দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৬ মে, ২০২১ at ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমরা বসে আছি। তাজমহলের গায়ে হেলান দিয়ে এভাবে বসা যায় কিনা জানি না। তবে আমাদের কেউ বাধা দিচ্ছিলেন না। কেউ নাও করছিলেন না। আমরা স্বামী স্ত্রী সাদা মার্বেলে হেলান দিয়ে বসেছি, একটু দূরে বসেছেন আমাদের গাইড। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা কাহিল হয়ে উঠেছিলাম। এখন হেলান দিয়ে কিছুটা আয়েশ করে বসতে পারায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলাম। তাজের গায়ে হেলান? নিজেকে সম্রাট শাহজাহানের মতো মনে হচ্ছিল। সম্রাট কি কোনদিন এভাবে বসেছিলেন? সামনের যমুনা প্রায় শুকিয়ে গেছে। স্রোতধারা দূরের কথা, ডুব দেয়ার মতো পানিও নেই। আমি মানসচক্ষে ভাবার চেষ্টা করলাম যে, ভরা জ্যোৎস্নায় টুইটুম্বর যমুনা কী অপরূপ হয়ে উঠতো! এক একটি পূর্ণিমা কিভাবে মাতোয়ারা করতো সম্রাট শাহজাহান কিংবা তাঁর সভাসদদের। যমুনার পাড়ে তাজমহলে হেলান দিয়ে পূর্ণিমা উপভোগ জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হতে পারে! কিন্তু তাজের গায়ে হেলান দিয়ে পূর্ণিমা উপভোগের সুযোগ আমার জীবনে কোনদিন আসবে বলে মনে হয় না। আহ, যদি একটি পূর্ণিমা এখানে কাটাতে পারতাম! নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। আমার ডানহাতটি হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে থাকা প্রিয়তমা স্ত্রী যেন চমকে উঠলো। সে আমার চোখে চোখ রেখে দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানতে চাইলো! মমতাজের জন্য আমার অন্তর হু হু করছে কিনা সেই টিপ্পনি কাটতেও ভুললো না। আমি হাসলাম। বললাম, কোন এক পূর্ণিমায় যদি এভাবে বসে থাকতে পারতাম! দ্যূৎ এটা কোন ব্যাপার হলো, চলো আসবো একবার! কি এমন দূর!
তাজের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছি আমরা। স্বচ্ছ নীল আকাশে ভেসে যাচ্ছিল অগুনতি সাদা মেঘের ভেলা। মেঘপুঞ্জের বহরগুলোর কোনটি হাতি, কোনটি ঘোড়া আবার কোনটিবা সৈন্যদলের মতো ছুটছিল। একটির সাথে একটি এমনভাবে যাচ্ছিল যেন সম্রাট শাহজাহানকে গার্ড অব অনার দিচ্ছিল কোন সুসজ্জিত সৈন্যদল! আমি কল্পনার রাজ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। দেখছিলাম কয়েকশ’ বছর আগেকার মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতিকে। কি জমকালোই না ছিল চারদিক। কিন্তু বেচারার শেষ জীবনের কষ্টে নিজের অজান্তে আবারো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো! আহা, হতভাগ্য পিতা! গাইড আমাকে বললেন, আগ্রা ফোর্টে যাবেন না? ওটা তো তাজের চেয়ে সুন্দর! বলে কি? তাজমহলের চেয়ে সুন্দর স্থাপনা ভারতবর্ষে আছে নাকি! গাইডের প্রশ্নের জবাবে আমরা উঠে দাঁড়ালাম।
তাজমহলকে বিদায় জানিয়ে আমরা আগ্রা ফোর্টের দিকে যাত্রা করলাম। নানা পথ মাড়িয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা আগ্রা ফোর্টের গেটে এসে পৌঁছলাম। এখানেও টিকেট। যথারীতি বিদেশিদের গলাকাটা। গাইড ফাঁকি দেয়ার পরামর্শ দিলেন। যথারীতি ‘না’ করলাম। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে চড়াদামে টিকেট কেটে আগ্রা ফোর্টের ভিতরে প্রবেশ করলাম।
