দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩০ মার্চ, ২০২২ at ১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ

(পূ্‌র্ব প্রকাশিতের পর)
আনন্দে ভর করে যেন উড়ছিলাম আমরা। আমাদের সময়গুলো যেন উড়ে উড়ে পার হয়ে যাচ্ছিল। মসৃন এবং চমৎকার একটি রাস্তা দিয়ে গাড়িতে চড়ে পথ চললেও মনে হচ্ছিল আসমানে উড়ছিলাম। রাত বাড়ছিল, গল্পে গল্পে পার হয়ে যাচ্ছিল সময়। আর কতদূর যেতে হবে কে জানে! অবশ্য দূরত্ব নিয়ে আমাদের কারোরই কোন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হচ্ছিল না। কতদূর যেতে হবে তা নিয়েও কারো মাঝে কোন উদ্বেগ দেখা গেল না। আমার সবার ভাবটা এমন যে, যে কোন একসময় গন্তব্যে পৌঁছলে হলো। এমন রাস্তায় শুধু এক রাত কেন, রাতের পর রাত গাড়িতে চড়া যায়, গাড়ি চালানো যায়।
আমাদের দলপতি লায়ন ফজলে করিম, ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ইউ আহমেদ ও আরিফ মঈনুদ্দীন এবং চট্টগ্রামের শরীফুল ইসলাম ও লায়ন আবদুল বারিকের গল্পের ভান্ডার যে এত সমৃদ্ধ তা আমার ধারণাতেই ছিল না। কত ধরনের গল্প এরা এক একজন করছিলেন। কত ধরনের কৌতুক, কত ধরনের অভিজ্ঞতায় যে টুইটুম্বর এদের এক একটি ঝুড়ি। নানাভাবে গল্প বলছিলেন তারা। সবাই সমস্বরে হাসছিলাম। আবার হাসির তাল লয় যে কতভাবে কত উচ্চতায় উঠতে পারে তারও নতুন মাত্রা দেখছিলাম। পুরো মাইক্রোবাসই আমাদের দখলে। চীনা ড্রাইভার এবং একজন চীনা গাইড থাকলেও তাদের দেখে খুব অসহায় লাগছিল। আমরা বাংলা ভাষায় নিজেদের মতো করে হাসি আনন্দে মেতে উঠেছিলাম, কিন্তু চীনা দুই নাগরিক একটি শব্দও বুঝতে পারছিলেন না। তারা কোন কিছু বলছিলেন না, তবে ক্ষণে ক্ষণে আমাদের হাসিতে তাদের ঠোঁটেও হাসির ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল।
বিশাল একটি চত্বরে পৌঁছলো আমাদের গাড়ি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের কুমিল্লা অঞ্চলের রেস্টুরেন্টগুলোর সামনের খোলা চত্বরের মতো। তবে পার্থক্য হচ্ছে কুমিল্লা অঞ্চলের রেস্টুরেন্টগুলোর ভবন স্বল্প উচ্চতার, এক দোতলা ভবন। আর এখানে আকাশছোঁয়া এক সুউচ্চ ভবন। ওই ভবনকে ঘিরেই চমৎকার খোলা চত্বর। পার্কিংও বলা যায়। চত্বরের পেছনের দিক দেখা যাচ্ছিল না। তবে সামনের দিকে রাস্তার পাশে সীমানা দেয়ালের কাজ সারা হয়েছে চমৎকার কিছু গাছ দিয়ে। কয়েকশ’ গাছ দিয়ে তৈরি একটি সারি, যেন গাছের বেড়া। কি গাছ, গাছের পাতা কেমন, কোন ফল আছে কিনা ইত্যাদি বুঝা না গেলেও মাঝারী আকৃতির গাছগুলো সত্যিই সুন্দর। গাইড আমাদের দলপতি করিম ভাইকে চীনা ভাষায় জানালেন, এটিই আমাদের হোটেল। করিম ভাই চীনা ভাষার তাৎক্ষনিক অনুবাদ করে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন।
এতক্ষণ আনন্দে ভাসলেও হোটেলে পৌঁছার পর নতুন একটি আনন্দ টের পেলাম। প্রচুর জার্ণি হয়েছে। এখন বিছানায় গা এলাতে পারলে মন্দ লাগবে না। তাই হোটেলে পৌঁছার মাঝেও আমি কিছুটা বাড়তি সুখ অনুভব করলাম।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে মনে হলো, হোটেলটি দারুণ। পাঁচতারকার ব্যাপারটির চেয়ে চারদিকের পরিবেশটি মূখ্য হয়ে উঠলো। দুনিয়াতে বহু পাঁচতারকা হোটেল রয়েছে, কিন্তু সব পাঁচতারকা হোটেলের পরিবেশ এত সুন্দর বলে আমার মনে হয় না। এত নিরিবিলিতেও হোটেল!
