দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:০০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাংহাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক টার্মিনালে লাগেজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নিজেদের মধ্যে টুকটাক গল্পও চলছিল আমাদের। তবে আমি ব্যস্ত ছিলাম মোবাইলে। সাংহাই বিমানবন্দর দর্শনের পরই অঞ্চলটির নানা বিষয়ে কৌতূহলি হয়ে উঠছিলাম। এতে করে অপেক্ষায় সময় নষ্ট না করে আমি নেটে ঢুকে প্রাথমিক কিছু তথ্য উপাত্ত পড়ে নিচ্ছিলাম। এক একটি তথ্যে বিস্মিত হচ্ছিলাম, পিলে চমকে যাওয়ার ব্যাপারটি আক্ষরিক অর্থে টের পাচ্ছিলাম। সাংহাই সম্পর্কে এক একটি তথ্য আমার দীর্ঘদিনের লালিত ভাবনায় কুঠারাঘাত করছিল। ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল আমার বহু দিনের নানা ধারণা, বিশ্বাস। কত কিছু যে জানতে পারছিলাম, কত কিছু যে ভাবতে হচ্ছিল আমাকে, কত কিছু যে ভাবছিলাম। আহা, আমার মাথা কী ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে! নাকি ঘুরছে আমার ভাবনা!!
বেল্টে আমাদের ফ্লাইটের লাগেজ দেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে লাগেজ দেয়ার ব্যাপারটি দেখানো হচ্ছে। মোবাইল বন্ধ করে আমি লাগেজের ব্যাপারে মনোযোগী হলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে আমার লাগেজের দেখা পেলাম। একে একে আমাদের সকলের লাগেজই পাওয়া গেল। বিদেশী বিমানবন্দরে লাগেজ বেল্টে দাঁড়িয়ে ঠিকঠাকভাবে লাগেজ পাওয়া যে কী শান্তি! নিজেদের লাগেজ ট্রলিতে তুলে সামনে পা বাড়ালাম। আধুনিক ট্রলি, আধুনিক সব আয়োজন। এতগুলো লাগেজ চাপানোর পরও ট্রলিতে চলছিল আঙ্গুলের ছোঁয়ায়, যেন আলতো ছোঁয়ায় খিলখিল করে উঠছিল।
বিমানবন্দর টার্মিনালের গেটে ‘ফজলে করিম’ নাম লিখা প্লেকার্ড উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। সেলাই মেশিন প্রস্তুতকারী জ্যাক কোম্পানির লোগো সম্বলিত প্লেকার্ড যুবকের হাতে। যুবকের ব্লেজারের উপরও জ্যাকের লোগো। বুঝতে বাকি থাকলো না তিনি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন। হাতে বেশ চমৎকার একটি ফুলের তোড়া। দারুণ সব ফুল। সাদা, লাল এবং গোলাপী রঙের নানা ফুলের দারুণ কম্বিনেশন। ফুলের তোড়াটির দিকে তাকাতেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল, ইচ্ছে করছিল আলতো করে নাকের কাছে নিয়ে শুকতে। এত সুন্দর ফুল!
