দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২০ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

উৎসবমুখর একটি আবহ গাড়িতে, আনন্দের ভাগাভাগি চলছিল। গল্পে আড্ডায় খুনসুটিতে ভরে আছে গাড়ি। সাত রাজ্যের সব আলোচনা চলছে গাড়ির ভিতরে, খাওয়া দাওয়াও চলছে ফাঁকে ফাঁকে। চিপস, বিস্কিট, বাদাম এবং কোল্ডড্রিংকসের অফুরন্ত যোগান। যত ইচ্ছে যেভাবে ইচ্ছে খেতে থাকুন। শর্ত একটিই শুধু আনন্দে থাকুন। কিন্তু বাবার কথা মনে পড়ায় এই একমাত্র শর্তটিই ভাঙ্গছিলাম আমি। আমার মনটি কেবলই ভিজে ভিজে যাচ্ছিল। নিদারুণভাবে মনে পড়ছিল আমার বালকবেলা, আমার শৈশবের কথা। মনে পড়ছিল বাবাকে, বাবার সাথে আমার প্রথম জীবনে কাটানো বর্ণিল সব স্মৃতি এলোমেলো ভাবে ভীড় করছিল মনে। আহারে বাবা! বাবার হাতে হাত রেখে কতই না গাড়িতে চড়েছি। চড়েছি কত বাহনে! এভাবে সবকিছুর পেছনে ছুটে চলার মাঝে যে আনন্দ ছিল তার কী তুলনা চলে!
আমাদের গাইড চীনা যুবক কি যেন বললেন দলপতি লায়ন ফজলে করিমকে। তিনি হঠাৎ বেশ সিরিয়াস হয়ে গেলেন। তিনি হাসি ঠাট্টা থামিয়ে আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করলেন। বললেন, অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা একটি গার্মেন্টস কারখানায় প্রবেশ করবো। ফ্যাক্টরী ভিজিটের অংশ হিসেবে আমরা কারখানাটি পরিদর্শন করবো। সব কাজকর্ম দেখবো। কিন্তু এই পরিদর্শনকালে আমাদের কোনকিছু যাতে কারো বিরক্তির কারণ না হই সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকার জন্য আহ্বান জানালেন তিনি। বললেন, এর সাথে শুধু আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যই নয়, দেশের ভাবমূর্তিও জড়িত।

অবশ্য এটি একটি সাধারণ বিষয়। বিদেশ গেলে আমাদের ঘরের একেবারে দুষ্টু বাচ্চাটিও সোজা হয়ে যায়। চকলেটের কাগজটিও যেখানে সেখানে ফেলে না। জুসের প্যাকেট কিংবা সিগারেটের শেষাংশ সবই হাতের মুঠোয় ধরে রাখে এবং বিন খুঁজে নির্দিষ্টস্থানে ফেলে। বাচ্চাদের পাশাপাশি তাদের মা বাবাও একদম ঠিকঠাক হয়ে উঠেন।

আমরা সোজা হয়ে বসলাম। গাড়ি থেকে নামার সুযোগটি আমাদের কাছে এই মুহুর্তের বাড়তি পাওনার মতো মনে হলো। অনেকক্ষণ গাড়িতে বসে আছি। চা খাওয়া হয়নি অনেকক্ষণ। গাড়ি থেকে নামলে আর কি হবে না হবে সেটা পরের ব্যাপার, চা কফির সংস্থান যে হবে সেটিই আমার কাছে মূল আকর্ষণ হয়ে উঠলো। তাছাড়া গার্মেন্টস কিংবা ইকুইপমেন্টের ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার লায়ন্স ক্লাবের নেতা লায়ন ফজলে করিম সুযোগ পেয়ে আমাকেও সাথে নিয়েছেন। এখন সবকিছু ঘুরে ফিরে দেখে দিনকয়েক আনন্দে থাকাটাই আমার লক্ষ্য। আর আমাকে আনন্দের ভাগ দেয়াটাই লায়ন ফজলে করিমের উদ্দেশ্য। এখানে কোন বাণিজ্য নেই, কোন সাংবাদিকতা নেই। অন্য কোন স্বার্থও নেই। লায়নিজমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘ফেলোশিপ’ই বাস্তবায়ন করছেন করিম ভাই কিংবা আমি। অবশ্য আমাদের সাথে ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ভাই, আরিফ মঈনুদ্দীন ভাই, চট্টগ্রামের শরিফ ভাই এবং আবদুল বারিক ভাই রয়েছেন। যাদের গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে বহু ধরনের ইকুইপমেন্ট ব্যবহৃত হয়। বহু শ্রমিক কাজ করেন। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে তাদের। গার্মেন্টস মেশিনারীজ উৎপাদনকারী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চীনা প্রতিষ্ঠান জ্যাক’র সাথেও তাদের বাণিজ্য চলে।

