দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে হাঁটছিলাম আমি। ওয়ানটাইম কাপ, কাগজের। বোর্ডের মতো মোটা কাগজের কাপগুলো আমাদের সিরামিকের কাপের মতোই শক্ত। তাই কাগজের তৈরি আমাদের ওয়ানটাইম কাপগুলো আলতো ছোঁয়ায় লজ্জাবতির মতো যেমন দুমড়ে মুছড়ে যায় এগুলো তেমনটি হয়না। আরামে চুমুক দেয়া যায়। বেশ শক্ত একটি ঢাকনায় আচ্ছাদিত থাকে বিধায় এই কাপ হাতে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটাও যায়, গাড়িতে চড়া যায়, ছিঁটকে গায়ে পড়ে না। আমি আলতো আলতো চুমুক দিচ্ছি, আর আয়েশ করে হাঁটছি। চারদিকের আবহ এত চমৎকার যে কফির স্বাধই অন্যরকম হয়ে উঠছিল। আমাকে দেখলে কারোরই বুঝার কোন উপায় নেই যে আমার ভিতরে বিন্দুমাত্র চিন্তা কাজ করছে। আমি যে ভিনদেশে এসে সহযাত্রীদের হারিয়ে ফেলেছি, কিংবা নিজে পথ হারিয়ে একা একা ঘুরছি তা আমার এই আয়েশি ভাব দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমি বেশ নির্ভার, চলনে ঢলনে চিন্তামুক্ত, কফিতে চুমুক দেয়ার ক্ষেত্রে বেশি রোমান্টিক!
বিশাল বিমানবন্দর। বিশাল মানে বিশাল। চারদিকে যতটুকু চোখ যাচ্ছিল তার পুরোটাই মনে হচ্ছিল বিমানবন্দর। পায়ে হাঁটার দীর্ঘ পথ, কখনোবা চলন্ত সিঁড়ি। আবার কোন কোন পয়েন্টে এসে মিলেছে সিঁড়ি, উপরের তলায় যাওয়ার পথ। দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন। নজরকাড়া সব মডেল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পণ্যের বিজ্ঞাপন। নারী স্বাধীনতার দারুণ উদাহারণ হয়ে উঠা চীনেও নারীদের পণ্য বানাতে পিছপা হয়নি। রকমারি পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছে সুন্দরী নারী মুখ! চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা আয়োজন দেখতে দেখতে পথ চলছিলাম আমি। চীনের গুয়াংজু বায়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থেকে ডোমেস্টিক টার্মিনালের পথে চলছে আমার পথচলা। শুরুতে কিছুটা চিন্তিত থাকলেও ডোমেস্টিক টার্মিনালের পথ পেয়ে যাওয়ায় সব শংকা উবে গেছে। নিজেকে কিংবা সহযাত্রীদের হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটি আমাকে আর বিচলিত করছিল না। আমার মনে হচ্ছিল তারা ডোমেস্টিক টার্মিনালে চলে যাবেন। সাংহাইর ফ্লাইট যে গেট থেকে উড়বে সেই গেটেই ওনারা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। লায়ন ফজলে করিম লিটনের সাথে আমার সম্পর্ক বহুদিনের। লায়নিজমের বাইরেও উনার সাথে দারুণ একটি সম্পর্ক রয়েছে আমার। পরপর দুই টার্ম ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আমি, আর সেক্রেটারি তিনি। একই সাথে দীর্ঘদিন পথে ঘাটে নানাভাবে কাজ করতে গিয়ে আমার সম্পর্কে বেশ স্বচ্ছ একটি ধারণা রয়েছে উনার। এক্ষেত্রে আমার বিদেশ ভ্রমণের টুকটাক অভিজ্ঞতা উনাকে কিছুটা নিশ্চিন্তে রাখবে। বাকিটা সময়ই বলে দেবে।
একেবারে আচমকা কেউ একজন জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। সাথে অনেকটা চিৎকার- ‘আকবর ভাই আপনি কোথায় হারিয়ে গেছেন?’ নিজেকে সামলানোর পাশাপাশি কফিও সামলাতে হলো আমাকে। ফিরে দেখি করিম ভাই। পেছন থেকে তিনি এসে জড়িয়ে ধরেছেন আমাকে। আমাকে হারিয়ে উনারা সবাই নাকি খুবই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, রেখে যাবেন নাকি খুঁজতে থাকবেন তা নাকি বুঝতে পারছিলেন না। আমি মুখে কিছু না বলে শুধু হেসে উনার প্রতিটি কথারই নির্বাক জবাব দিচ্ছিলাম। অবশ্য সহযাত্রীদের সবাইকে একই সাথে দেখতে পেয়ে আমি অনেক বেশি নির্ভার হয়ে উঠলাম। করিম ভাই একেবারে আমার গা ঘেঁসে চলতে লাগলেন, আস্তে আস্তে! যদি আবারো হারিয়ে যাই!!
