দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হাঁটছিলাম আমরা। গন্তব্য রেস্টুরেন্ট। সেই চেনা পাহাড়ি পথ ধরে এগুচ্ছি আমরা। দুপুরের মতো। পায়ে পায়ে এগুচ্ছি। কিন্তু দিনের মুগ্ধতার সাথে রাতের ভালোলাগার এমন পার্থক্য আগে ঠিক কখন চোখে পড়েছিল মনে করতে পারছিলাম না। ভরা চাঁদনী। বন ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎন্সায়। রিসোর্ট জুড়ে থাকা বৈদ্যুতিক আলোকে ম্লান করে দিয়েছে চাঁদের আলো। রিসোর্টের বৈদ্যুতিক আলোগুলোও মুগ্ধ হওয়ার মতো। গাছগাছালির ফাঁকফোকর এবং টিলাজুড়ে থাকা দূর্বাঘাসের ভিতরে স্থাপন করা হয়েছে নানা ডিজাইনের বাল্ব। প্রতিটি বাল্ব থেকে বেরুচ্ছে চমৎকার মায়াবী আলো। চাঁদের আলোর সাথে মিলেমিশে বাল্বগুলোকে ‘রূপকথার সাপের মাথার মানিকে’র মতো লাগছিল।
আমাদের গায়ে প্রচুর শীতের কাপড়। নানা ধরনের কাপড়ে আপাদমস্তক মুড়িয়ে রেখেছি। পায়ে মোটা মোজাতো আছেই, কান টুপি এবং হাত মোজার কারণে শরীরে অনাবৃত বলতে কিছু নেই। শরীর জুড়ে কয়েক স্তর কাপড়। এতে শীতের কষ্ট বেশ কমেছে, তবে পুরোপুরি ঠেকেনি। আমরা পায়ে পায়ে এগুচ্ছি। চাঁদের রূপ পুরো বনজুড়ে অপার এক সৌন্দর্য তৈরি করেছে। চারপাশে অপরূপ মায়াবী এক পরিবেশ।
রেস্টুরেন্টে দুপুরের সেই বড় টেবিলেই বসতে দেয়া হলো আমাদের। হিটার চলছিল চারদিকে। এতে করে বাইরে তীব্র শীত হলেও রেস্টুরেন্টের ভিতরে অনুভব করছিলাম কুসুম কুসুম উষ্ণতা। ধুমায়িত স্যুপ এনে দেয়া হলো আমাদের। অন্য সময় এমন স্যুপে ঘাম ঝরায়। এখন তেমন কোন খবরই হলো না। বেশ জমিয়ে ডিনার করলাম আমরা। ম্যাডামের জন্যও নানা কিছু অর্ডার করে রুমে পাঠিয়ে দেয়া হলো। রেস্টুরেন্টে আমাদের আরো এক পশলা আড্ডা চললো। ডিনারের পর চললো কফির আয়োজনও। পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রুমে রুমে চলে গেলাম। চারটি রুমে আমাদের নিশিযাপনের আয়োজন রয়েছে। কিন্তু রুমে ঢুকে আমার মনটি কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। বাইরের চাঁদনী রাত আমাকে কেবলই পিছু ডাকছিল। এমন মায়াবী রাতে বনের ভিতরে রাত কাটানোর সুযোগ কি জীবনে বার বার আসে? এমন রাত কী ঘরের ভিতরে শুয়ে বসে নষ্ট করা যায়! গিন্নীকে বাইরে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে বেগ পেতে হলো। শীতে জুবুথুবু হয়ে যাওয়া আমার স্ত্রী নিমরাজি হলো। বললো, ‘ঠাণ্ডা লেগে গেলে বিপদে পড়বো। তার থেকে চলো, টিভিতে একটা সিনেমা দেখি।’ বললাম, ‘সিনেমাতো আমরা বাড়িতেও দেখি। হরদম দেখি। কিন্তু এমন বনের ভিতরে চাঁদ কী জীবনে আর দেখতে পাবো?’