বছর কয়েক আগে আমরা আগ্রায় আসলেও সময়ের অভাবে শুধু তাজমহল দেখে ফিরে গিয়েছিলাম। আগ্রা ফোর্ট দেখার অনেক ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয়নি। তাই এবার অফুরন্ত সময় নিয়ে আগ্রা ঘুরতে এসেছি। প্রয়োজনে রাতও থাকবো, তবুও সবকিছু মন ভরে দেখে তবেই দিল্লী ফিরবো। দিল্লীর কথা মনে পড়তে মনে পড়লো আমার প্রিয় এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এবং ম্যাডাম কামরুন মালেকের কথা। সকাল থেকে কোন যোগাযোগই নেই। ফোন করলাম। ফোন ধরে স্যার বললেন, সবাই শপিং করছে। আমি বসে আছি, কফি খাচ্ছি।’ আমরা কেমন বেড়াচ্ছি তা জানতে চাইলেন তিনি। বললাম, ‘তাজমহল দেখার পর আগ্রা ফোর্টে এসেছি।’ স্যার আগ্রা ফোর্টের ছোটখাটো একটি ইতিহাস আমাকে ফোনেই শুনিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সবকিছু ভালো করে দেখবে। অনেক সমৃদ্ধ একটি স্থাপনা, কোনকিছু বাদ দিও না। হুড়োহুড়ি করো না।’
তাজমহলের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমার মনে আগ্রা ফোর্ট যেন নতুন ছোঁয়া লাগাতে শুরু করেছে। যেন নতুন প্রলেপ। ফোর্টের ভিতরে বাইরের আয়োজন দেখে আমি যেন একটি ঘোরের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলাম। ওরে বাবা, দুর্গ কখনো এমন করে মুগ্ধতা ছড়ায়!
সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আগ্রা ফোর্ট। এটি একটি দুর্গ হলেও একই সাথে ছিল রাজপ্রাসাদ। সম্রাট শাহজাহান কিংবা মমতাজ থাকতেন এখানে। থাকতেন সম্রাট আকবর, যোধা বাইসহ অনেকেই। আরো অনেক সম্রাট এবং ইতিহাসখ্যাত রাণীদের বসবাস ছিল এখানে। তাজমহলের বহু আগে এই ফোর্ট নির্মিত হয়েছিল। ইব্রাহিম লোদী থেকে শুরু করে বাবর, হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব সরারই কিছু না কিছু কাজ রয়েছে এই আগ্রা ফোর্টে। সম্রাট আকবরের সময় দুর্গ হিসেবে এটি বেশ বিকশিত হয়। তবে একে নান্দনিকতার ছোঁয়া দেন সম্রাট শাহজাহান। যা এখনো মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।
গাইড আমাদেরকে ফোর্টের ভিতরের নানা কিছু দেখাচ্ছিলেন। এত আয়োজন চারদিকে। সম্রাট সম্রাজ্ঞীর বসবাসের জন্য যেন অফুরন্ত এক ঐশ্বর্য ভাণ্ডারে গড়ে তোলা হয়েছিল আগ্রা ফোর্ট। ইট পাথরের দেয়ালে দেয়ালে কি অপরূপ সৌন্দর্য, কারুকাজ! চারদিকে কত আয়োজন! কী সমৃদ্ধ! সম্রাটদের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর যোগানই ছিল এখানে। রাজকার্য পরিচালনার চমৎকার ব্যবস্থার পাশাপাশি মনোরঞ্জনের নানা আয়োজনও রাখা হয়েছিল দুর্গের ভিতরে। রাত যাপনের শুধু আলীশান ব্যবস্থাই নয়, মন রাঙানোর জন্য নাচ-গানের আসর বসানোর কি অপূর্ব আয়োজন! সম্রাজ্ঞীসহ সঙ্গী সাথীদের বসবাসের আয়োজন ছিল চোখ ধাঁধানো। কয়েকশ’ বছর আগেকার ওয়াশরুমের ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আজ থেকে প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে পানি ঠাণ্ডা গরমের ব্যবস্থা! ভাবা যায়, খালের মতো কেটে দুর্গের নিচ পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছিল যমুনা। ফোর্টের নিচে কাটা হয়েছিল সুড়ঙ্গ। ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে বয়ে যাওয়া যুমনার স্রোত আগ্রা ফোর্টকে শীতল রাখতো। প্রাসাদের যেই অংশ দিয়ে এই স্রোতধারা ছুঁয়ে যেতো সেখানেই সম্রাজ্ঞী এবং রাণীদের বসবাসের ব্যবস্থা ছিল। রাণীদের ঠাণ্ডা আবহের মধ্যে রাখতে পছন্দ করতেন সম্রাটেরা। লাল একটি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে গাইড বললেন, এখানেই বিখ্যাত যোধা বাই থাকতেন। এই ভবনটি লাল, এটি সম্রাট আকবরের তৈরি। সম্রাট আকবরের তৈরি ভবন! আমি একটু ছুঁয়ে দেখলাম। সম্রাট আকবরের ভবনের সামনে হাসান আকবর!
