দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৩ জুন, ২০২১ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পাঁচ তারকা হোটেলের রেস্টুরেন্ট। বেশ শানদার। এমন হোটেলগুলোর রেস্টুরেন্টে বরাবরই আলীশান একটি ভাব থাকে। এই হোটেলেও আছে। আলো আঁধারির চমৎকার এক আবহ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল রেস্টুরেন্টের অগুনতি চেয়ার টেবিলের বেশির ভাগই মানুষের দখলে। কোন টেবিলে দুজন, কোন টেবিলে চারজন আবার একাধিক টেবিল জোড়া দিয়েও মানুষের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকলেই খাচ্ছেন, গল্প করছেন। কোন কোন টেবিলে কৃত্রিম মোমবাতি। খাবারের প্লেটের পাশাপাশি কোন কোন টেবিলে মদের বোতল, বিয়ারের ক্যান। ভারতে মদ বিয়ার নিষিদ্ধ নয়, যখন তখন খাওয়া যায়, কেনা যায়। পাঁচতারকা হোটেলে তো মদ বিয়ারের বান ডাকে। শুধু হোটেলে বসবাসকারীরাই নন, বাইর থেকেও বহু লোকও আড্ডা মারতে, গল্প করে করে খাওয়ার জন্য এমন শানদার হোটেলগুলোতে আসেন, সময় কাটান। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার মনে হয় এমন হোটেলেই জমে।
আমি রুম থেকে বের হওয়ার আগ দিয়ে রেস্টুরেন্টে ফোন করে এগারজনের জন্য টেবিল বুকড করেছিলাম। দারুণ মিষ্টি কণ্ঠের এক তরুণী আমাকে উইন্ডোসাইটে সিট রাখছেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। এই নিশুতি রাতে উইন্ডো বা ভিতরের সিটের ব্যবধান কোথায়! তাই সিট নিয়ে মাথা ঘামালাম না। উনার যেখানে ইচ্ছে রাখতে বললাম। মজা করে বললাম, ক্ষুধা লেগেছে। সিট নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, খাবারটি যেন ঠিকঠাকভাবে পাই। তরুণী বেশ মন ছোঁয়া হাসিতে আমাকে খাবার পাওয়ার ব্যাপারেও আশ্বস্ত করেছিলেন। আমি রেস্টুরেন্টে ঢুকেই এদিক ওদিক তাকালাম, মনে মনে খুঁজলাম ওই তরুণীকে। যদি তিনি তরুণী ছুটে আসেন! কিন্তু না, হোটেলের সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত এক যুবক আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা কতজন জানতে চাইলেন। এগারজন বলার সাথে সাথে যুবক বললেন, হুম, আপনারাতো সিট বুকড করেছিলেন! মাথা নাড়তেই যুবক আমি এবং আমার স্ত্রীকে নির্দিষ্ট টেবিলে নিয়ে গেলেন। দুইটি টেবিল জোড়া দিয়ে আমাদের এগারজনের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আপাতত দৃষ্টিতে আমার কাছে পরিবেশটি কেমন যেন গিজগিজে মনে হলো। গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসতে হবে। কথাটি বলতেই যুবক তার অপর এক সতীর্থকে ডেকে আরো একটি টেবিল জোড়া দিয়ে দিলেন। বেশ খোলামেলা হয়ে গেল। বিশাল কাঁচের পাশে আমাদের বসার ব্যবস্থা। রেস্টুরেন্ট থেকেই বাইরের রাস্তা এবং সুউচ্চ সব ভবন দেখা যাচ্ছিল। রাস্তা দিয়ে ছুটছিল শত শত গাড়ি। ভবনগুলোতে আলো জ্বলছিল। দারুণ এক পরিবেশ আশপাশে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, উইন্ডোসাইটের সিটের আলাদা গুরুত্ব আছে!