সাংহাই এবং জেঝিয়াং প্রদেশের মাঝামাঝি জিয়াঝিং সিটির চমৎকার একটি লোকেশনে নতুন গড়ে তোলা একটি হোটেল। চারদিকে চকচকে তকতকে। লবিতে গিয়ে মন জুড়িয়ে গেল। প্রচুর ফুল দিয়ে রাখা হয়েছে। সোফার পাশে কর্ণার এবং সেন্টার টেবিলেও ফুল। ফুল রিসিপশনের ডেক্সে। চীনাদের এত ফুল প্রীতি আগে খেয়াল করিনি। বাহারী সব ফুলের এমন সমাহার মন ভালো করে দেয়। রিসিপশন ডেঙ বেশ সুন্দর, প্রশস্থ। পাঁচজন তরুণী বসে আছেন, পেছনে দেয়ালে বিশাল এক ড্রাগন। থাইল্যান্ডে প্রচুর ড্রাগনের ব্যবহার দেখেছি, চীনেও আছে। এই ড্রাগন চীনা সংস্কৃতিতে বেশ বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বলে মনে হলো। আমরা চেকইন করতে পাসপোর্ট দিলাম। রিসিপশনের এক তরুণী কম্পিউটারের কী টিপে আমাদের চেকইন করার ফর্মালিটি সারছিলেন। তিনি পাসপোর্ট ফটোকপি করে সংরক্ষণ করলেন এবং আমাদের কাছ থেকে কাগজে সাইন নিচ্ছিলেন। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি হোটেলেই এভাবে চেকইন করতে হয়। রিসিপশনের তরুণী বেশ সতর্কভাবে ফরম পূরণ করছিলেন। তাঁকে একটু বাড়তি সতর্ক বলেও মনে হলো। চোখের কাছে নিয়ে আমাদের পাসপোর্টগুলো ভালো করে দেখছিলেন। তার কী এই পাসপোর্ট নিয়ে সন্দেহ আছে? বুঝতে পারছিলাম না। তিনি আমাদের ভিসার পেজও বেশ সতর্কতার সাথে পরখ করলেন। তিনি কী বাংলাদেশী পাসপোর্ট বলে এমনটি করছেন, নাকি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার যেমন প্রতিটি টাকার বান্ডেলে জাল টাকা চেক করে তেমন করে ইনি সবার পাসপোর্টে জাল ভিসা চেক করেন কিনা কে জানে!
মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলাম। এত কিছু দেখার কি দরকার বাবা! তোমার দেশের ইমিগ্রেশন কি কিছু না দেখেই এই পাসপোর্টকে দেশে ঢুকতে দিয়েছে! তরুণী নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পাসপোর্টের ফটোকপি করে আনছিলেন। আশ্চর্য লাগলো তিনি আমাদের সবকটি পাসপোর্ট একই সাথে ফটোকপি না করে একটি পূরণ করার পর একটি নিয়ে চেয়ার ছাড়ছিলেন। কবে যে তরুণী চাবি দেবেন কে জানে! এ যেনো তার মনের ঘরের চাবি দেয়ার প্রক্রিয়া!! আহারে অপেক্ষা, কী যন্ত্রণার প্রতীক্ষা!
কারো মনের ঘরের চাবি নয়, হোটেল রুমের চাবির জন্য এমন প্রতীক্ষা সত্যিই বিরক্তিকর। কিন্তু উপায় নেই। তিনি তার নিজের মতো করে কাজ করছেন। ডেঙের অন্যান্য তরুণীরাও নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আমরা ডেঙের সামনে দাঁড়িয়ে চ্যাপ্টা নাকের সুন্দরীদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করারও ছিল না। দারুণ একটি ট্রে হাতে এক তরুণী এগিয়ে আসছিলেন আমাদের দিকে। এ যেন একেবারে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! ট্রে ভর্তি রঙিন পানীয়। রঙিন পানীয়? রঙ দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত এবং খানিকটা বিব্রত হচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস সার্ভ করা হচ্ছে। কিন্তু ওয়েলকাম ড্রিংকসে মদ সার্ভ করতে তো কোথাও দেখিনি। অবশ্য চীনে মদ বেশ সস্তা একটি পানীয়, কোন কোন ক্ষেত্রে নাকি পানির চেয়ে পানীয় সস্তা! চীনা মদের জয়জয়কার বিশ্বের নানা দেশে। আমাদের চট্টগ্রামেও চীনের সস্তা মদের বেশ বড় বাজার রয়েছে। তাই চীনের হোটেলে বিদেশী গেস্টকে চীনা মদে ওয়েলকাম জানানো হয় কিনা বুঝতে পারছিলাম না। চমৎকার ডিজাইনের গ্লাসভর্তি রঙিন পানীয় দেখে আমি কিছুটা সরে গেলাম। বিষয়টি খেয়াল করলেন লায়ন ফজলে করিম ভাই। তরুণীর ট্রে থেকে একটি গ্লাস তুলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ভাই নেন। নরম্যাল জুস। অন্য কিছু মাগনায় পাওয়ার কোন সুযোগ চীনে নেই। কড়ি দিয়ে কিনতে হয়।’ আমি একটি গ্লাস তুলে নিলাম। খুবই সাধারণ মানের একটি ওয়েলকাম ড্রিংকস। পুদিনা, জিরা কিংবা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি। সাথে কিছুটা টকও ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়া হয়েছে বরফকুচি। চুমুকে চুমুকে পুরো গ্লাস উজাড় করে দিলাম। অচেনা রঙের চেনা স্বাদের পানীয়টি বেশ মজাদার হয়ে উঠেছিল। কোমল পানীয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। এনার্জী ড্রিংকসের মতো কোন কিছু মিশানো হয়েছে কিনা কে জানে! চীনা বুদ্ধির কত কিছু যে দেখতে শুরু করেছি!
আমাদের রুমের চাবি দেয়া হলো। প্রত্যেকের হাতে চাবি তুলে দিয়ে তরুণী সুন্দর করে হাসিও দিচ্ছিল। যেন কতকিছু তিনি দিয়ে দিলেন! আমরা লাগেজ নিচে রেখে রুমে চলে আসলাম। আমাদের সকলকে একই ফ্লোরে রুম দেয়া হয়েছে। এখন আর তরুণীকে অতটা খারাপ লাগছে না। সবাইকে একই ফ্লোরে রুম না দিলেও কিছু করার ছিল না। পাশাপাশি রুম দেয়ায় আমরা রাতভর ছুটিয়ে আড্ডা মারতে পারবো, গল্প করতে পারবো। বিদেশে আড্ডার মজাটা একেবারেই অন্যরকম। এই আড্ডার সাথে পাড়ার মোড়ে কিংবা ক্লাবের আড্ডার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই আড্ডার আবহ অন্যরকম, আমেজও ভিন্ন।
রুমে ঢুকে মনটি একেবারে ভিজে গেল। কী সুন্দর রুম! বিছানাটি যে কী অসাধারণ দক্ষতায় পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে! বিছানার উপর ফুল, রঙিন তোয়ালে দিয়ে বিশাল একটি ‘হার্ট’ সাইন বানিয়ে রাখা হয়েছে। ‘লাভ’ সাইনের পাশে রাখা হয়েছে ফুল। শুধু বিছানায় নয়, টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বর্ণিল ফুল, চীনা মাটির ফুলদানিতে। আমার মনে হলো, রিসিপশন ডেঙের তরুণী শুধু শুধু সময়ক্ষেপন করেননি, আমাদের রুমগুলোকে মনছোঁয়া সাজ দিতেই তিনি অন্যদের সময় দিয়েছেন। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাহ্‌সূফী মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রাহ.) স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধঅস্থির বিশ্ব : লোকের প্রাণ যেখানে মূল্যহীন