দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ছুটছে আমাদের গাড়ি। পাহাড়ী পথ ধরে। দুইপাশে সারি সারি বন রেখে চলছি আমরা। গাছগাছালীর ছায়া এবং পাখীর কলকাকলী মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। নজর কাড়ছিল প্রকৃতি। চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল ঘন সবুজ বনানী। কি যে সুবজ বন! কি যে সুন্দর সব গাছগাছালী! মাঝে মধ্যে দুয়েকটি বানরকে গাছে গাছে দোল খেতে দেখা গেল। চোখে মুখে সাত রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তারা অবাক হয়ে আমাদের গাড়ি দেখছিল। নিজেদের মধ্যে বাদরামিও করছিল। রাস্তার উপর অলস ভঙ্গিতে হাঁটছিল নানা ধরনের ছোট বড় পাখি। গাড়ির অনাহুত আগমন তাদের মেজাজ খারাপ করে তুলছিল। রাস্তা থেকে অনিচ্ছা নিয়ে সরতে হচ্ছিল তাদের। বেশ অলস ভঙ্গিতে তারা রাস্তা থেকে উড়ে যাচ্ছিল। তবে বেশি দূর নয়, পাশেই জঙ্গলের গাছে কিংবা মাটিতে বসছিল। খাবার খুঁজছিল। অদ্ভুদ এক শূন্যতা চারদিকে। কোথাও জনমানুষ নেই। গাড়ি ঘোড়া নেই। ছুটছি কেবল আমরা। পাশে রয়েছে প্রকৃতি। ছবির চেয়ে সুন্দর চারপাশ। অপূর্ব এক প্রাকৃতিক আয়োজন যেন বরণ করছে আমাদের। পুরো বিশ্বজুড়ে যেন শুধু আমরা, একদল মানব মানবী। দুনিয়ার আর কোথাও যেন কোন মানুষ নেই। কেউ নেই।
ট্রাভেলার্সের ভিতরে জমিয়ে আড্ডা চলছিল। বনের ভিতরে বাঘ ভাল্লুক না মারলেও লায়নিজম থেকে শুরু করে অর্থনীতি সমাজনীতি রাজনীতি কোন কিছুই বাদ যাচ্ছিল না। বাদ যাচ্ছিল না দেশে দেশে সংঘটিত নানা ঘটনা দুর্ঘটনাও। বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা হচ্ছিল। মজার মজার স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোর মোক্ষম এক সুযোগ যেন হিমাচল প্রদেশের চেইল থেকে ফেরার পথজুড়ে থাকা বনবনানীর ভিতরে তৈরি হচ্ছিল। আলোচনার বিষয়গুলো বনের গাছগাছালীর মতো অবাধে ঢালপালা বিস্তার করছিল। কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে যেভাবে খুশী সেভাবেই চলছিল আলোচনা। আমিও মাঝে মধ্যে আলোচনায় যোগ দিচ্ছিলাম। তবে ফ্লোরের পুরোটাই ছিল আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এবং কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়ার দখলে। আমার ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক কিংবা সুপ্রভা বৌদিও মাঝে মধ্যে যোগ দিচ্ছিলেন নানা ইস্যুতে। কথা বলছিলেন। তবে একেবারে চুপচাপ থেকে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিলেন লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা কিংবা আমার ঘরনি। ভারতের নানা প্রদেশের নানা খাবার দাবার নিয়েও জলজ্যান্ত সব আলোচনা চলছিল। মাঝে মধ্যে সমালোচনাও।
আমরা এগুচ্ছিলাম। কত পাহাড় যে ডিঙ্গালাম, কত পাহাড়ের পাদদেশ ধরে যে ছুটলাম, কত পাহাড়ী ছড়া যে পার হলাম তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমাদের নিয়ে কখনো পাহাড়ের চূড়ায় আবার কখনো পাহাড়ের পাদদেশ ধরে ছুটছে ট্রাভেলার্স। বিপুল গতিতে নয়, বিশ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার স্পিডে এগুচ্ছি আমরা। মাঝে মধ্যে দশ কিলোমিটারেও নেমে আসে স্পিড মিটারের কাঁটা। ফ্রন্ট সিটে বসার কারণে গাড়ির স্পিড মিটারে ক্ষণে ক্ষণে চোখ যাচ্ছিল আমার। খাড়া পাহাড় থেকে নামতে কলজে মুছড়ে মুছড়ে উঠছিল। আবার চোখের সামনে সুউচ্চ পাহাড় দেখেও। ওই পাহাড়টি ডিঙ্গালেই বুঝি জনপদের দেখা পাবো। মানুষের আনাগোনা দেখবো। কিন্তু ওই পাহাড় পার হওয়ার পর আবারো মাথা উঁচু করে দেখা দিচ্ছিল অন্য পাহাড়। এভাবে কত পাহাড় যে ডিঙ্গালাম!
