দুরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১০ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
উঠতে ইচ্ছে না করলেও উঠতে হলো। রবি ঠাকুরের গানের আসর থেকে উঠে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক সময় চাইলেও উঠা যায় না। রবীন্দ্র সংগীতের আসর থেকে উঠে যাওয়ার মতো পাষাণও আমি নই। রবি ঠাকুরের এক একটি গানের কথামালা এমন করে টেনে ধরে যে ইচ্ছে করলেও নড়াচড়া যায় না। ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাইনি!’ কী অসাধারণ সব কথা! কি অসাধারণ সব বক্তব্য! রবীন্দ্র প্রসঙ্গ উঠলেই আমি খুবই আশ্চর্য হই এবং প্রায়শ একটি কথা বলি যে, জগতের এমন কোন বিষয় নেই যা তিনি বলে যাননি, এমন কোন কথা নেই যা তিনি বলে দেননি। কী অপূর্ব ক্ষমতা! আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে উনার বলে যাওয়া কথাগুলো গত একশ’ বছর ধরে একই সুরে একই তালে এবং একই লয়ে রয়েছে। কোন কথাই পুরানো হচ্ছেনা, কোনটিই বাতিল হচ্ছেনা, সব সময়ের জন্যই তিনি আধুনিক, সব সময়ের জন্যই তিনি সর্বাধুনিক! আমরা যা বলতে চাই, যেমন করে বলতে চাই তিনি ঠিক তেমন করেই বলে দিয়েছেন। ঠিক যেমন করে বলা দরকার তেমন করেই বলেছেন। কি করে যে এত কথা এতভাবে বলা সম্ভব সেটা আমার মাথায় ঢুকে না, আমি রবীন্দ্রনাথের বহু কিছু নিয়ে বহুদিন, বহুরাত চিন্তা করেছি, ভেবেছি, কিন্তু কোন কিছুরই কুলকিনারা করতে পারিনি, তল খুঁজে পাইনি। তাঁর বলা নাবলা সব কথাই আমাকে টানে, আমাদের আকৃষ্ট করে। যেমনটি টানছিল আজও। শান্তিনিকেতনের মতো জায়গায় গাছের ছায়ায় উদোম মাঠে বসে রবি ঠাকুরের গান অনেকের মতো আমাদেরও মাতোয়ারা করে। কিন্তু সেই মাতোয়ারা ভাব থেকে গাইডই আমাদের ঠেলে ঠুলে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি হাঁটছি, কিন্তু মন পড়ে আছে সেই গাছের ছায়ায়, যেখানে শিল্পী হারমোনিয়ামে সুর ভাজছেন, গলা ছেড়ে গাচ্ছেন, ‘চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশীনি!’ ‘কেন যামিনি না যেতে জাগালে না, বেলা হলো মরি লাজে!’ রবি ঠাকুরকে কী আমার হিংসে হচ্ছে!
