন।
ঘুরছিলাম আমরা। আর কিছু কিনবো কিনা জানতে চাইলেন আমার বন্ধু। এখন আর কেনাকাটা করবো না বলে জানালাম। বললাম, কোথায় থেকে কোথায় যায় ঠিক নেই। ফেরার সময় একদিন টুকিটাকি কেনাকাটা করে নেবো।
ঘুরতে ঘুরতে ফুডকোটে পৌঁছলাম আমরা। ক্ষুধা লেগেছে কিনা জানতে চাইলেন ইউছুপ ভাই। বললেন, চলেন, কিছু খাই। একেবারে স্বল্পহারী ইউছুপ ভাই শুধু আমাকে কিছু খাওয়ানোর জন্য যে এখন ফুডকোটে বসতে চাচ্ছেন তা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। নাহয় ঘর থেকে ভরপেট নাস্তা করে আসার পর এত তাড়াতাড়ি তিনি কিছু খাওয়ার কথা বলতেন না। আমি কফি খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলাম।
ফুডকোট বিশাল। বিশাল মানেই বিশাল। যেন এক চোখের পথ। এদিক থেকে ওদিক দেখা যাচ্ছিল না। প্রচুর লোক সেখানে টেবিলে বসে আসেন, খাওয়া দাওয়া করছেন। এখানের ফুডকোটও ইউরোপ আমেরিকার মতোই। একটি খোলামেলা চত্বরের চারদিকে ছোট ছোট দোকান। অসংখ্য দোকান। প্রতিটি দোকানই নানাধরনের খাবার বিক্রি করছে। মাঝখানের পুরো চত্বরজুড়ে টেবিল চেয়ার পাতা। সেখানে যার যেখানে ইচ্ছে বসে খাবার খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ বসার জন্য নির্ধারিত বিস্তৃত জায়গাটি কোন একক দোকানের নয়, এই জায়গা সব দোকানের। সব দোকানের কাস্টমারই এখানে সমান অধিকার নিয়ে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন। সব চেয়ারে সব দোকানের অধিকার রয়েছে। সব টেবিলেই পাত পাতার সুযোগ রয়েছে সবার। আমরা দুই কাপ কফি নিয়ে চেয়ারে হেলান দিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংসদ নির্বাচনে সর্বাধিক ১৫০ আসনে ইভিএম
পরবর্তী নিবন্ধ৬ ঘণ্টা মহাসড়ক অচল, সীমাহীন দুর্ভোগ