আমার মনে পড়লো যে, ফুলের জন্য চীন ইতোমধ্যে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। আরো অনেক কিছুর মতো বিশ্বের ফুলবাজারেরও একটি বড় অংশ চীন দখল করে নিয়েছে। কৃষিপ্রধান দেশ, শস্য শ্যামলা আমার সোনার বাংলার ফুলের দোকানগুলোর অধিকাংশই প্রতিদিন সজ্জিত হয় চীনা ফুলে! আহারে বাংলা, আমার সোনার বাংলা! লায়ন ফজলে করিম যুবকের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। যুবকটি একেবার বাঁকা হয়ে মাথা নুইয়ে স্বাগত জানিয়ে লোভনীয় ফুলের তোড়াটি তার হাতে তুলে দিলেন। আমাদের সবাইকেও স্বাগত জানিয়ে ইংরেজীতে বললেন, এখানে গাড়ি আনা যায় না। তাই কষ্ট করে হেঁটে পার্কিং এরিয়াতে যেতে হবে। তিনি আমাদের লাগেজ নিয়েও টানাটানি করলেন। আমরা কেউই তাকে লাগেজ না দিয়ে নিজের ট্রলি নিজেই ঠেলার প্রস্তুতি নিলাম। আমাদের মেজাজ বেশ ফুরফুরে। সাংহাই বিমানবন্দরের বাইরে অভ্যর্থনা পেয়ে মনমেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। আমাদের কোন কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হবে না, কোন বিষয় নিয়ে টেনশন করতে হবে না। আমাদের রিসিভ করার জন্য লোক রয়েছে, রয়েছে গাড়ি। বিদেশের অচেনা মাটিতে এর থেকে বেশি কিছুর দরকারও হয়না। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছিল। আমাদের মনের ভিতরের উচ্ছ্বাস প্রকৃতির বাতাসে উড়ে উড়ে অন্যরকমের এক আবহ তৈরি করছিল। বেশ খোশমেজাজে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।
কিছুদূর হাঁটার পর মনের ভিতরে চিনচিন একটি ব্যাথা যেন টের পেলাম! আর কতদূর হাঁটতে হবে! যত বড় বিমানবন্দর দেখলাম তাতে পার্কিং এরিয়া যে কতদূর কে জানে! চীনারা প্রচুর হাঁটে, শুধু হাঁটে না, দৌঁড়ায়ও। তাদের মতো দৌঁড়ানো বা হাঁটা কোনটিই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হাঁটার সময় আমার শরীরই আমার পথ আগলে দেয়, বিশাল শরীর নিয়ে হাঁটতে নেমে অল্পতেই আমি হাঁফিয়ে উঠি। পার্কিং এরিয়া দূরে হলে আমি ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবো। তবুও বিষয়টি সহযাত্রীদের কাউকে বুঝতে না দিয়ে পা চালাচ্ছিলাম।
ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। বেশি দূর পর্যন্ত হাঁটতে হলো না। পার্কিং এরিয়া পাওয়া গেল এবং আমাদের জন্য দারুণ একটি মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছিল। চালকও বেশ সুদর্শন, টগবগে যুবক। তিনিও কোমর বাঁকা করে মাথা নুইয়ে আমাদের স্বাগত জানিয়ে লাগেজগুলো গাড়িতে বোঝাই করতে শুরু করলেন। আমরাও হাত লাগালাম। বিদেশে কোন গাড়িরই কোন সহকারী থাকে না। চালক একাই সবই করেন। যাত্রীরা নিজের লাগেজ নিজে টেনে চালককে সহায়তা করেন। এটুকু করতে হয়, সবাই করে। তাই আমরাও হাতে হাত লাগিয়ে আমাদের প্রত্যেকের লাগেজ গাড়িতে বোঝাই করার ব্যবস্থা করলাম।