আমাদের দলের সকলেই এখনো এসে পৌঁছাননি। তাই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। লায়ন মনজুর আলম মনজু ভাই রাশু ভাবী এবং ছোট কন্যা মানারাকে নিয়ে এসে টেবিলে বসলেন। সারাদিন কেমন কাটালাম খবর নিলেন। আমি জীবনের সেরা কিছু সময় কাটানোর কথা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললাম। বললাম, সম্রাট আকবর কিংবা সম্রাট শাহজাহানের সাতকাহন। কিভাবে সম্রাট আকবর যোধা বাঈকে নিয়ে সময় কাটাতেন, তানসেনের সেতার শুনাতেন, শীষ মহলে কিভাবে জীবনের মর্মবাণী পাল্টে যেতো তার সবই বর্ণনা করলাম। নানাভাবে নানা কাহিনী শুনালাম। রাশু ভাবী বেশ মজা করে আমাদের গল্প শুনছিলেন। আমার স্ত্রীও নানাকিছু জানাচ্ছিল। কোন পয়েন্ট আমি ছেড়ে গেলে সেটা সে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। মনজু ভাই রাশু ভাবী এবং ছোট্ট মানারাকে নিয়ে আমরা যখন বেশ জমিয়ে তুলছিলাম তখনি এসে যোগ দিলেন লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং সুপ্রভা বৌদি। যোগ দিলেন লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা। লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া ‘ বদ্দা’ কই বলে আমার এডিটর স্যারের খবর নিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এবং লায়ন কামরুন মালেক এসে যোগ দিলেন।
ইতোমধ্যে দুবার আমাদের কাছ থেকে ঘুরে গেছেন হোটেলের সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরিহিত যুবক। আমরা কি অর্ডার করবো নাকি ব্যুফে নেবো জানতে চাচ্ছিলেন তিনি। আমার এডিটর স্যারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সকলে। স্যার আসার পর বিষয়টি নিয়ে কথা বলার পর ব্যুফে খাবারের কথাই বলা হলো। পাঁচতারকা হোটেলের ব্যুফে মানে একটি আলীশান ব্যাপার। খাওয়া দাওয়ার জমজমাট আয়োজন চারদিকে। থরে থরে সাজানো নানা দেশের নানা খাবার। ভারতীয় সব খাবারের পাশাপাশি পশ্চিমা এবং চাইনীজ খাবারের জমজমাট সব আয়োজন। আমরা স্যুপ দিয়ে শুরু করলাম। অতপর যে যার মতো করে প্লেটে খাবার নিলাম। চারদিকে খাবার আর খাবার। কেউ খাচ্ছেন, কেউবা প্লেটে নষ্ট করেছেন। উচ্ছিষ্ট খাবার তুলে নিয়ে ফেলে দিচ্ছেন হোটেলের লোকজন। আহা, কত খাবার নষ্ট করা হচ্ছে!
আমি খাবার নেয়ার পাশাপাশি প্লেটে প্লেটে নষ্ট হওয়া খাবারগুলোও দেখতে লাগলাম। কত খাবার! এই খাবার বহু মানুষেরই রাতের খাবার হতে পারতো। এখানে নষ্ট হওয়া খাবার দিয়ে অসংখ্য মানুষেরই রাতগুলো সুন্দর হয়ে উঠতে পারতো। আহা, পৃথিবীর দেশে দেশে কত মানুষ না খেয়ে থাকছে। অনাহারে অর্ধাহারে দিনতিপাত করছে কত মানুষ। পৃথিবীতে প্রতিদিন অন্তত একশ’ কোটি মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায়। আর এভাবে বিশ্বের নানা দেশে হাজার হাজার তারকাখচিত হোটেল রেস্টুরেন্টে খাবার নষ্টের মহোৎসব চলে!
আমরা বেশ জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে খাবার খাচ্ছিলাম। লায়ন্সের এই ধরনের প্রোগ্রামগুলোতে যতটুকু না খাওয়া দাওয়া চলে তার থেকে ঢের বেশি হয় আড্ডা, গল্প। এই আড্ডার লোভে লায়ন সদস্যদের অনেকেই বছরে একবার এভাবে বেরিয়ে পড়েন। ইসামি ফোরাম বা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনকে ঘিরে মন ভরে বেড়িয়ে আসেন, পুরো বছরের শান্তি খোঁজেন। আমরাও যেমন চেন্নাইর সাগরপাড় থেকে সিমলার পাহাড় পর্বত মাড়িয়ে দিল্লীতে ঘুরছি। রাজা বাদশাহ মারছি। আরো নানা পথ মাড়িয়ে কবে যে ঘরে ফিরবো! আহা, ঘর! আমার সোনার বাংলা, প্রাণটা কেন যে এত আনচান করে!
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবর্ষা রাগে
পরবর্তী নিবন্ধসংগ্রাম গৌরব ও ঐতিহ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