নানাপথ মাড়িয়ে সামনে যাচ্ছিলাম আমরা। আলো আঁধারীর পথও রয়েছে। পুরো পথটি লায়ন ফজলে করিমের নখদর্পনে। সুতরাং আমাদের বিশেষ কোন চিন্তা করতে হচ্ছিল না। সাংহাইর ফ্লাইট উড়বে আরো ঘন্টা দুয়েক পরে। সুতরাং হুড়োহুড়ি না করে আমরা রয়ে সয়ে চেক ইন করতে চায়না সাউদার্ণ এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে গেলাম। চায়না সাউদার্নের কাউন্টারে গিয়ে বেশ বড়সড় একটি লাইনের সামনে পড়ে গেলাম। বিশাল লাইন। কয়েকশ’ মানুষ চেক ইন করছে। তারা কী একই সাথে কয়েকটি ফ্লাইটের চেকইন করছে নাকি শুধু সাংহাইর ফ্লাইট? খবর নিতে গিয়ে জানলাম যে, আমাদের সামনের সব মানুষই সাংহাইর প্যাসেঞ্জার। বড় একটি বোয়িং আমাদের নিয়ে সাংহাইর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। ডোমেস্টিক ফ্লাইট, কিন্তু বিশাল লাইনই আমাদের বলে দিচ্ছিল যে এটি ব্যস্ত রুট। গুয়াংজু-সাংহাই চাট্টিখানি রুট নয়, হাজার হাজার যাত্রী এই রুটে যাতায়ত করেন।
চীনের বেশ কয়েকটি ফ্লাইট অপারেটর রয়েছে। এরমধ্যে চায়না সাউদার্ন বেশ বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ। এটি চীনের তৃতীয় বৃহত্তম ফ্লাইট অপারেটর। যাত্রী পরিবহনের দিক দিয়ে এটি এশিয়ার বৃহত্তম ফ্লাইট অপারেটর। গুয়াংজুতে এই কোম্পানির সদরদপ্তর। চীনের অভ্যন্তরীন শতাধিকসহ পৃথিবীর প্রায় ২০০টি গন্তব্যে প্রতিদিন চায়না সাউদার্ন দুই হাজারেরও বেশি ফ্লাইট অপারেটর করে। প্রতিদিন দুই হাজার ফ্লাইট! আঁৎকে উঠার জন্য আর বিশেষ কোন তথ্যের প্রয়োজন আছে! এটি বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম ফ্লাইট অপারেটর হিসেবেও ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৮৮ সাল থেকে এই অপারেটর নিরবিচ্ছিন্নভাবে অভ্যন্তরীন এবং আন্তর্জাতিক নানা গন্তব্যে ফ্লাইট অপারেট করছে।
চীনের অনেকগুলো রুট খুবই ব্যস্ত। এরমধ্যে গুয়াংজু-সাংহাই রুট একটি। চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্স প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই রুটে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট অপারেট করে। গুয়াংজু থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ সাংহাই যান, সাংহাই থেকেও ফিরেন অগুনতি মানুষ।
আমাদের সামনে লাইনে দাঁড়ানো কয়েকশ’ নারী পুরুষও সাংহাই যাচ্ছেন, আমাদের সাথে একই ফ্লাইটে। আমাদের বাদ দিয়ে এই ফ্লাইট যাবে না, তাই হুড়োহুড়ির কিছু নেই। হাতেও সময় আছে। তবে কতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবো! পিঁপড়ার মতো লাইনে টুকটুক করে এগুতে আমার সচরাচর ভালো লাগে না। দ্রুত সব শেষ করতে ভালো লাগে আমার।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রুপের সদস্য হিসেবে টুকটাক বিদেশ ভ্রমন করেছি। এতে বিদেশ ভ্রমনের নানাকিছু কাজ থেকে দেখা এবং শেখা হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে এয়ারপোর্টে গ্রুপ চেকইন। অনেকটা ভিআইপি টাইপের এই চেকইন সিস্টেমে লাইন ধরার ঝামেলা থাকে না। কয়েকজন একসাথে থাকলে আসনগুলো মনের মতো নেয়া যায়। চেকইন কাউন্টারে কিছুটা বাড়তি মর্যাদাও। অবশ্য গ্রুপ চেকইন করার ক্ষেত্রে প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা জনা দশেক হলে ভালো। এর থেকে কম হলে ঠিকভাবে ইজ্জত পাওয়া যায়না।
চীন সফরে এই দলে আপাতত আমরা ছয়জন। এত ছোট গ্রুপকে গ্রুপ চেকইন সুবিধা দেয়ার কথা নয়, তবুও চেষ্টা করতে দোষ কি!