কিন্তু চকচকে গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আমি কিছুটা হোঁচট খেলাম। টয়োটা কোম্পানির মাইক্রোবাস! চীনের রাস্তায় জাপানী গাড়ি!! বিশ্বের কারখানা খ্যাত চীন কী নিজেদের জন্য গাড়ি বানায় না? আমি পার্কিং এরিয়ায় চোখ বুললাম। কয়েকশ’ গাড়ি সেখানে। সবগুলো সারি সারি পার্কিং করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি গাড়িই চকচক করছে। তবে গাড়িগুলোর অধিকাংশই জাপানী। ব্রিটিশ এবং জার্মানীর গাড়িও দেখা গেল। এক দুইটি নয়, অগুনতি জাপানী গাড়ি দেখে আমি লায়ন ফজলে করিমের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলাম। কি রে ভাই, চীনের পার্কিং এ এত জাপানী গাড়ি কেন! দুই দেশের সম্পর্কতো সতিনের মতো। করিম ভাই হাসলেন, বললেন- ব্যাপারটি তেমন নয়। গাড়িগুলো জাপানী কোম্পানির, কিন্তু প্রস্তুত হচ্ছে চীনে। শুধু জাপানেরই নয়, বিশ্বের সব খ্যাতনামা গাড়ি কোম্পানিরই চীনে কারখানা রয়েছে। চীনের কারখানায় মার্সিডিস, বিএমডব্লিউটি, অডি, টয়োটাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গাড়ি তৈরি হচ্ছে। দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের গণচীনের বিশাল বাজারে এসব গাড়ির বেশ কদর বলেও জানালেন লায়ন ফজলে করিম। তিনি বললেন, চীনেরও গাড়ি রয়েছে। তবে সেগুলো খুব বেশি বাজার পায়নি। এগুলোর দাম বেশ সস্তা বলেও আমাদের চীন বিশেষজ্ঞ ফজলে করিম উল্লেখ করেন।
বিমানবন্দর থেকে সাংহাই শহরের দিকে ছুটছিল আমাদের মাইক্রোবাস। দারুণ গতিতে ছুটছে। এমন চমৎকার রাস্তায় এমন গতি না হলে কী মানায়!! বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিমানবন্দর থেকে মুল শহর বেশ দূরে। বিমান ওঠানামা নিরাপদ রাখতে শহরের ভিতরে কখনো এয়ারপোর্ট তৈরি করা হয় না, সম্ভবও না। আর প্রতিটি দেশেই বিমানবন্দর থেকে মুল শহর পর্যন্ত রাস্তাটিকে চকচকে ঝকঝকে এবং তকতকে রাখা হয়। যে কোন দেশই বিমানবন্দর সড়ককে ‘আয়না’ হিসেবে বিবেচনা করে। এতে করে সব দেশই তাদের বিমানবন্দর সড়কটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একেবারে বাসরঘরের বউয়ের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে! দুর্ভাগ্য শুধু আমাদের শহরের। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মুল শহরে আসার রাস্তাটির মতো বেহাল অবস্থা পৃথিবীর আর কোন দেশের ‘আয়না’য় আছে কিনা কে জানে!
ছুটছিল আমাদের গাড়ি। সাংহাই শহর ক্রমান্বয়ে কাছে আসছিল। কী অপরূপ এক শহর! কী অপরূপ চাকচিক্য! চারদিকের চোখধাঁধানো সব ভবন এবং জৌলুশ দেখে আমার নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিল। আহারে সাংহাই! আহারে আমার স্বদেশ, আমার শহর! কি করে এতদিন চট্টগ্রামকে সাংহাইর আদলে গড়ে তোলার কথা পত্রিকায় লিখতাম কে জানে! শুধু সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের মতো একটি বিমানবন্দর করতেই আমাদের আরো কয়েকশ’ বছর লেগে যাবে! শুধু একটি নয়, সাংহাইতে দুই দুইটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিনে রাতে অজস্ত্র বোয়িং এয়ারবাস নাকি কানামাছি খেলার মতো ওঠানামা করে! চোখ পড়লো রাস্তায়, নখের পিঠের মতো রাস্তা, সুবিশাল। আট লেইন, নাকি দশ লেইন! রাস্তা জুড়ে কিলবিল করছে অগুনতি গাড়ি, নিজের লেনে তীব্র বেগে ছুটছে! এমন একটি রাস্তা কবে যে আমার শহরে হবে? কবে হবে রাস্তার দুপাশের এমন সব নান্দনিকতা, কবে আমাদের ভবনগুলোও এভাবে আকাশ ফুটো করতে চাইবে! কবে আমার অভাগা শহর এমন একটি সোনার শহরে পরিণত হবে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাহস ও সততার মূর্ত প্রতীক সিরাজুল হক মিয়া
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