শান্তিনিকেতনে আরো কিছুক্ষণ ঘুরলাম আমরা। গাইড আমাদেরকে নানা কিছু দেখালেন। বিশেষ করে এক একটি ভবনের ইতিহাস তিনি শুনিয়ে গেলেন। গাছগাছালীর ইতিহাসও শুনালেন। জানালেন শিল্পকর্মগুলোর নানা কাহিনী। উন্মুক্ত মাঠে বিদ্যাচর্চা কিংবা স্নাতক পাশ করা ছাত্রদের গাছের পাতা উপহার দেয়ার কাহিনীও কমবেশি শুনালেন গাইড। গাইড একটি গাছের নাম বললেন ‘সপ্তপর্নি’। তবে এটি যে আসলে ছাতিম গাছ তা প্রথমে আমি চিনতেই পারিনি। পরে খেয়াল করে দেখলাম যে, সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্নি নামে যে গাছটিকে ডাকা হচ্ছে সেটি আসলে ছাতিম গাছ। সাতটি পাতা একই সাথে থাকে বিধায় এটিকে সপ্তপর্ণাও বলা হয়। প্রতিবছর বিশ্বভারতী থেকে যারা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তাদেরকে এই গাছের পাঁচটি পাতাসহ একটি ডাল উপহার দেয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে কেন এটি দেয়া হয় সেই প্রশ্ন গাইডকে করা হয়নি। গাইড নিজ থেকেও আমাকে জানান নি। তাই পরীক্ষা পাশের সাথে পাতার সম্পর্কটি আমার কাছে অজানা রয়ে গেছে।
‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়!’ আহারে রবীন্দ্রনাথ! এই কথাটিও আমার জন্য রেখে যাননি, বিদায় বেলার কথাটিও কি অবলীলায় বলে গেছেন। শান্তিনিকেতন থেকে আমাদের বের হতে ইচ্ছে করছে না, তবুও বাস্তবতা হলো আমাদের চলে যেতে হবে। কারণ আমরা সেখানে বিদেশী, এমন কোন পরিচিতজন কিংবা আত্মীয় স্বজন নেই যে গিয়ে হাজির হবো। কোন হোটেল মোটেল বা রিসোর্টও বুকিং দেয়া হয়নি। রাতে আমাদের থাকার কোন ব্যবস্থাও করিনি। তাছাড়া কলকাতা শহরে হোটেলে আমাদের রুম রয়েছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন আমার প্রিয় এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক এবং মিসেস কামরুন মালেক। এছাড়া দলের আরো অন্যান্য সদস্যরাও রয়েছেন। সবাইকে বাদ দিয়ে এভাবে শান্তিনিকেতনে থেকে যাওয়া বেমানান হবে। তাছাড়া আমি একা হলে কিছুটা রিস্ক নিয়ে থেকে যাওয়া যেতো, এখন স্ত্রী সাথে থাকায় কিছুটা বাড়তি তাড়াও ভিতরে কাজ করছিল।
আমরা ফিরতি পথ ধরার জন্য তৈরি হলাম। গাইড থেকে বিদায় নিলাম। ফোন করে ডেকে নিলাম গাড়ি। আমাদের গাড়ি ছুটছিল কলকাতার দিকে। নানা পথ মাড়িয়ে ছুটছিলাম আমরা। রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত শান্তিনিকেতন পেছনে ফেলে কেবলই সামনে ছুটছিলাম।
হঠাৎ আমার মনে পড়লো ল্যানচার কথা। ড্রাইভারকে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি বললেন, তার মনে আছে। আসলে ল্যানচা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই, আগে কখনো নাম শুনেছি বলেও মনে করতে পারছিলাম না। শান্তিনিকেতন যাচ্ছি বলার পর আমার এডিটর স্যার এম এ মালেকের কলকাতার প্রিয় বন্ধু সুশান্ত দাদা এবং ডালিয়া বৌদি আমাদের ল্যানচার কথা বলে দিয়েছিলেন। তারা বললেন যে, ল্যানচা যেন অবশ্য অবশ্যই টেস্ট করি। ল্যানচা না খেয়ে যেন শান্তিনিকেতন থেকে না ফিরি। তাই ল্যানচার ব্যাপারটি আগেভাগে ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলাম। আমাদের ল্যানচা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলাম। ব্যাপারটি তার মনে আছে শুনে আশ্বস্ত হলাম।