গাড়ি থামলো একটি গেটে। ভিতর থেকেই গেট খুলে দেয়া হলো। নেপালী টাইপের দুজন দারোয়ান গেট খুলে মাটিতে জুতা ঠুকে স্যালুট দিল। চীনের কারখানায় নেপালী দারোয়ান কেন? খটকা লাগলো। অবশ্য পরে করিম ভাই বললেন যে, হিমালয়ের পাদদেশের বহু জনপদের বাসিন্দাদের চেহারার সাথে নেপালীদের চেহারার দারুণ মিল রয়েছে। বিশাল দেশ, বিশাল জনগোষ্ঠী। নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড কিংবা মায়ানমার সব দেশের চেহারার মানুষই চীনে গিজগিজ করে। সুতরাং মানুষের চেহারা দেখে চীনা কিংবা নেপালী ঠাওরানোর কোন সুযোগ নেই। গাড়ি থেকে নামলাম। দারুণ ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানানো হলো আমাদের। প্রত্যেকের হাতেই তুলে দেয়া হলো চীনে উৎপাদিত বাহারী সব ফুল। ঘ্রান নেই, তবে রূপ চোখ ধাঁধানো। আমি মনে মনে চীনা ফুলের সুরতে মুগ্ধ হলাম। আমাদেরকে নিয়ে বসানো হলো কারখানার কনফারেন্স রুমে। মালিকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা আমাদের সাথে পরিচিত হলেন। আমরা চা খেলাম। চা মানে গ্রীণ টি। দুধ চিনি কিচ্ছু নেই। শুধু শুধু গরম পানিতে চা পাতা ডুবিয়ে চুকচুক করে খাওয়া। এই জিনিস দিয়েও যে মানুষ বিদেশী মেহমানকে আপ্যায়িত করতে পারে তা নিজের উপর দিয়ে না গেলে বুঝতে পারতাম না।

আমাদেরকে কারখানা দেখানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। কারখানা মানে গার্মেন্টস ফ্লোর। যেখানে কাজ করছে শত শত শ্রমিক। আমাদের মতোই, প্রায় সবাই নারী। টেবিলে টেবিলে মুখ গুঁজে কাজ করছে নারীরা। নানা বয়সী নারী শ্রমিক। অত্যাধুনিক সব মেশিন তারা অবলীলায় অপারেটর করছে। সেলাই মেশিন চালানো মেয়েদের কারো কারো কানে হেডফোন দেখলাম। তারা মনের আনন্দ নিয়ে গান শুনতে শুনতে মেশিন চালাচ্ছে।

একটি জিনিস খুবই চোখে পড়লো যে, কারখানা অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। মেশিনও ঠাসাঠাসি করে নয়, চমৎকার রো করে সুন্দরভাবে বসানো হয়েছে। প্রতিটি রো ধরে হাঁটার ব্যবস্থা। কাজের এক দারুণ পরিবেশ কারখানার ভিতরে বাহিরে। মেশিনে মেশিনে কাজ করা মেয়েগুলো বেশ স্মার্ট, চোখে মুখে সুখী সুখী ভাব। আমরা বিজ্ঞের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখতে লাগলাম। কিন্তু তাতে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা নিজেদের মতো করে মাথাগুঁজে কাজ করছিল। ভাবখানা এমন যে, ‘তোমাদের চেহারা দেখলে কী আমার ভাত হবে? রাতে যে বন্ধুকে নিয়ে স্যান্ডউইশ খেতে যাবো তার টাকাতো এখান থেকেই আয় করতে হবে।’ করিম ভাই জানালেন, চীনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরীর অনেকটা তাদের কাজের উপর নির্ভর করে। প্রোডাকশন বেইজড স্যালারি। যত কাজ তত টাকা। অবশ্য ফিক্সড স্যালারিও রয়েছে। চীনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি অনেক। এক একজন সাধারণ শ্রমিক বাংলাদেশী মুদ্রায় লাখ খানেক টাকা মজুরী পায়। দক্ষতার সাথে সাথে এদের বেতনও বাড়ে। আড়াই তিন লাখ টাকা বেতন ভাতা পাওয়া গার্মেন্টস শ্রমিক রয়েছে চীনের বড় বড় কারখানাগুলোতে। আমরা এমন বড় একটি কারখানা পরিদর্শন করছি। যেখানে সব মেশিনই যোগান দিয়েছে জ্যাকস। জ্যাকসের মেশিন ব্যবহার করে কারখানা কেমন চলে তা দেখাতেই মুলতঃ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের গার্মেন্টস মালিকদের কারখানাটি দেখানো হচ্ছে। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী না হয়েও ভাগ্যক্রমে আমারও এত বড় একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী দেখার সুযোগ হয়ে গেল।