দলের সবাইকে লাইনে রেখে আমি আসছি বলে বেরিয়ে গেলাম। চ্যাপ্টা নাকের দারুণ স্মার্ট এক তরুণী চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে বেশ তৎপরতা চালাচ্ছিলেন। নানা বিষয় দেখছিলেন তিনি। আমি তার কাছে গিয়ে ‘হাই’ বলে হাত বাড়ালাম। তরুণীও হাত বাড়ালেন। বেশ বিনীতভাবে হ্যান্ডশেক করলেন তিনি। নিজেদের পরিচয় দিয়ে রাতভর উড়ে সুদূর বাংলাদেশ থেকে গুয়াংজু আসা এবং আবার সাংহাইর পথে উড়াল দেয়ার কষ্টকর জার্ণির কথা শুনালাম। লম্বা লাইনের পেছনে পড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে আলাদা করে একটু গ্রুপ চেকইন করে দেয়ার অনুরোধ করলাম তরুণীকে। তিনি সায় দিলেন। আমার কাছে সকলের পাসপোর্ট চাইলেন। আমি ‘এক মিনিট’ বলে লাইনের পেছনের দিক থেকে দলের সবাইকে নিয়ে তরুণীর কাছে চলে গেলাম। তিনি আলাদা একটি ডেস্কে নিয়ে গিয়ে আমাদের চেকইন করে দিলেন। লাগেজ দিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে একেবারে নির্ভার হয়ে উঠলাম আমরা। কেবিন ব্যাগটি লাগেজ কেরিয়ারে নিয়ে সামনে পা বাড়ালাম।
লায়ন ফজলে করিম লিটনের নেতৃত্বে লায়ন আবদুল বারেক, ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম, ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ইউ আহমেদ এবং আরিফ মঈনুদ্দীনসহ ছয়জনের দলটি ধীরলয়ে সামনে এগুচ্ছিলাম। সামনে নিরাপত্তা তল্লাশীর নানা ঝুটঝামেলা রয়েছে। এগুলো শেষ করতে হবে। করিম ভাই আমাদেরকে হাল্কা নাস্তা করার পরামর্শ দিয়ে বললেন, ফ্লাইটের দেরি আছে, চলুন কিছু খেয়ে নিই। আমরা নিরাপত্তা তল্লাশী শেষ করে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালাম।
আমাদের দলপতি করিম ভাই চীন বিশেষজ্ঞ। এখানকার খাওয়া দাওয়া সম্পর্কেও উনি অভিজ্ঞ। চীনা ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন। এমন একজন বিশেষজ্ঞ সাথে থাকায় আমরা সকলেই চিন্তামুক্ত ছিলাম। কোন কিছু নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। রেস্টুরেন্টে ঢুকে উনি টেবিল পছন্দ করলেন, আমরা বসলাম। তিনিই খাবারের অর্ডার করলেন। কিসের অর্ডার করলেন তা আমরা বুঝতে পারলাম না, বুঝতে চাইলামও না। কিছুক্ষণ পর কি কি সব খাবার সার্ভ করা হলো। বেশ আগ্রহ নিয়ে হাত বাড়ালাম। চায়নিজ খাবার বলে কথা! কিন্তু মুখে দিয়ে কিছুটা ভড়কে গেলাম। কেমন যেন স্বাদ, কেমন যেন বিস্বাদ! আমি অত্যন্ত অসহায়ভাবে করিম ভাইর চোখে চোখ রাখলাম। (চলবে)। লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবহমান বাংলার শীতকাল ও ঐতিহ্যের পিঠা
পরবর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক নুরুল ইসলাম বিস্মৃত আওয়ামী লীগ নেতা