সূর্য ডুবে গেছে, রাত হয়ে গেছে বেশ আগে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কেমন যেন কম। কোথাও কোথাও একেবারে গ্রামীন জনপদ। ভিতরে ভিতরে কিছুটা ভয়ও ভর করছিল। গাড়ি যদি হঠাৎ নষ্ট হয়ে যায় তাহলে বিপদে পড়ে যাবো! অবশ্য ড্রাইভারের চোখে মুখে ভয়ের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। তিনি নিজের মতো করে স্টিয়ারিং ধরে আছেন, ঘুরাচ্ছেন। তীব্র বেগে ছুটছে গাড়ি।
আরো বেশ কিছু পথ আসার পর ড্রাইভার বামে ইন্ডিকেটর দিলেন। বললেন,‘ল্যানচা এসে গেছি। এখানে ফ্রেশ হয়ে ল্যানচা খেয়ে নিন।’ গাড়ি থামলো। বেশ অনেকগুলো দোকান, রাস্তা থেকে পঞ্চাশ ষাট গজ দূরে দোকান, সামনে উঠোনের মতো। গাড়ি পার্কিং করার চমৎকার জায়গা। কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম যে, প্রতিটি দোকানের নামই ল্যানচা। সাথে ছোট করে অন্য কোন শব্দ জুড়ে দেয়া হয়েছে। যেমন নিউ ল্যানচা, খাঁটি ল্যানচা বা এজাতীয় কিছু। আমাদের কুমিল্লার রসমালাইর মতো ব্যাপার স্যাপার বলে মনে হলো।
গাড়ি থামার পর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখে একটি দোকানে ঢুকলাম। গরম গরম মিষ্টি বানানো হচ্ছে। এই মিষ্টির নামই নাকি ল্যানচা। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমাদের কালোজাম টাইপের রসে ডোবানো একটি মিষ্টি। এটির নাম ল্যানচা কেন হলো বুঝলাম না। মিষ্টিগুলোর রঙও আমাদের কালোজাম মিষ্টির মতো, কালচে বাদামী। তবে সাইজ নিয়ে হেসে কুটি কুটি হচ্ছিল আমার স্ত্রী। এক একটি মিষ্টির সাইজ কি! মনে হয় আধা কেজি হবে। অবশ্য ছোট এবং স্বাভাবিক সাইজের মিষ্টিও রয়েছে। মিষ্টি তৈরি হচ্ছিল চোখের সামনে, রসে টইটম্বুর মিষ্টি। আমরা ল্যানচার অর্ডার করলাম। ড্রাইভারসহ তিনজনের জন্য মিষ্টি দেয়া হলো আলাদা প্লেটে। চোখের সামনে তৈরি হওয়া মিষ্টি, খাঁটি দুধে তৈরি বলেও জানালেন ড্রাইভার। ল্যানচা মুখে দিয়ে মনে হলো এর স্বাদ অসাধারণ। মিষ্টির প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহহীন এই আমিও দুই দুইটি ঢাউশ সাইজের ল্যানচা সাবাড় করে দিলাম।
ল্যানচার ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে যতটুকু জানা গেল তা হচ্ছে, কোন এক মহারাজা বা জমিদার বর্ধমানের কোনো মিষ্টির কারিগরকে ডেকে ভাজা মিষ্টি খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করিছিলেন। কারিগর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খুব দ্রুত মিষ্টি বানিয়ে মহারাজাকে খেতে দিলেন। মহারাজা অতিমাত্রায় আনন্দিত হলেন। অত্যন্ত সুস্বাদু ওই মিষ্টি তৈরি করেছিলেন যে কারিগর তিনি ছিলেন ল্যাংড়া। তার এক পায়ে সমস্যা ছিল। ল্যাংড়া ওই কারিগরের নামে মিষ্টির নাম হয়ে যায় ল্যানচা। সেই ল্যানচা আজ বিখ্যাত, গল্প উপন্যাসেও নাকি ল্যানচার প্রচুর গুণকীর্তন করা হয়েছে। ল্যানচার রসে মুখ এবং মন ভরিয়ে আমরা আবারো পথে নামলাম। কলকাতার দিকে ছুটছে আমাদের গাড়ি। অন্ধকারে ঢেকে রাখা মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহাসড়ক ধরে আমরা এগুচ্ছি। শান্তিনিকেতন কেবলই দূরে যাচ্ছিল তবে আমার অন্তরে রবীন্দ্র বসতি আরো যেন বেশি পোক্ত হচ্ছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেধার জোরেই টিকে থাকুক আমাদের তরুণরা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