দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৮ মে, ২০২২ at ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কমলাভোজন যে এত জমকালো হয়, হয় এত রসালো তা ঠিক এভাবে আগে কোনদিন ঠাহর করিনি। কমলার এত রস! শুধু কোষে নয়, মনে হয় খোসাও রসে ভর্তি। আলতো করে টান দিলে সরে আসছে খোসা, গড়িয়ে পড়ছে রস আর ভিতরে উঁকি দেয় টুইটুম্বর কোষ। কমলার খোসার রসে আমাদের হাতের আঙ্গুল আর কোষের রস আমাদের মুখ দারুণভাবে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। মিষ্টি একটি ঘ্রাণ উড়ে উড়ে এসে যেন আমাদের নাকেমুখে চুমু দিচ্ছিল। আমরা একটি একটি করে কমলার খোসা ছড়াতে লাগলাম, আর একটি একটি করে কোষ মুখে পুরছিলাম। নিজেদের কমলা থেকে সতীর্থদের মাঝেও বিলি করছিলাম– ‘এটি একটু খেয়ে দেখুন, দারুণ টেস্টি। যেন রসের ডিব্বা!’

জ্যাক কোম্পানির অফিসে আমাদের যেভাবে খাওয়ানো হয়েছে বা আমরা যেভাবে পেটপুরে খেয়েছি তাতে আরো দু’চার ঘন্টা কারোরই পানি খাওয়ারও ইচ্ছে হওয়ার কথা নয়। আমাদের কারোর কোনকিছু খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু কমলার ঘোমটা সরানোর পর যেভাবে রসের হাতছানি তাতে নিজেকে ঠিক সামলে রাখা কঠিন! শুধু আমি নই, আমরা কেউ আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। হুমড়ি খেয়ে রসাস্বাদনে লেগে পড়ি। এক একটি কমলার ঘোমটা সরাচ্ছিলাম, আর মুহূর্তের মধ্যেই কোষগুলো মুখে মুখে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছিল। মুখে দিলে মিলিয়ে যাচ্ছিল মাখনের মতো। কমলাও এমন টাটকা হয়, হয় এমন রসালো! কোল্ড স্টোরেজের কমলা খেতে অভ্যস্ত আমরা। ঠান্ডায় সব রসকস চলে যাওয়া কমলা খাওয়ার সুযোগ জুটে আমাদের। এতে করে একটি কমলা যে ঠিক কতখানি রসালো হতে পারে সেই ধারণাই আমার ছিল না। গাছ থেকে ছিঁড়ে টাটকা কমলা খাওয়ার সুযোগ দীর্ঘদিনের ধারণা পাল্টে দিল।

আমরা প্রত্যেকে ঠিক কয়টি করে কমলা খেলাম তার কোন হিসেব নেই, হিসেব রাখাও সম্ভব নয়। অবশ্য হিসেব রাখার দরকারও নেই। কমলার ওজন হয়ে গেছে, পয়সাকড়িও পরিশোধ হয়ে গেছে। এখন গোনাগুনিতে আর কিছু যায় আসে না। আমরা আমাদের কমলাগুলো খাই বা মাথায় দিই সেটি আমাদের ব্যাপার। চাষীরও বিষয়টি নিয়ে কোন আগ্রহ দেখা গেলো না। একদল বড় মানুষের ছেলেমি দেখে তিনি কি মনে মনে বিরক্ত? কে জানে!

অনেকক্ষণ ধরে চললো আমাদের কমলা উৎসব। কত ঢঙে যে আমরা ছবি তুললাম তারও ইয়ত্তা নেই। ক্ষেতে বসে কমলা খাওয়ার উৎসব সম্পন্ন করে আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম। আমাদের হাতে হাতে কমলা, পকেটেও। গাড়িতে চড়ার পর আমি বেশ আয়েশ করে একটি ঘুম দেয়ার উদ্যোগ নিলাম। এত বেশি খাওয়া দাওয়া হয়েছে যে, এখন ঘুমের আর কোন বিকল্প নেই। অবশ্য আমরা হোটেলে ফিরছি। রাতে জ্যাক কোম্পানির ডিনারে যোগ দেয়ার আগে আমাদের আর কোন কাজ নেই। নিজেরা কোথাও ঘুরতে গেলে গাড়ি ড্রাইভার এবং গাইড রয়েছে, আমরা ঘুমালেও তারা হোটেলেই থাকবে। সুতরাং সবকিছু বেশ রিল্যাক্সে রয়েছে। কোথাও হুড়িহুড়ি নেই।

তাইজুর বেশ নামকরা একটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফাইভ স্টার হোটেল। সুতরাং রকমারি সুযোগ সুবিধার ছড়াছড়ি। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে পুল কিংবা জিমে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগ রয়েছে। সুযোগ রয়েছে বার বা ডিসকোতে সময় কাটানোর। আর নিজের রুমে ঢাউশ সাইজের টিভিতো রয়েছেই। যার যেভাবে ইচ্ছে সময় কাটাতে পারে।

বিকেলের কোন প্রোগ্রামের কথা এখনো কারো মাথায় আসেনি। কেউ কিছু বলেনও নি। আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পক্ষে। রুমে গিয়ে লম্বা একটি ঘুম দেবো আমি। কাউকে কিছু না বললেও মনে মনে বিষয়টি ঠিক করে রেখেছি আমি।

কি ভাবতে ভাবতে যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম কে জানে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি তাও বুঝতে পারছিলাম না। হোটেলে পৌঁছার পর লায়ন ফজলে করিম আমার ঘুম ভাঙ্গালেন।

হোটেলের রুমে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। কী সুন্দর করে যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে! ধবধবে সাদা বিশাল বিছানাটি নষ্ট করতে ইচ্ছে করছিল না। আমি কফি মেকারের অবস্থান দেখে নিলাম। সরঞ্জামের কি অবস্থা তাও। সবই ঠিক আছে। আমি মনের মাধুরী মিশিয়ে এক মগ কফি তৈরি করলাম। একেবারে লো করে দিলাম রুমের টেম্পারেচার। আলো একেবারে কমিয়ে দিলাম। ভারী পর্দায় ঢাকা বিশাল জানালা। এতে করে বাইরের আলোর রুমে ঢোকার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আলো আঁধারীর মায়াবী এক পরিবেশ আমার রুমে। ধবধবে সাদা বিছানাটিকে এখন আরো বেশি মোহনীয় লাগছিল। না, এমন বিছানা নষ্ট করা ঠিক হবে না। আমি কফির মগ নিয়ে সোফায় বসলাম।

বিশাল স্মার্ট টিভি দেয়ালজুড়ে। অন করলাম। না, মেন্ডারিন ভাষার কিছুই বুঝার সুযোগ নেই। বাংলাতো দুরাশা, ইংরেজিতেও একটি চ্যানেল পাওয়া গেল না। একটি চ্যানেলে বেশ চমৎকার একটি চাইনিজ নাচ চলছিল। আগেও এমন নাচের অনুষ্ঠান টিভিতে দেখেছি। থাইল্যান্ডে লাইভও দেখেছিলাম একবার। চীন, হংকং, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডের তরুণতরুণীদের প্রায় একইরকম লাগে। এতে করে এদের নাচ দেখে বুঝার উপায় থাকে না সেটি ঠিক কোথাকার। এখন চীনে বসে চাইনিজ টিভিতে দেখছি বলে মনে হচ্ছে ‘চীনা নৃত্য’। থাইল্যান্ডে হলে ‘থাই’ মনে হতো।

ইন্টারকমে ফোন করলেন লায়ন ফজলে করিম। বললেন, ‘লিডারচলেন, হেঁটে আসি। কাছেই একটি শপিং মল আছে। পছন্দ হলে কিছু কিনলেন, নাহলে এমনিতে ঘুরে দেখলেন। ভালো লাগবে।’ আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে লবিতে নামছি বলে ফোন রাখলাম। বেশ দ্রুত তৈরি হয়ে নিচে নামলাম। লায়ন ফজলে করিম নেমে আসলেন অল্পক্ষণের মধ্যে। লায়ন বিজয় শেখর দাশ এবং লায়ন কাঞ্চন মল্লিকও আসলেন একটু পরে। ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ইউ আহমেদ এবং আরিফ মঈনুদ্দীন ভাই এবং চট্টগ্রামের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী লায়ন আবদুল বারিক এবং শরিফুল ইসলাম ভাইও একে একে নেমে আসলেন। আমাদের পুরো দলটি যে কোন বিশেষ যুদ্ধে যাত্রা করলাম!