আমি ঘুরে ঘুরে শ্রমিকদের কাজ দেখছিলাম। কী শৈল্পিকভাবেই না এক একটি শার্ট তৈরি হয়ে যাচ্ছে! কী অসাধারণ নৈপুণ্য! গার্মেন্টস সেক্টরে চীনে যে কী বিপ্লব ঘটে গেছে তা টের পাচ্ছিলাম আমি। শ্রমিকদের দক্ষতা এবং মেশিনারিজের উন্নতি চীনের গার্মেন্টস সেক্টরকে পৃথিবীর এক নম্বর স্থানে নিয়ে গেছে। শ্রমিক এবং মেশিনের দক্ষতা চোখে পড়ার মতো। চীনের লাখ লাখ মানুষ গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করে। এই কারখানাটিতেও সুখী সুখী চেহারার মানুষগুলো অত্যাধুনিক সব মেশিন দিয়ে পোশাক তৈরি করছিল। আগেই বলেছি যে, চীনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরী অনেক। শ্রমমূল্যের কারনে চীন থেকে বহু গার্মেন্টস সরিয়ে নিতে হচ্ছে। চড়া শ্রম মূল্য চীনের গার্মেন্টস সেক্টরের এক নম্বর সংকট বলেও উল্লেখ করলেন মালিকপক্ষ।

আমার মনে হলো চড়া মজুরীই শ্রমিকদের চেহারায় এমন সুখী সুখী ভাব নিয়ে এসেছে। এরা প্রচুর বেতন ভাতা পায়। বেতন বাড়ার সাথে সাথে এদের চেহারার চাকচিক্য বাড়ে, বাড়ে পোশাকের জৌলুশ। এতে করে চীনা গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকে আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে মিলানো যাবে না, যেমনটি যাবে না ওইদেশের অনেক কিছুর সাথে আমাদের বহুকিছুর।

তাদের বহু কিছুর সাথেই আমাদের কোন মিল নেই। মিল নেই তাদের মানুষের সাথে, মিল নেই তাদের শ্রমিকের সাথে। আমাদের সাথে মিল নেই তাদের রপ্তানি বাণিজ্য কিংবা অর্থনীতির সাথে। কিন্তু এখন দেখছি তাদের মেশিনারিজের সাথেও আমাদের মিল নেই। কত ধরনের মেশিন যে তারা গার্মেন্টসে ব্যবহার করছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে চীনের গার্মেন্টসে। একটি মেশিনই সব কাপড় ছোপড় কাঁটাকুটি করছে। সেলাই করছে। মেশিন চলছে নিজে নিজে। মেশিনের ভাঁজে ভাঁজে কাপড়ের নড়াচড়াও করছে মেশিনেই। মানুষের ব্যবহার প্রচন্ড কমিয়ে ফেলা হয়েছে। খরচ সাশ্রয় করে কিভাবে দশ বিশ জন মানুষের কাজ একটিমাত্র মেশিন দিয়ে করিয়ে ফেলা যায় সেই প্রযুক্তিতে চীন বহুদূর এগিয়ে গেছে। আমি হাঁ হয়ে বিভিন্ন মেশিনের ‘কেরামতি’ দেখছিলাম। কি করে সম্ভব! কি করে!!
এখানে বলে রাখা ভালো যে, চীনের গার্মেন্টস সেক্টরে মোটামুটি দুর্দিন চলছে। বহু বিনিয়োগ সরে গেছে ভিয়েতনাম কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশেও এসেছে। তবুও বিশ্বের এক নম্বর গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। দ্বিতীয় বাংলাদেশ। খুব সামান্য ব্যবধানেই তৃতীয় ভিয়েতনাম। এখানে মজার ব্যাপার হচ্ছে চীন ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে প্রথম আর বাংলাদেশ ৩০ বিলিয়ন ডলারের ধারেকাছে থেকে দ্বিতীয়। প্রথম এবং দ্বিতীয়ের আকাশ পাতাল ব্যবধানই বুঝিয়ে দেয় চীনের সাথে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের ব্যবধানটা ঠিক কতটুকু! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাজী জাহাঙ্গীরের গল্প : চলমান জীবনের চিত্র
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