ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দিনের অভিমানকে ইতিহাস একদিন মূল্যায়ন করবেই

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠনের মার্কিন প্রস্তাবে সায় দিয়ে খোন্দকার মোশতাকের গোপন ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে ‘স্বাধীনতা, শুধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার’ সপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একটি আপসহীন অবস্থান গ্রহণকে সম্মান জানানোর জন্যেই আজকের কলামটি লিখছি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দিনের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারে এখনো বিস্ময়কর কৃপণতা দেখানো হচ্ছে! ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে যখন ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করলেন তখনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আঘাত হানতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বেরও এ-ব্যাপারে প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার কথা ছিল; বঙ্গবন্ধু এ-ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে আক্রমণের জন্যে সেনাবাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হওয়ার খবর পেয়েই তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে, পুরানো ঢাকার একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল আত্মগোপনের জন্যে। কিন্তু, ইতিহাসের ঐ যুগসন্ধিক্ষণে শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধু কোথাও যেতে রাজী হলেন না। তাজউদ্দিনের তাবৎ কাকুতি-মিনতি বিফলে গেলো। বঙ্গবন্ধুর এক কথা, ‘তোমরা যা করার কর, আমি কোথাও যাবনা’। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী তাজউদ্দিন একটি স্বাধীনতার ঘোষণাও লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং টেপরেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু টেপে ঘোষণা দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালেন। বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য,‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্যে পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্যে বিচার করতে পারবে’। তাজউদ্দিনের পীড়াপীড়ির জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশুদিন হরতাল ডেকেছি’ (সূত্র: শারমিন আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ: নেতা ও পিতা, ঐতিহ্য, এপ্রিল ২০১৪)।
তাজউদ্দিনকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেও স্বাধীনতা ঘোষণার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর, এটা এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তিনি স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার সিদ্ধান্ত যেমনি নিয়েছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের অগোচরে ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটিও জাতিকে জানানোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তাজউদ্দিন-কন্যা শারমিন আহমদের বইয়ে ওয়ারলেস বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হকের একটি টেলিফোন কল রিসিভ করার প্রসঙ্গটি বর্ণিত হয়েছে, যে কলটি ২৫ মার্চ মধ্যরাতের অব্যবহিত পর রিসিভ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী গোলাম মোরশেদ। জনাব নুরুল হক গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন,‘ম্যাসেজটি পাঠানো হয়ে গেছে। এখন মেশিনটি কী করব?’ তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। তাই বঙ্গবন্ধু টেলিফোন কল রিসিভ না করেই গোলাম মোরশেদের মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেন,‘মেশিনটি ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বল্‌’। গোলাম মোরশেদের এই কাহিনীর সমর্থন মিলছে ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হককে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐ ওয়ারলেস ম্যাসেজ পাঠানোর অপরাধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করার ঘটনায়। শেখ হাসিনা বলছেন বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন ইপিআর এর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়ারলেস ম্যাসেজটি পাঠিয়েছিলেন। আরেকটি ভার্সান বলছে, মগবাজার ওয়ারলেস অফিসের মাধ্যমে ম্যাসেজটি পাঠানো হয়েছিল। যেভাবেই পাঠানো হোক্‌, কয়েকটি দেশের সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিপ্রিন্টার ম্যাসেজ রিসিভ করে ২৬ মার্চ সকালে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ ম্যাসেজ চট্টগ্রামের