বিশাল চওড়া রাস্তা। থালার পিঠের মতো মসৃণ। ট্রাফিক মোটামুটি। শত শত গাড়ির কান ঝালাপালা করা হর্ণ নেই। রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলছে। তবে লক্ষনীয় ব্যাপার হচ্ছে স্লো কোন গাড়ি নেই। নেই রিক্সা ঠেলার মতো বাহনও। তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল বহু নামি দামি সেডান, জীপ। বাস, ট্রাক,কাভার্ড ভ্যান, কন্টেনারমোভারের মতো গাড়িও ছুটছে। দূরন্ত গতি সবার। কারো যেন থামার সময় নেই, কারো নেই গতি কমানোর উপায়। আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটছি। গল্প করতে করতে হাঁটছি। এত ব্যস্ত একটি সড়কের ফুটপাতে এত হেলাফেলায় হাঁটলেও নিজেদের অনিরাপদ মনে হচ্ছিল না। ফুটপাত এবং লেনের নিরাপদ দূরত্বই আমাদের এতবেশি নির্ভার করেছে।

দুনিয়ার সব জায়গার শপিং মলই একই। আলোকোজ্জ্বল। তকতকে ঝকঝকে। চোখ ধাঁধানো ইন্টেরিয়র, থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। সবকিছু মিলে দারুণ এক উৎসবের আবহ। কেনাকাটার যেন ধুম লেগে যাওয়া পরিবেশ। এই শপিং মলটিও একই। একই রকমের জমকালো। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম।

সন্ধ্যার পরপরই আমরা ডিনারে সামিল হলাম। চীনে ডিনার করা হয় সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে। আটটা তাদের ডিনারের জন্য অনেক দেরি। নয়টায় ঘুমিয়ে যান অধিকাংশ চীনা। ভোর চারটায় উঠে শরীর চর্চা থেকে শুরু করে দিনের কাজ শুরু করেন তারা। অতএব ইচ্ছে না থাকলেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আমাদেরকে রেস্টুরেন্টে হাজির হতে হলো। রেস্টুরেন্টটি বিশাল। এটা ঠিক যে চীনাদের সবকিছুই বড় বড়। দেড়শ’ কোটি মানুষের বিশাল বাজারটি সামাল দিতে তাদের সবকিছুই বড় বড় করতে হয়।

দুপুরের জমকালো সব খাওয়া কিংবা কমলাভোজনের রেশই এখনো কাটেনি। তার উপর ভরসন্ধ্যায় ডিনার! দেশে আমরা যখন কেবল একটি দুইটি বিস্কিট চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাই, কিংবা একটি নানরুটি একটুখানি ডালে মুড়িয়ে খেয়ে বৈকালিক নাস্তা সারি তখন যদি ফ্রাইড রাইচ, আস্ত মুরগীর রোস্ট, হাঁসের কাবাব, মাছের গ্রিল দিয়ে টেবিল ভর্তি করে খেতে দেয় তাহলে কী খাওয়া সম্ভব! টেবিলে কয়েক রকমের স্যুপও দেয়া হয়েছে, দেয়া হয়েছে সবজি, চিংড়ীসহ নানা খাবার। দলে আমরা অধিকাংশ মুসলিম হওয়ায় খাবার অর্ডারের সময় সেভাবে দেয়া হয়েছে। এতে করে খাবার নিয়ে অন্য কোন সমস্যা ছিল না, তবে পেটের সক্ষমতা বলে যে একটি কথা আছে সেটি নিজে ভুলে গেলেও পেট ভুলতে দিচ্ছিল না। জ্যাক কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কমকর্তাও আমাদের সাথে ডিনারে যোগ দিয়েছেন। গল্পে আড্ডায় আমরা ডিনার পর্ব সাঙ্গ করলাম। যতটুকুনা খাওয়া হলো তার থেকে ঢের বেশি হলো আড্ডা, গল্প। টেবিলভর্তি খাবার নষ্ট হলো। আহারে খাবার!

আমাদের আসর ভাঙলো। সবাই যে যার মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমিও ফিরে আসলাম রুমে। সেই ধবধবে সাদা বিছানা। সেই মোহনীয় আলোআঁধারীর চমৎকার আবহ। মনটি উদাস হতে শুরু করলো। আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে উৎসবমুখর মনটি কেমন করে যেন আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। বিদেশে মাঝেমধ্যে এমনটি হয় আমার। যখন সবার সাথে থাকি তখন ভালোই থাকি, একা হলেই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। পরিবার পরিজন স্বজন প্রিয়জন সবার জন্য অদ্ভুত এক শূন্যতা পেয়ে বসে আমাকে। ‘রোদনভরা এই বসন্তে…’ গানটি প্লে করে দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। ধুমায়িত কফির মগ আমাকে আর টানছিল না। এত আগ্রহ নিয়ে ভালোবেসে নিজের হাতে তৈরি করা কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। ‘রোদনভরা এই বসন্ত…’ বসন্তেও রোদন হয়? উৎসবেও মন খারাপ হয়? সবার মাঝে থেকেও বুঝি নিজেকে একা একা লাগে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্তানদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখুন
পরবর্তী নিবন্ধবিদায়! লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি স্ট্যাকপোল