দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কোন প্ল্যান না থাকলেও একেবারে অপ্রত্যাশিত আয়োজনে দিল্লীতে শুরু হলো আমাদের পথ চলা। হাঁটতে হাঁটতে হাটে চলে যাওয়ার মতো ব্যাপার ঘটে গেলো। অলস সন্ধ্যা কাজে লাগাতে পথে নেমেছিলাম। হোটেলের ধারে কাছের নানা কিছু হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম। ফিরে এসেছিলাম হোটেলে। রুমে বসে টিভি দেখে হয়তো সময় কাটাতাম। কিন্তু একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন আয়োজনে সামিল হয়ে গেলাম। প্ল্যানে না থাকলেও হোটেল থেকে আবারো পথ চলা শুরু করলাম। অলি গলি রাজপথ পেরিয়ে চলছিল আমাদের গাড়ি। পাশাপাশি চলছিল আরো অসংখ্য গাড়ি। গিজগিজ করছে চারদিকে। নানা বয়সী মানুষের নিরন্তর পথ চলায় ব্যস্ত দিল্লী। রকমারি আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল বিভিন্ন শপিং মল, ভবন। নিয়ন সাইনের আলোতে আলোকিত চারদিক। সোডিয়াম লাইটের আলোয় ভরে আছে রাজপথ। অচেনা এক শহরে গল্পে গল্পে পথ চলছিলাম আমরা। হযরত শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার জেয়ারত করতে পথে নেমেছি আমরা। মাজারে যাওয়ার কোন প্ল্যান বা প্রোগ্রাম না থাকলেও একেবারে হুট করে হয়ে গেল। লায়ন মনজুর আলম মনজু স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে মাজার জেয়ারতে যাওয়ার সময় সঙ্গী হয়েছি আমরা। আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মনজু ভাইর গাড়িতে সওয়ার হয়েছি। সেভেন সিটার গাড়ি। গাড়ি চলছিল।
অতীতে আমি আরো বেশ কয়েকবার হযরত শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার জেয়ারত করেছি। এতে করে মাজার অঙ্গন আমার চেনা। তবে রাস্তা অচেনা। বিশাল দিল্লী শহরের কোন এলাকা থেকে কোন এলাকায় রাস্তায় গেছে, কিংবা কোন এলাকার রাস্তা কোথায় গিয়ে মিলেছে তা ম্যাপ নিয়ে চললেও বুঝতে কষ্ট হয় আমার। অচিন কোন জায়গায় নিজেকে গাড়ি বা টেঙি চালকের হাতে হাওলা করে দেয়া ছাড়া অন্য কিছু করার থাকে না। দিল্লীতেও এর ব্যাতিক্রম করার সুযোগ নেই। এখানেও আমি ড্রাইভারদের হাতে নিজেকে হাওলা করে দিয়ে অলি গলি চষে বেড়িয়েছি বিভিন্ন সময়। এবারও একইভাবে দিল্লী দর্শনের প্রোগ্রাম আমাদের। রাতে-দিনে চব্বিশ ঘন্টার গাড়ি থাকায় এবার বাড়তি কিছু সুবিধাও হবে। তবে শুরুতেই মনজু ভাইর গাড়িতে সওয়ার হওয়ায় সকালে আসতে বলে আমার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি।
গাড়ি চলছে। নানা পথ মাড়িয়ে এগুচ্ছে আমাদের বাহন। কোন পথ চিনি না, মানুষও অচেনা। চালকও যে পরিচিত তা নয়। তবে আমাদের ট্যুর অপারেটর, অথেনটিক ট্যুরিজমের লায়ন আনোয়ারুল আজীম সার্বক্ষণিক গাড়িসহ আমাদের জন্য হোটেল ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। ফলে গাড়ির চালক কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। ইচ্ছে করলেও কোন ধরনের অঘটন ঘটানোর সুযোগ তার নেই। আমাদের ভুল পথে চড়ালেও তার কোন লাভ নেই। এই অচিন শহরে আপাততঃ আমাদের ভরসার একমাত্র জায়গাও এই ড্রাইভার। সে যেপথে আমাদের নিচ্ছে সেপথই আমাদের পথ। ফলে পথ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমরা অলি দরবেশদের আধ্যাত্মিকতাসহ নানা কিছু নিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলাম।
হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়ার দরগাহে পৌঁছে গেলাম আমরা। দিল্লী শহরে এমন কোন মানুষ নেই যিনি এই বিখ্যাত এই অলির নাম শুনেননি। এমন কোন চালক নেই যিনি এই দরগাহ চিনেন না। চালকই নিজের চেনা পথ ধরে আমাদের দরগাহ গেটে নামিয়ে দিলেন। বললেন, আপনারা জেয়ারত শেষ করে এখানে এসে দাঁড়াবেন। আমাকে ফোন করবেন। এখান থেকে আপনাদের তুলে আমরা হোটেলে ফিরে যাবো।
হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়া ভারতীয় উপমহাদের একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক। এতদঞ্চলে ইসলামের প্রসার এবং প্রচারে সুফি সাধকদের ভূমিকা অপরিসীম। চিশতিয়া তরিকার সুফী সাধকদের অনেকেই দিল্লীতে রয়েছেন। যাদের মাজারে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ জেয়ারত করেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে লাখো মানুষের সম্মিলন ঘটে ওরশের দিনগুলোতে। আমরা যখন মাজারে পৌঁছলাম তখনো শত শত মানুষ মাজার অঙ্গনে। সমর্পিত মানুষের আনাগোনায় গিজগিজ করছে চারদিক। নিবেদিত মানুষ ফুলের ডালায় গোলাপের পসরা সাজিয়ে যাচ্ছিলেন মাজারে। ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন গোলাপ, আতর। অন্যরকমের এক পবিত্রতা চারদিকে। একটি স্নিগ্ধ সুবাসে ভুর ভুর করছে বাতাস। সৃষ্টিকর্তার প্রিয় মানুষ এক একজন অলি। এই প্রিয় বান্দাদের উশিলা করে স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার এই চেষ্টার পক্ষে বিপক্ষে বহু মতামত রয়েছে। নানা জনের দৃষ্টিভঙ্গি নানাভাবে বিস্তৃত। তবে অলির দরবারে আগে যেমন শ্রদ্ধা নিয়ে জেয়ারতে গিয়েছি, এবারও তেমনি শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম।
হযরত শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃহীন হওয়া নিজামউদ্দিন মায়ের সাথে দিল্লীতে চলে আসেন। তিনি দিল্লীতে অধ্যয়ন করেন। লেখাপড়া শেষ করে বিশ বছর বয়সে তিনি সূফি সাধক ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকারের (বাবা ফরিদ নামে অধিক খ্যাত) দরবারে যান এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শিক্ষা দীক্ষায় চাল চলন এবং আচার আচরনে বাবা ফরিদের সন্তুষ্টি লাভ করেন তিনি। বাবা ফরিদ হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়াকে নিজের খলিফা হিসেবে মনোনিত করেন।
দিনে দিনে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া নিজের আচার আচরণ এবং চাল চলনে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা লাভ করেন। সাধনায় এবং আধ্যাত্মিকতায় তিনি তৎকালীন মুসলিম সমাজের নিকট সীমাহীন মর্যাদার আসনে আসীন হন। দিল্লীর গিয়াসপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার আগে আরো নানা জায়গায় বসবাস করেছিলেন তিনি। তাঁর বসবাসের প্রত্যেকটি জায়গা খানকা হিসেবে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা পেয়ে আসছে। প্রতিটি খানকাই কয়েকশ’ বছর ধরে এক একটি পবিত্র জায়গা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিজামউদ্দিন আওলিয়ার বর্তমান মাজার অঙ্গনটিও বহু বহু বছর আগ থেকেই ধনী-গরিবসহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার জায়গায় পরিণত হয়। পবিত্র এই মাজার অঙ্গন প্রতিদিনই মানুষের ভিড়ে লোকারণ্য হয়ে উঠে। তাঁর অনেক শিষ্য আধ্যাত্মিকতার উচ্চ আসন অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে শেখ নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ চিরাগ-এ-দিল্লি, প্রখ্যাত সূফি গায়ক দিল্লি সালতানাতের রাজ্যসভার কবি হযরত আমির খসরু অন্যতম। হযরত আমীর খসরুর মাজারও নিজামউদ্দিন আওলিয়ার মাজার অঙ্গনেই। নিজামউদ্দিন আওলিয়া ১৩২৫ সালের ৩ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। গত পাঁচশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে লাখো মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং নানা আকুতিতে সিক্ত হওয়া একটি পবিত্র অঙ্গন এই দরগাহ। হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়ার মাজার মসজিদসহ বর্তমানের বিদ্যমান বিভিন্ন স্থাপনা ১৫৬২ সালে নির্মিত হয়েছিল বলেও ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে। এতে করে এই মাজার মসজিদের ঐতিহাসিক একটি গুরুত্বও রয়েছে।
শুধু সাধারণ মানুষই নন, দিল্লী সালতানাতের শাসকেরাও হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়া, হযরত আমীর খসরুর ভক্ত অনুরক্ত ছিলেন। দিল্লী থেকে আজমীর গিয়ে হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির (খাজা বাবা) দরবারে দিল্লীর সম্রাটদের শ্রদ্ধা জানানোর বহু নজির রয়েছে। সম্রাটের প্রিয় সন্তানের কবর খাজা বাবার মাজার প্রাঙ্গনে দেয়া হয়েছে। পার্থিব কোন চাহিদা বা চাওয়া পাওয়া না থাকায় চিশতিয়া ত্বরিকার সুফী সাধকদের প্রতি ভক্ত অনুরক্তের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ভিন্ন উচ্চতায় উন্নীত হতো। লক্ষ লক্ষ ভক্ত অনুরক্ত রয়েছেন এক একজন সাধকের। যাদের পবিত্র ছোঁয়ায় অনেকেরই জীবন পরিবর্তিত হয়েছে। অনেকই লাভ করেছেন আধ্যাত্মিক জ্যেতি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত পীর মাশায়েখ এবং অলি দরবেশেরা মানবতার মুক্তির বাণী শুনিয়ে কোটি কোটি মানুষের ভরসায় পরিণত হয়েছিলেন। মানবপ্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করার মানবিক এক শিক্ষাও চিশতিয়া ত্বরিকার হাত ধরে পাক-ভারত উপমহাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে। হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়ার ছয় শতাধিক খলিফা ছিলেন।
আমরা মাজার জেয়ারত করলাম। মসজিদে নামাজ পড়লাম। নিজের জন্য, নিজেদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীসহ সবার জন্য দোয়া করে দরগাহ থেকে বের হয়ে এলাম। প্রচুর সাহায্যপ্রার্থী মানুষ দরগাহের এখানে ওখানে। রয়েছে অসংখ্য দোকানপাটও। মানুষের রুটি রুজির নানা আয়োজন চারদিকে। ক্ষুধার্ত মানুষের খাবার দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে হোটেলে রেস্তোরাঁয়। ফাতেহার খাবারও দেয়া হয় সাধারণ মানুষদের মাঝে। শত শত মানুষ হোটেলে রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করছেন। রাত্রী যাপনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। দরগাহ ঘিরে বহু মানুষের দৈনন্দিন নানা কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। মাজার থেকে বের হয়ে আমরা হেঁটে মূল সড়কের দিকে আসলাম। মনজু ভাই ড্রাইভারকে ফোন করলেন। রাস্তার নির্দিষ্ট স্থানটিতে অল্পক্ষণ অপেক্ষার পরই এসে হাজির হলো গাড়ি। আমরা আবারো হোটেলের পথ ধরলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের নারী লেখকরা
পরবর্তী নিবন্ধ‘ভ্যাকসিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত মাস্ক একমাত্র ভরসা’