শুধু কি সম্রাট আকবরের একটি ভবন! আরো কত ভবন রয়েছে আগ্রা ফোর্টে! রয়েছে জাহাঙ্গীর-ই মহল, খাস মহল, দরবারই খাস, শীষ মহল। অনেকগুলো ভবনে ঘুরলাম। ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এক একটি ভবনজুড়ে ঐতিহ্যের ছড়াছড়ি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে শীষ মহল আমার ভিতরটি যেন নাড়িয়ে দিল! এমন করেও ভবন নির্মাণ করা যায়! সম্রাজ্ঞীর ঘুমানোর জন্য এত আয়োজন! এই শীষ মহলের রূপ লিখে বুঝানোর সাধ্যি আমার নেই। এক কথায় অপূর্ব। এমন রূপ শুধু অনুভবের। শীষ মহলের দেয়ালে মার্বেলের চেয়েও বহু দামী হাজার হাজার কাচ স্থাপন করা হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে খচিত ছিল বহু মূল্যবান মনি-মুক্তা,পাথর। দেয়াল জুড়ে খচিত কাচে একই সাথে দেখা যায় লক্ষ কোটি প্রতিবিম্ব। এক একজন রাণীকে কতভাবে যে দেখা যেত এখানে! শুধু শীষ মহলই নয়, এই অনন্য প্রাসাদের বিভিন্ন ভবনে থাকা বহু মূল্যবান সম্পদই লোপাট হয়ে গেছে। শীষ মহলের দেয়াল থেকে মনি মুক্তা লোপাট হয়েছে, বহু পাথর খসে পড়েছে। চুরি করে নিয়ে গেছে অনেক সম্পদ। তবুও এখনো যা রয়েছে তা আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল।
আগ্রা ফোর্টে লাল পাথরের আধিক্য বেশ চোখে পড়ছিল। কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের ছিল সাদা মার্বেলের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা। তাই প্রাসাদে তিনি সাদা মার্বেলের ভবনও নির্মাণ করেন। এই ফোর্টের ভিতরে রয়েছে দুইটি মসজিদ। এখানে শুধুমাত্র মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা একটি মসজিদ ছিল। নাগিনা মসজিদ। এছাড়া মোতি মসজিদ নামেও একটি মসজিদ ছিল।
আসলে আগ্রা ফোর্ট অনেক সমৃদ্ধ। বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা ফোর্টের পরতে পরতে রয়েছে সৌন্দর্য, ঐতিহ্য। তবে সম্রাট শাহজাহানের দুঃখগাথা এই ফোর্টের সৌন্দর্যকে যেন উপহাস করেছে। পুত্রের হাতে বন্দী সম্রাটের জীবনের শেষ আট বছর গেছে কেঁদে কেঁদে, প্রিয়তমা স্ত্রীর কবরের দিকে তাকিয়ে। জীবনের শেষ নিশ্বাসটি সম্রাট এখানেই ফেলেছিলেন। সন্তান আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী সম্রাট মনভরে প্রিয়তমা স্ত্রীর কবরও দেখতে পেতেন না। একটি কক্ষের দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে নিজের মন উজাড় করে নির্মাণ করা তাজমহল দেখতে হয়েছে তাঁকে। পুত্রের হাতে বন্দী থাকা সম্রাটের কাছে নিজের জীবনটাই কি উপহাস মনে হতো? কে জানে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজামেয়া সুন্নিয়া মাদরাসায় ঈদ পুনর্মিলনী সভা
পরবর্তী নিবন্ধসাইফউদ্দিনের কনকাসন তাসকিন