ত্রিপুরা পল্লীর দুই কিশোরী হত্যা মামলায় একজনের মৃত্যুদণ্ড

তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

উত্ত্যক্ত করতেন, প্রেমের প্রস্তাব দিতেন। সকলতী এড়িয়ে চলতেন, প্রত্যাখ্যান করেন প্রস্তাবও। এর জেরে সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পল্লীর দুই কিশোরী সকলতী ও তার বান্ধবী ছবিরাণী ত্রিপুরা হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। রায়ে প্রধান আসামি আবুল হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

অপরাধ প্রমানিত না হওয়ায় অপর আসামি ওমর হায়াত মানিককে খালাস দেওয়া হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. হালিম উল্লাহ এ রায় ঘোষণা করেন। এ সময় কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন আবুল হোসেন ও ওমর হায়াত মানিক। পরে আবুল হোসেনকে কারাগারে পাঠানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের পিপি অশোক দাশ আজাদীকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আবুল হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় অপর আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় ১৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ সাক্ষ্য দিয়েছেন একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছবিরাণীর ছোট ভাই রাজন ও চার্জশিট দাখিলকারী তদন্ত কর্মকর্তা। এর মধ্যে রাজনকে নতুন করে যুক্ত করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সত্ত্বেও সাক্ষী তালিকায় রাজনকে রাখা হয়নি। বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতকে বলার পর রাজনের এই যুক্ত হওয়া। অন্যদিকে রাজনকে সাক্ষী তালিকায় রাখা না রাখা বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর আগেও তিনি মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পিপি অশোক দাশ। এদিকে রায় ঘোষণার সময় ভিকটিম দুই কিশোরীর পরিবারের সদস্য ও আসামিদের স্বজনরা হাজির ছিলেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অশোক দাশ বলেন, আবুল হোসেনের মতো মানিকেরও মৃত্যুদণ্ড হতে পারতো। তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তে ত্রুটি থাকায় মানিক খালাস পেয়েছে। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আবুল হোসেন মানিক নামের একজনের নাম বলেছেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করে ওমর হায়াত মানিককে। আবুল হোসেনের বলা মানিক আর গ্রেপ্তার হওয়া ওমর হায়াত মানিক একই ব্যক্তি কিনা তা যাচাই করে দেখেন নি তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবুল হোসেনের সামনে গ্রেপ্তার হওয়া মানিকসহ ১০ জনকে হাজির করে সেখান থেকে মানিককে শনাক্ত করা যেত।

তদন্ত কর্মকর্তা তা করেন নি। আদালতের কাছে স্পষ্ট মনে হয়েছে যে, তদন্তে ত্রুটি ছিল। এ জন্যই ওমর হায়াত মানিকের সাজা হয়নি। এ অবস্থায় চার্জশিট দাখিলকারী তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

আদালত সূত্র জানায়, গত ৩ জানুয়ারি ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ও ছবিরানীর ছোট ভাই রাজন ত্রিপুরার সাক্ষ্য রেকর্ড করে আদালত। আদালতকে রাজন বলেন, ‘দিদি ছবিরাণীর কথা অনুযায়ী বাইরে খেলছিলাম। তখন আবুল হোসেনসহ তিনজন আসে। তারা আমার দিদিকে মেরে ফেলে। আমি লুকিয়ে দেখেছি’।

রাজন আরো বলেন, ঘটনার সময় আমি লোকজনকে ডাকতে গেলে আসামিরা বেড়া ভেঙ্গে পালিয়ে যায়। আমি কান্নাকাটি করি। বাবারা তখন কাজে গিয়েছিল। খবর পেয়ে তারা আসে’। রাজনের বক্তব্য রেকর্ড শেষে আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তা সুজায়েত হোসেনকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১০ জানুয়ারি সাক্ষ্য দেয় সুজায়েত হোসেন।

আদালতের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, রাজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তা ঠিক। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তাকে সাক্ষীর তালিকায় রাখা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের পিপি অশোক দাশ বলেন, ঘটনার পর দায়ের করা মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়, আসামি আবুল হোসেনসহ তিনজনকে ঘরের ভেতর ঢুকতে দেখে রাজন। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রাজনকে সাক্ষীর তালিকায় রাখেননি। ওই অবস্থাতেই ১৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয় আদালত। যুক্তিতর্ক শুনানিও সম্পন্ন হয়। রায় ঘোষণাটা শুধু বাকী ছিল। এর মধ্যে আমরা রাজনের সাক্ষ্য নিতে আদালতের কাছে আবেদন করি। আদালতও আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে।

যাইহোক, আসামিদের সর্বোাচ্চ শাস্তির জন্য রাজন ও সুজায়েতের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা তা আদায়ে সক্ষম হয়েছি। সেই অনুযায়ী আসামি আবুল হোসেন সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছেন।

২০১৮ সালের ১৮ মে সন্ধায় ১৭ বছর বয়সী সকলতী ত্রিপুরা ও ১৬ বছর বয়সী তাঁর বান্ধবী ছবিরানী ত্রিপুরার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সকলতী ত্রিপুরার বাবা পুলিন ত্রিপুরাকে সাথে নিয়ে ছবিরানীর বাবা সুমন ত্রিপুরা সীতাকুণ্ড থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার এজহারে বলা হয়, তারা সকলে কৃষি কাজ করতে পাহাড়ে যান। তখন ঘরে ছিল সকলতী ও ছবিরানী। দুপুর ১ টার সময় খবর যায় তারা দুজন ঘরের মধ্যে রশি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এ খবর পেয়ে তারা ঘরের দিকে ছুটে যান এবং দুই কিশোরীকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।

একপর্যায়ে পুলিশ গিয়ে লাশ নিয়ে গিয়ে ময়নাতদন্ত করেন। ময়নাতদন্তে দেখা যায়, ছবিরাণীর গলার নিচে কালো দাগ এবং সকলতীর থুতলীর নিচে চারটি ছোট কালো দাগসহ গলার নিচে কালো দাগের চিহ্ন পাওয়া যায়। মামলার এজহারে বলা হয়, আসামি আবুল হোসেনসহ অজ্ঞাত তিনজন আসামি বেলা ১১ টার দিকে দুই কিশোরীকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখেন। আসামিদেরকে ঘরে প্রবেশ করতে রাজন ত্রিপুরা দেখেন বলেও এজহারে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আসামিরা প্রায় সময় দুই কিশোরীকে উত্যক্ত করতেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভার্চুয়ালি সক্রিয় জঙ্গি গোষ্ঠী
পরবর্তী নিবন্ধগরম তেলে ঝলসে যাওয়া আহত শিশুর মৃত্যু