অবশেষে দেখা পাওয়া গেল বড় রাস্তার। বিশাল চওড়া চার লেনের মহাসড়ক। এই রাস্তা যে কোথায় থেকে কোথায় গেছে কে জানে! জম্মু কাশ্মির থেকেও আসতে পারে। আসতে পারে লাদাখ থেকে। তবে রাস্তাটি দিল্লীতে গেছে। এই রাস্তা ধরেই আমরা চন্ডিগড় পৌঁছবো। ভারতের সড়ক যোগাযোগে বিপ্লব সাধিত হয়েছে গত কয়েক বছরে। হাজার হাজার কিলোমিটার চার লেইন, ছয় লেইন এবং আট লেনের মহাসড়ক তৈরি হয়েছে দেশের নানা অঞ্চলে। তৈরি হয়েছে এঙপ্রেসওয়ে। নিজেদের অফুরন্ত পাথরে তৈরি রাস্তাগুলো বেশ মসৃন। থালার পিটের মতো। গাড়িতে চড়ে এবং চালিয়ে অন্যরকমের সুখানুভূতি হয়। এমন রাস্তায় দেড়শ’ কিলোমিটার স্পিড না তুললে গাড়িরই বুঝি অপমান। অবশ্য আমাদের ট্রাভেলার্সের অত গতি তোলার সুযোগ হয়তো নেই। একশ’ কিলোমিটার স্পিডে ছুটছিল বেচারা। দুইপাশে ফসলি জমি, দোকান পাট, জনপদ রেখে চন্ডীগড়ের দিকে ছুটছি আমরা।
চন্ডীগড় কথাটি চন্ডীদাশের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই চন্ডীগড়ের সাথে চন্ডীদাশের কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা জানি না। তবে চন্ডীগড়ের নামকরণ করা হয়েছে চন্ডী মন্দিরের নামে। দেবী চন্ডীর গড় বা দুর্গ থেকেই চন্ডীগড়ের নামকরণ। ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের রাজধানী চন্ডীগড়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে চন্ডীগড় প্রশাসনিকভাবে এই দুইটি রাজ্যের কোনটিরই অধীন নয়, এটি পুরোপুরি কেন্দ্র শাসিত একটি অঞ্চল।
১৯৪৭ ব্রিটিশের বিদায়কালে পাকিস্তান এবং ভারত ভাগ হওয়ার সময় পাঞ্জাব রাজ্যটিও ভারত ও পকিস্তানের মধ্যে আধাআধি ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। পাঞ্জাবের পুরাতন রাজধানী লাহোর পাকিস্তানের অংশে পড়লে ভারতীয় অংশটির জন্য একটি রাজধানীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ওই সময় ভারতের ভাগে পড়া পাঞ্জাবের অন্যান্য শহরগুলোকে রাজধানী করার মতো সুযোগ সুবিধা না থাকায় নতুন করে একটি শহরের গোড়াপত্তনের চিন্তাভাবনা করা হয়। এরই আলোকে একেবারে পরিকল্পিত উপায়ে ১৯৫০ সালে শুরু হয় চন্ডীগড়ের গোড়াপত্তন। বিভিন্ন প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কারণে চন্ডীগড়ের শুরু থেকেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।
১৯৬৬র ১লা নভেম্বর পাঞ্জাবের পূর্বাঞ্চলের হিন্দিভাষী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভারতের নতুন রাজ্য হরিয়ানার জন্ম হয়। পশ্চিমাংশের পঞ্জাবীভাষীরা থেকে যায় পাঞ্জাব রাজ্যে। কিন্তু চন্ডীগড় শহরটি পড়ে যায় রাজ্য দুটির ভৌগোলিক ও ভাষাঅঞ্চলের সীমারেখার উপরেই। এতে করে দুই রাজ্যেরই প্রশাসনিক রাজধানী হিসাবে যাতে কাজ করতে পারে সেই জন্য চন্ডীগড়কে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে রেখে দেয়া হয়। অবশ্য ১৯৮৬ সালে অঞ্চলটিকে পাঞ্জাবে অন্তর্ভুক্ত করার কিছু প্রক্রিয়া চললেও তা স্থগিত হয়ে যায়।