সিলিমপুরের ওয়ারলেস অফিস থেকে মিসেস নুরুন্নাহার জহুরকে ফোনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যেটা সাইক্লোস্টাইল করে ২৬ মার্চ ভোর থেকে চট্টগ্রামে প্রচার করা হয়েছিল! ২৬ মার্চ সকালে একটি ঘোড়ার গাড়ীতে করে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারকারীদের হাত থেকে আমিও ঐ লিফলেটটা পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায়। এই কাহিনী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ, যা ১০ এপ্রিল বেতারে তাজউদ্দিন-ঘোষিত ‘বাংলাদেশেব স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বিভিন্ন টক শোতে ২০১৭ সালেই জানিয়েছেন, বিএসএফ এর গোলোক মজুমদারের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিপ্রিন্টার ম্যাসেজটা তিনি ৩০ মার্চেই সংগ্রহ করেছিলেন। দিল্লীতে যাওয়ার পর চট্টগ্রামের লিফলেট পাওয়ার পর ঐ ম্যাসেজটা মিলিয়ে দেখা গেল একই ম্যাসেজ। সেজন্যেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন কথাটি যুক্ত করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে যেতে কিংবা স্বাধীনতা ঘোষণায় রাজী করাতে না পেরে বিক্ষুব্ধ চিত্তে নিজ ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন। এরপর কীভাবে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তাজউদ্দিনকে বাসা থেকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে লালমাটিয়ার এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন এবং ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহারের পর জীবন বাজী রেখে তিন দিন তিন রাতের কঠিন ও বিপদসঙ্কুল যাত্রা পার হয়ে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার জীবননগর সীমান্তের টুঙ্গি নামক জায়গার একটি কালভার্টের ওপর পৌঁছে তওফিক ইলাহী চৌধুরী এবং মাহবুবউদ্দিন আহমদকে বিএসএফ এর ক্যাম্পে আলোচনার জন্যে পাঠিয়েছিলেন তার মনোমুগ্ধকর বর্ণনা শারমিন আহমদের বইটির ১০৬-১১০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত আছে। জনাব তাজউদ্দিন ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে জাতিকে জানিয়েছিলেন, টু্‌ঙ্িগর ঐ কালভার্টের ওপর অপেক্ষা করার সময়েই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে একটা স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন, এবং তজ্জন্যে ভারতের সাহায্য কামনা করবেন। সফল আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিএসএফ এর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন বিএসএফ এর পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক প্রধান গোলোক মজুমদার। তাঁর মাধ্যমে বিএসএফ মহাপরিচালক সুন্দরজি খবর পেয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। মিসেস গান্ধী তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুলকে সাক্ষাৎ দানে সম্মত হওয়ায় তাঁদেরকে নয়াদিল্লী নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এয়ারপোর্টে তাঁদের জামাকাপড়ের মলিন ও জীর্ণদশা দেখে সুন্দরজি নিজের স্যুটকেশ থেকে কাপড় দিয়ে তাঁদেরকে কাপড় পাল্টানোর সুযোগ করে দেন। পরে তাঁদেরকে আরো কিছু জামাকাপড় কিনে দেওয়া হয়েছিল। দিল্লী পৌঁছানোর পর এপ্রিলের ৩ তারিখে শ্রীমতি গান্ধীর সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লীতে এরই মাঝে গিয়ে পেঁৗঁছান বাংলাদেশের দুজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান। তাঁরাও আলোচনায় শরীক হতে শুরু করেন। একাধিক আলোচনা বৈঠকের পর ১০ এপ্রিল জনাব তাজউদ্দিন বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা প্রদান করেন, যাতে মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত হাই কমান্ডের সদস্যদেরকে মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার ঐ ভাষণটির মুসাবিদা করেছিলেন জনাব তাজউদ্দিন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং প্রফেসর রেহমান সোবহান। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর দিবসের ইতিহাস। ইতিহাসের অবিনশ্বর রায় হলো, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সারা বিশ্বের কাছে ‘অবিসংবাদিত বৈধতা’ দিয়েছিল। এই ইতিহাসের স্রষ্টাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে অপারগতা কেন? এটা খুবই বেদনাদায়ক যে কোন অজানা কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় একবারও মুজিবনগরে যাননি, শেখ হাসিনাও কখনো মুজিবনগর যান না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনে মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দিনের যে ভূমিকা উপরে বর্ণিত হলো সেখানে তাঁর অপরাধ কোথায়?