আমার ঘরণীর মায়া হলো। তার চোখ দেখে মনে হলো চাঁদ দেখার চেয়ে সে আমাকে বেশি করুণা করলো। বাইরে বের হলাম। তীব্র শীত। উঁকি দিয়ে স্যারের রুমের দিকে দেখলাম। উনারাও বের হয়ে গেছেন কিনা কে জানে! আবার আমাদের এমন ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে দেখলে বকাও দিতে পারেন। তাই সতর্কতার সাথে আমাদের রুমের পাশের সেই গল্ফ কোর্সের মতো ছোট্ট মাঠটিতে এসে পৌঁছলাম। ছোট্ট একটি মাঠ। সবুজ দূর্বাঘাসে আচ্ছাদিত। বসার একটি বেঞ্চ। সামনে টি টেবিল। ঘাসের ভিতর বৈদ্যুতিক বাল্ব। আলো ছড়াচ্ছে। আমি বেঞ্চে বসতে গিয়ে টের পেলাম যে, সেটির পুরোটাই ভিজে আছে। কুয়াশায়। আমার স্ত্রীকে দাঁড়াতে বলে নিজেই রুমে গেলাম। অনেকগুলো টিস্যু নিয়ে এসে বেঞ্চটি মুছলাম। হেলান দিয়ে বসার পর টের পেলাম যে, লোহার বেঞ্চটি ঠাণ্ডায় জমে আছে।
গা ভর্তি শীতের কাপড় থাকায় বেঞ্চের ঠাণ্ডা লোহা আমাদের তেমন বিচলিত করতে পারলো না। আমরা দুজনে চাঁদের আলোয় গা ভাসিয়ে গুনগুন করতে লাগলাম। আহা, এমন শীতের রাত না হয়ে যদি ভাদ্র মাসের উজ্জ্বল কোন রাতে এখানে আসা যেতো! অদূরের পাহাড়গুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। চাঁদের আলোতে দারুণ দেখাচ্ছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এক একটি পাহাড়। আজ জ্যোৎন্সা রাতে সবাই গেছে বনে গানটি গুনগুন করতে করতে ভিতরটি নেচে নেচে উঠছিল। প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে এমন রাত আর কখনো বনের ভিতরে কাটানো হবে কিনা জানি না, তবে বহু বহু বছর পরও এই রাতটি আমার অন্তরে উজ্জ্বলতর একটি রাত হিসেবে জাগরুক থাকবে।
ঠাণ্ডার তীব্রতা বাড়ছিল। এত কাপড়ছোপড়ের ভিতরেও বুকে গিয়ে বাজছিল শীতের তীব্রতা। স্ত্রীকে নিয়ে রুমে ফিরে আসলাম। অনেকক্ষণ বাইরে বসার ফল কিনা জানি না, তবে ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছিল। আমার শীতানুভূতি কম। শীত খুব এনজয় করি আমি। অথচ সেই আমাকেই পুরোপুরি কাবু করে ফেলছিল শীত। ঘুমানোর প্রস্তুতি হিসেবে জ্যাকেট এবং মাঙ্কি ক্যাপ খোলার সাথে সাথে ঠক ঠক করতে লাগলাম। বরাবরই শীত কাতুরে আমার স্ত্রীর অবস্থা খুবই শোচনীয়। আমি ইন্টারকমে এঙট্রা কম্বল দিতে বললাম। অল্পক্ষণের মধ্যে আলাদা একটি কম্বল দেয়া হলো। শুধু জুতা খুলে কম্বলে ঢুকে পড়লাম। না, ঠাণ্ডার তীব্রতা কমলেও পুরোপুরি যাচ্ছে না। চাঁদের আলোর লোভে ওভাবে খোলা হাওয়ায় বসা ঠিক হয়নি বলেও মনে হতে লাগলো। আমি আবারো ফোন করলাম। রুম সার্ভিসে শীতের তীব্রতার কথা জানিয়ে একটি এঙট্রা হিটার দেয়ার অনুরোধ করলাম। এঙট্রা হিটার দিয়ে গেল। রুমের ভিতরে দুই দুইটি হিটার চলছে। গায়ের উপর ডাবল ট্রিপল কম্বল। শুধু জ্যাকেট ছাড়া ইনারসহ শীতের নানা কাপড় শরীরে জড়ানো রয়েছে। এত কিছুর পরও শরীরের কুন্ডুলী কেবলই ছোট হচ্ছিল।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। যখন ঘুম ভাঙলো তখন মনে হলো শুধু রুমই নয়, তাবত বিশ্বই বুঝি ঠাণ্ডায় জমে আছে। শীতের তীব্রতা বুকের ভিতরে গিয়ে লাগছিল। এমন ঠাণ্ডায়ও মানুষ বাঁচে!
শীতের তোয়াক্কা না করে আমি ছুটে বেরিয়ে আসলাম। বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মুঠো মুঠো বরফকুচি তুলে নিলাম হাতে। ছড়াতে লাগলাম এখানে ওখানে। বাচ্চাদের মতো আনন্দ পেয়ে বসছিল আমাকে। জীবনে বহু বরফ দেখেছি। ইউরোপ আমেরিকার বরফেও কম ছোটাছুটি করিনি। কিন্তু এভাবে রুমের দরোজা খুলেই বরফ! অসাধারণ! আমি চিৎকার করে আমার ঘরনিকে বরফে নামতে বললাম। কিন্তু শীতের ভয়ে তটস্থ থাকা আমার স্ত্রী এক পা পেছনে গেল।
খুট করে খুলে গেল আমার পাশের রুমের দরোজা। লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা বেরিয়ে আসলেন রুম থেকে। তাদের দুজনেরই চোখ বড় বড়। ঘরের সামনে বরফের ছাদর! নিশাত ইমরান তো বলেই ফেললেন, অকল্পনীয়। সত্যিই, দুজনের কেউই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে বরফ বুঝি এভাবে ঘরদোরেও হানা দিয়ে থাকে! সিমলাতে বরফ নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠা নিশাত ইমরান এবং রেহেনা আপা এখানেও বরফ নিয়ে মেতে উঠলেন। আমার স্ত্রী রুমের দরোজা থেকে আমাদের দেখছিলেন। আচমকা সেই সে চিৎকার করে উঠলো। বললো, ‘দেখেছো, দেখেছো? ঠান্ডা কোত্থেকে আসে দেখলে আস।’ আমি তার চোখে চোখ রাখলাম। সে বুঝি শীতের মায়ের দেখা পেয়েছে। বেশ শংকিত হয়ে সে বললো, ‘আমাদের জানালা খোলা। আর খোলা জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডায় রাতভর আমরা জমে যাচ্ছিলাম। ঘুমাতে পারিনি।’ আমি কাছে গিয়ে দেখলাম , জানালার কাঁচ খোলা। শুধু মশার নেট দেয়া। পর্দার আড়ালে থাকা কাঁচ টেনে জানালা যে বন্ধ করা হয়নি তা আমরা খেয়াল করিনি। খেয়াল করেনি আর কেউ। এতে করে হিমাচলের হিমবাহের সব হাওয়া অনায়াসে আসা যাওয়া করেছে রুমে। আমরা কম্বলের পর কম্বল ছড়িয়েছি, হিটারের পর হিটার, কিন্তু হিম ঠেকাতে পারিনি। জানালা খোলা রাখা আর বাইরের খোলা হাওয়ায় বসে থাকা যে একই কথা তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে জানা গেল যে, আমাদের চারটি রুমেরই জানালা খোলা ছিল। চারটি রুমেই ঠান্ডা ঠিক বনের শীতের মতোই এসেছিল। (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোর অপরাধ ও রাজনীতি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