চন্ডীগড় শহরে প্রবেশ করতেই একটি বিপত্তির সৃষ্টি হলো। আমাদের ট্রাভেলার্সের চালক একটি ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেন। তেমন বড় কোন সমস্যা নয়। কোন দুর্ঘটনাও ঘটেনি। শুধু লালবাতি জ্বলে উঠলে যেখানে দাঁড়ানোর কথা সেখানে না দাঁড়িয়ে তিনি কয়েক গজ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ভুল বুঝতে পেরে তিনি নিজে নিজে পেছনেও সরে গেছেন। কিন্তু রাস্তার ক্রসিং পার হওয়ার সাথে সাথেই আমাদেরকে পুলিশের সিগন্যালে পড়তে হলো। আমাদের গাড়ির সামনে বিশেষ ধরনের ব্যারিয়ার দিয়ে পথ আটকে দেয়া হলো। কাগজপত্র চাওয়া হলো চালকের কাছে। লাইসেন্সও। অনেক আকুতি মিনতি করলেন আমাদের চালক। ইচ্ছে করে করেন নি, ভুলে হয়ে গেছে বলে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মামলা দেয়া হলো। স্লিপ ধরিয়ে দেয়া হলো। অন্তত পনের মিনিটের দেন দরবারে কোন কাজ না হওয়ায় স্লিপ নিয়ে গাড়িতে ফিরলেন তিনি। ভীষণ মন খারাপ করে তিনি মামলা খাওয়ার খবরটি জানালেন আমাদের। অবশ্য আমাদের তো কিছু করার ছিল না। চন্ডীগড়ের পুলিশ আমাদের কথা শুনবেনই বা কেন? অত্যন্ত মন খারাপ ভাব নিয়ে অতি অলস ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে লাগলেন তিনি। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সতর্ক। কিন্তু চালকের দিকে আমার বা আমাদের আর তেমন খেয়াল নেই। আমার চোখ জোড়া ছুটছে শহরের রাস্তায়, আশেপাশের ভবন, অবকাঠামো, গাছগাছালীতে। এত সুন্দরও শহর হয়! এত চমৎকার রাস্তাঘাট, রাস্তার পাশে প্রশস্ত ফুটপাত, গাছগাছালী। অপূর্ব এক গোছানো শহর। ভারতের বুকে এমন শহর!
কথাটি বলতেই আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বললেন, এটি পরিকল্পিত শহর। অনেক পরিকল্পনা করে শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে করে দেখ, রাস্তাগুলো একেবারে সোজা। ব্লক ব্লকে ভাগ করা। পুরো শহরটি যেন একটি আবাসিক এলাকা। প্রতিটি বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা গেছে। শহরের কোন জায়গায় কি হবে তার সবই আগে থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে। ডিজাইন করা হয়েছে। ওই ডিজাইনের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। করেওনি। এতে করে শহরটি সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছে। উঠতে পেরেছে। আরো কিছুক্ষণ পথ চলার পর আমার এডিটর স্যার বললেন, চন্ডীগড় শহর হয়েছে, ইট পাথরের জঞ্জাল হয়নি। আমরাতো শহর বানানোর নামে ইট পাথরের জঞ্জাল বানাই। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঊর্ধ্বগতি নিত্যপণ্যের বাজার দর
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বনবীর (সা.) জীবনদর্শন