কোলকাতার থিয়েটার রোড থেকে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বর্ণনা এখন ইতিহাসের অবিনশ্বর অংশে পরিণত হয়েছে। শারমিন আহমদের বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সকল লেখকের লেখা থেকে এখন আমরা জানি, পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় তাজউদ্দিন তাঁর অফিসেই রাত কাটিয়েছেন। বলতে গেলে অহর্নিশ তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব প্রদান, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো-উনিশ ঘন্টাই তিনি দায়িত্ব পালনে কঠোর পরিশ্রম করতেন প্রত্যেক দিন-প্রত্যেক রাত। পরিচিত মহল ও সহকর্মীরা তাঁর স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করলে তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতেন যুদ্ধের মাঠে-ময়দানে-জঙ্গলে-বাংকারে-ট্রেঞ্চে-খানা-খন্দকের কাদাপানিতে সশস্ত্র-যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম কষ্টের কথা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকমাস পর তাঁর পরিবার কোলকাতায় পৌঁছে গেলেও তাদেরকে বরাদ্দ বাসায় তিনি একরাতও পরিবারের সাথে কাটাননি। তাঁর খানাপিনাও আসত তাঁর অফিসের রান্নাঘর থেকে। পুরো মুক্তিযুদ্ধ জুড়ে তাজউদ্দিনের মাত্র দুটো শার্ট ও দুটো প্যান্ট ছিল। তিনি নিজের হাতে নিজের শার্ট-প্যান্ট ধুয়ে পরিধান করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ যুদ্ধের দুঃসহ যাতনা এবং যুদ্ধক্ষেত্রের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অমানুষিক কষ্ট ও বেদনাকে ধারণ করার জন্যেই ছিল তাঁর ঐ কৃচ্ছ-সাধনা। সামান্যতম বিলাসকে যেমনি তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সযতনে পরিহার করেছেন তেমনি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবেও স্বাধীন বাংলাদেশের অভাব-অনটন-পীড়িত জনগণের জীবন-যাপনের কষ্টের ভাগিদার হয়ে আমৃত্যু ন্যূনতম আবশ্যকীয় মৌল-প্রয়োজনের বেশি সরকার ও রাষ্ট্র থেকে সুবিধা গ্রহণ করেননি। তাজউদ্দিনের এই ত্যাগ-তিতিক্ষায় প্রোজ্জ্বল গৌরব-গাথা জাতির ইতিহাসের চির-ভাস্বর অধ্যায়।
অথচ, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসার দিনেই তাঁর এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পেছনে অসদুদ্দেশ্যের মিথ্যাবয়ান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দিনের ওপর রুষ্ট করেছিল কে বা কারা! হয়তো সেপ্টেম্বর মাসে খোন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্যেও দায়ী করা হয়েছিল তাজউদ্দিনকে!! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পরবর্তীতে তাঁর বন্ধু তাজউদ্দিন জানিয়েছিলেন, ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিনা অপরাধে এহেন শাস্তি পেয়ে তাজউদ্দিন অভিমানাহত হয়েছিলেন। তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘আমি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করলাম সেটা মুজিব ভাই একটিবারও জানতে চাইলেন না’। জাতির চরম দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দিনের আস্থার সম্পর্ক তাঁদের জীবদ্দশায় আর জোড়া লাগেনি। আত্মসম্মানবোধের কারণে তাজউদ্দিনও নিজের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেননি একবারও। শারমিন আহমদের বই থেকেই জানতে পেরেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর গ্রেফতার হওয়ার আগে জনাব তাজউদ্দিন একাধিকবার আফসোস করেছিলেন,‘কে তাঁর প্রকৃত বন্ধু আর কে শত্রু তা মুজিব ভাই জেনেও গেলেন না’। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইতিহাস একদিন তাজউদ্দিনের এই অভিমানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করবেই, মুক্তিযুদ্ধের মহান কান্ডারিকে যাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে চলেছেন তাঁদেরও শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারিকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে কৃপণতা কি অযৌক্তিক নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? এখনতো আপনার উদ্যোগে মুজিবনগরের স্মৃতি রক্ষার্থে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য এবং স্মৃতিসৌধসমূহ গড়ে তোলা হয়েছে। তাজউদ্দিন-ঘোষিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নামেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন তাজউদ্দিন। বৈদ্যনাথ তলার ভবেরপাড়াকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণও করেছিলেন স্বয়ং তাজউদ্দিন। আবার, সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভন্ডুল করার জন্যে খোন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে প্রদত্ত মার্কিন কূটচালকেও রুখে দিয়ে তিন মাসের মধ্যেই জাতিকে বিজয় এনে দিয়েছিলেন তাজউদ্দিনই। তাজউদ্দিনকে সম্মান জানালে তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে ভুল করেছিলেন তা সংশোধিত হবে, বঙ্গবন্ধুর আত্মা এতে শান্তি পাবে। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারিকে যথাযথ স্বীকৃতি দিন, তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে আর তাঁকে বঞ্চিত করবেন না।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুব কর্মকর্তাদের এক এলাকায় ৫ বছরের বেশি রাখতে মানা
পরবর্তী নিবন্ধস্বর্ণ ডাকাতির ঘটনায় আরও এক পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতার