দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২২ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

গার্মেন্টসে এত মেশিন লাগে! এত্ত রকমারি মেশিন! মেশিন এতভাবে কাজ করতে পারে!! লোহালক্কড়ের এক একটি মেশিন কী অবলীলায় না মানুষের মতো হা পা চালিয়ে কাজ করছে। কী সাংঘাতিক!! কারখানার শুধু পোশাক তৈরিই নয়, পরতে পরতে যেন সাতরাজ্যের বিস্ময়! আমরা ঘুরছিলাম বিশাল এক গার্মেন্টস কারখানার ভিতরে। প্রতিটি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা আমাদেরকে ওই বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বলে রাখা ভালো যে, ওনারা কথা বলছিলেন চীনা ভাষায়। আমাদের ইংরেজীতে অনুবাদ করে বলছিলেন চীনা গাইড। মাঝেমধ্যে বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আমাদের দলপতি লায়ন ফজলে করিম।

জ্যাক কোম্পানির রকমারি মেশিনের নানা কারিশমা আমাদের দেখানো হচ্ছিল। আমাদের সফরসঙ্গীদের সকলেই গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। সুতরাং এসব মেশিনের ব্যাপারে তাদের ধারণা রয়েছে, রয়েছে আগ্রহও। আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার, যন্ত্রপাতি নিয়ে আগ্রহ থাকলেও আগাম কোন ধারণা ছিল না। এখন যা দেখছি তার সবটুশুই বিস্ময়। বিজ্ঞান কোথায় গিয়ে ঠেকছে! একটি পোশাক বানাতে এত মেশিন লাগে! কত সহজেই না লাখ লাখ পোশাক তৈরি হয়ে যাচ্ছে। যার প্রায় পুরো কাজই করে ফেলছে মেশিন, যন্ত্র! প্রতিটি মেশিনের পেছনে একজন অপারেটর রয়েছেন। সুইচ অন করে অপারেটর বসে আছেন, কাজ চলছে। আবার কোন কোন অপারেটর কম্পিউটার মনিটরে চোখ রেখে চুপচাপ বসে আছেন। মেশিন কাপড় কাটছে, শার্ট প্যান্ট সেলাই করছে, সেগুলো আয়রন করছে, আবার মেশিনেই কাপড় ভাঁজ করছে। কী সাংঘাতিক! কী সাংঘাতিক!! আমার ঘোর কেবলই বাড়ছিল।

লায়ন বিজয় শেখর দাশ। চট্টগ্রামের একজন শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং লায়ন নেতা। তিনি আমার ক্লাবেরই সদস্য। বিজয়’দাও আমাদের সাথে একই ফ্লাইটে চীনে আসার কথা ছিল। কিন্তু কি এক ঝামেলা তৈরি হওয়ায় তিনি ফ্লাইট ক্যানসেল করেন। টিকেট পাল্টে নতুন করে টিকেট করেন। বিজয় দা আজ সকালে এসে সাংহাই হয়ে এখন আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি আমাদের সাথে এসে যুক্ত হয়েছেন। লায়ন ফজলে করিম ভাই পুরো ব্যাপারটি সুন্দর করে ম্যানেজ করলেন। লায়ন্স ক্লাবের সদস্য ছাড়াও বিজয় দার সাথে আমাদের সকলেরই চমৎকার সম্পর্ক, প্রিয় বন্ধু। দলছুট হয়ে যাওয়া বন্ধুকে দলে ফিরে পেয়ে আমরা ঠিক ভেড়ার মতো না হলেও কলকলিয়ে উঠলাম।

উৎসবমুখর পরিবেশে সময় কাটছিল আমাদের। ঘুরছি, ফিরছি, দেখছি। কিন্তু কোন কাজ নেই, নেই কোন চাপও। একে একে বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানা দেখলাম আমরা। কোনটি শার্ট কোনটি পলো শার্ট, কোনটি টি শার্ট, কোনটি নানা ধরনের আন্ডার গার্মেন্টস তৈরি করছে। এই ধরনের পোশাক আমাদের গার্মেন্টসে তৈরি হয়, বানানোর কাজও দেখেছি। কিন্তু আমাদের সাথে চীনের কারখানার পার্থক্য যেন অনেক। যন্ত্রপাতির ব্যবহার মনে হয় অনেক বেশি। আমাদের শ্রমিকদের বহু কাজই চীনে মেশিনে করে ফেলছে। এত এত্ত মেশিনের ব্যবহার মানুষকে ঠিক কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে কে জানে! আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অনেকেই ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। চীনের কারখানাগুলো পরিদর্শন করার পর আমিও যেন সেই উদ্বেগের আঁচ টের পাচ্ছিলাম। সত্যিই তো, এভাবে সব কাজই যদি মেশিন করে, একশ’ জন মানুষের একদিনের কাজ যদি একটিমাত্র মেশিন দশ মিনিটে করে ফেলে তাহলে মানুষ কী করবে! দিনে দিনে মানুষ কী পৃথিবীতে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে! দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ চীনে শ্রমের মূল্য অনেক। শ্রমিকের বেতন সাশ্রয় করতে প্রতিটি কারখানা অটোমেশন এবং যন্ত্রপাতির দিকে ঝুঁকেছে।

আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় সেলাই মেশিনসহ গার্মেন্টস মেশিনারিজ প্রস্তুতকারক জ্যাক কোম্পানির সদরদপ্তরে। জেজিয়াং প্রদেশের তাইজুতে বিশাল এলাকা জ্যাক কোম্পানির জুড়ে কারখানা এবং অফিস। এখানেও আমাদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করা হলো। কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা আমাদের স্বাগত জানালেন। কোম্পানির জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা এক নারী কর্মকর্তা দলে একজন সাংবাদিক থাকায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে বেশ খুশি হয়েছেন বলেও জানালেন। সাংবাদিকের প্রতি তরুণীর বাড়তি আগ্রহের কারণ না জানলেও মনে হলো তিনি আগে হয়তো সাংবাদিক ছিলেন। কারন জনসংযোগের কাজের সাথে সাংবাদিকতার যোগাযোগ বেশ নিবিড়। জীবনের শুরুতে সাংবাদিকতা করা বহু সাংবাদিকই পরবর্তীতে জনসংযোগ কর্মকর্তা বনে যান। কাজ করেন সরকারি বেসরকারি অফিসে, সংস্থায়।

জ্যাক কোম্পানির অফিস বিশাল। কারখানা আরো বিস্তৃত। কত ধরনের যন্ত্রপাতি যে তৈরি হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। পোশাক সেলাইর কাজ নিয়ে যে কত ধরনের গবেষণা! জ্যাক সব ধরনের মেশিনই তৈরি করে। গার্মেন্টস শিল্প রয়েছে এমন পৃথিবীর সব দেশেই জ্যাকের অফিস রয়েছে, রয়েছে ব্যবসা। বাংলাদেশেও জ্যাক ব্যবসা করে।

আমাদের সফরসঙ্গী ঢাকা চট্টগ্রামের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের মেশিনের কারিশমা দেখছিলেন। কোন কোনটির ব্যাপারে তারা খোঁজখবরও নিচ্ছিলেন। হয়তো কেনার কথাও ভাবছেন। বিভিন্ন ঝড়ঝাপ্টা মোকাবেলা করতে করতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরও বর্তমানে বেশ সমৃদ্ধ। নানা ধরনের ইকুইপমেন্ট কিংবা যন্ত্রপাতির সন্নিবেশ ঘটানোর সক্ষমতা দেশের বহু গার্মেন্টসেই রয়েছে। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, আমাদের সফরসঙ্গীদের কারো কারো গার্মেন্টসে জ্যাক কোম্পানির লেটেস্ট মেশিনগুলো হা পা ছড়াবে।

কত ধরনের মেশিন যে দেখলাম! কত কিছু যে শুনলাম!! আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, এই সফরটি না করলে কিংবা এভাবে পরিদর্শনের সুযোগ না পেলে গার্মেন্টস শিল্প সম্পর্কে অনেককিছুই আমার অজানা থেকে যেতো।

জ্যাক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা আমাদেরকে যেভাবে সময় দিলেন, আপ্যায়িত করলেন এক কথায় তা ছিল অসাধারণ। কত ধরনের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা যে আমাদের জন্য করা হলো তা উপস্থিত না থাকলে গল্প শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো।

দারুণ সময় কাটছিল আমাদের। টেকনাফের মানুষ ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ভাই কী পরিমাণ যে মানুষকে হাসাতে পারেন তা সফরসঙ্গী না হলে জানতে পারতাম না। অতি নিরীহ চেহারার ভদ্রলোক মানুষটি তলে তলে এত কথা বলতে পারেন তা বুঝতে বুঝতে পেটে খিল ধরে যায়।

জ্যাক কোম্পানির সদরদপ্তর থেকে বের হয়ে হোটেলের পথ ধরলাম আমরা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, গিয়ে লম্বা একটি ঘুম দেবো। আগের মতো ছুটছিল আমাদের বাহন। লায়ন বিজয় শেখর দাশ গাড়িতে নতুন অতিথি। তিনিও হাসাতে হাসাতে আমাদের অবস্থা কাহিল করে তুলছিলেন। লায়ন ফজলে করিম, শফিকুল ইসলাম এবং লায়ন আবদুল বারেকও মাঝে মধ্যে ফোঁড়ন কাটছিল। তাইজুর রাজপথ ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। জ্যাক কোম্পানির অফিস থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের হাতছানি। মাঝে মধ্যে কমলা রঙ ঝিলিক দিচ্ছে। যেন নীলাম্বরীতে সজ্জিত উর্বশীর শরীরে আলো আঁধারীর ঝলকানি, জ্যোৎন্সার মাখামাখি।

এগুলো কি? প্রশ্ন করতে লায়ন ফজলে করিম বললেন, কমলা বাগান। চীনের বেস্ট কমলা এই তাইজুতেই উৎপাদন হয়। শুধু শিল্পায়নে নয়, কৃষিতেও তাইজুর অনন্য ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে কমলা উৎপাদনে তাইজু চীনে অদ্বিতীয়। এখানকার কমলার মানও খুব ভালো বলে মন্তব্য করলেন আমাদের চীন বিশেষজ্ঞ লায়ন ফজলে করিম।

আমি ছবি তোলার জন্য কোন একটি বাগানের পাশে গাড়ি থামানোর জন্য অনুরোধ করলাম। লায়ন ফজলে করিম বললেন, ‘শুধু ছবি কেন, আমরা কমলা খাবো। তাইজুতে এসে কমলা না খেলে তো সবই মিস করলেন।’ অবশ্য তিনি সাথে সাথে এটুকুও বলে দিলেন যে, জ্যাক কোম্পানি রসে টুইটম্বুর যে কমলা খাইয়েছে সেগুলোও এই তাইজুর। আমি বললাম, গাছ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কমলা খাবো। সেটির ব্যবস্থা করুন।

লায়ন ফজলে করিম বললেন, কোন সমস্যা নেই। এখানে প্রতিটি বাগানেই কমলা বিক্রি হয়, গাছ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া যায় টাটকা কমলা। জ্যাক কোম্পানির বেজায় আতিথেয়তায় ভরপুর আমাদের পেট। কোন কিছু খাওয়ার ইচ্ছে আমাদের কারোরই ছিল না। কিন্তু গাছ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কমলা!! আমরা সবাই যেন একটু নড়চড়ে উঠলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবারতন্ত্রের ভুল ও দ্বীপ কন্যা শ্রীলংকার সর্বনাশ
পরবর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপে ৩ রোহিঙ্গা আটক