ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জসমূহ

এ-বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে বাঙালি জাতি বিশ্বের কাছে আত্মমর্যাদাশীল, আত্মপ্রত্যয়ী এবং উন্নয়ন যাত্রাপথে সাফল্য অর্জনের কঠোর সংগ্রামে অবিচল জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে। সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে অর্জনের পথের মূল চ্যালেঞ্জগুলোকে স্মরণ করবো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে এই নব্য-স্বাধীন দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আদৌ টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে বিশ্বের অনেক উন্নয়ন-অর্থনীতিবিদের গভীর হতাশা ছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জনসন নামের যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক যখন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিঙনের তদানীন্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত সেক্রেটারী অব স্টেট ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার তাতে সায় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ওপর ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ইউস্ট ফালান্ড ও জন পারকিনসনের বিশ্বখ্যাত গবেষণা-পুস্তকটির নামই ছিল বাংলাদেশ–এ টেস্ট কেস অব ডেভেলাপমেন্ট। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার অনেক সাধ্য-সাধনা করে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল, যাতে বাংলাদেশ এর ফলে বৈদেশিক অনুদান, খাদ্য সহায়তা এবং ‘সফট লোন’ পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনা পায়। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশকে ঐ অপমানজনক অবস্থান থেকে বের করে আনবেন। কিন্তু, এক দশকের স্থলে বাংলাদেশের ৪৩ বছর লেগে গেছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সোপানে পৌঁছানোর জন্যে। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটেগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এবং ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। (করোনা ভাইরাস মহামারির বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ ২০২৪ সালের পরিবর্তে ২০২৬ সালে এই উত্তরণ কার্যকর করার অনুরোধ জানিয়েছে।) এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের যে ডাইমেনশনগুলো বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে সেগুলো হলো, ১) বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ৮.১৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থ-বছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২১ সালের ৩০ জুন ২৫৫৪ ডলারে পৌঁছেছে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে (জিএনআই বেশ কিছুটা বেড়েছে ভিত্তি বছর পরিবর্তনের ফলে)।
২) আইএমএফ বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে ২০১৫ সালেই।
৩) ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছিল, যেখান থেকে ২০২০ সালের মার্চে করোনা ভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর্যায়ে দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০.৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। (গত দেড় বছরে মহামারির কারণে দারিদ্র্য আবার ৫-১০ শতাংশ বেড়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে)।
৪) ১৯৭৬-৭৭ অর্থ-বছর থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক ঋণ-অনুদান ১০ শতাংশের বেশি ছিল, ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে জিডিপি’র এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ এখন আর খয়রাত-নির্ভর দেশ নয়, একটি বাণিজ্য-নির্ভর দেশ।
৫) এক দশক ধরে প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জিত হচ্ছে। এর মানে, বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি এখন আর সংকটজনক নয়। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্স এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যে স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
৬) জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েেেছ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন, ২০২০ সালে তা সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বেড়ে তিন কোটি বিরাশি লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল চার কোটি তিপ্পান্ন লাখ টন। সত্তর লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২০ সালে বাংলাদেশে এক কোটি দুই লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। (এখনো আমরা অবশ্য প্রায় ৫০/৫৫ লাখ টন গম আমদানি করি)। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারী উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান।
৭) করোনা মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে শিল্পখাতের অবদান জিডিপি’র ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল, বিনিয়োগ-জিডিপি’র অনুপাতও ৩১.৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।
৮) ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৪২ বিলিয়ন (মানে ৪২০০ কোটি) ডলারেরও বেশি, অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫.২ কোটি ডলার। (করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থ-বছরে রফতানি আয় ৩৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল, কিন্তু ২০২১-২২ অর্থ-বছরে তা আবার ৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে)। রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশই আসছে বুনন ও বয়নকৃত তৈরী পোষাক খাত থেকে। চীনের পর বাংলাদেশ পোষাক রফতানিতে বিশ্বের দ্বিতীয়-বৃহত্তম রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, ঔষধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষি-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য রফতানি বাজারে ভালই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
৯) বাংলাদেশের এক কোটি ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। করোনা ভাইরাস মহামারি সত্ত্বেও ২০২০ সালে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের বছরের চাইতে ২৪ শতাংশ বেড়ে ২১.৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।
১০) ডঃ ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন দরিদ্র নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। এই সফল উদ্ভাবনটি নোবেল প্রাইজ অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন করেছে।
১১) বাংলাদেশের নারীদের প্রায় ৩৬ শতাংশ বাড়ীর আঙিনার বাইরে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোষাক শিল্পে ৩৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণের সহায়তায় নারীর স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বাংলাদেশ বিশ্বে সফল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
১২) বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের শেষে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল, যা দক্ষিন এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। (গত চার মাসে রিজার্ভ আবার ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে।) ২০০৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রুপির বৈদেশিক মুদ্রামান টাকার চাইতে বেশি হলেও বাংলাদেশের এক টাকায় এখন পাকিস্তানের দুই রুপি পাওয়া যায়। ভারতের রুপির বৈদেশিক মানের তুলনায়ও বাংলাদেশের টাকার মান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৩) বাংলাদেশে এখন সাড়ে ষোল কোটি মোবাইল টেলিফোন রয়েছে, এগার কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
স্বাধীনতা-উত্তর ৫০ বছরে উপরে উল্লিখিত প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে বড়সড় চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়েছে। মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠির কাছে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ফলে, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি (বা গিনি) সহগ যখন বেড়ে ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন ঐ দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩৩, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে ০.৪৮৩ এ পৌঁছে গেছে। আরেকটি পরিমাপকের গতি-প্রকৃতির মাধ্যমে ২০১০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে আয়বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠির বিপক্ষে এবং ৫-১০ শতাংশ ধনাঢ্য গোষ্ঠিগুলোর পক্ষে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ফুটে উঠেছে: ২০১০ সালে দরিদ্রতম ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ০.৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে মাত্র ০.২৩ শতাংশে নেমে গেছে। ২০১০ সালে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা মাত্র ১.০১ শতাংশে নেমে গেছে। সমস্যার আরেক পিঠে দেখা যাচ্ছে, দেশের ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১০ সালে ছিল মোট জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আরো দুঃখজনক হলো, জনগণের সবচেয়ে ধনাঢ্য ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১৬ সালে চলে গেছে মোট জিডিপি’র ২৭.৮৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্‌ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ হার। দেশের আয় এবং সম্পদের এহেন পুঞ্জীভবন বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট নজির হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে সংসদে পাশ হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও বর্তমান সরকার এখনো ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে মেতে রয়েছে। ২০০১-২০০৫–ঐ পাঁচ বছরে পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিল, এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করলো ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধিতে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আয়বৈষম্য এভাবে বাড়তেই পারে না, যদি শাসকরা সমাজতন্ত্রকে ‘বাত্‌ কা বাত’্‌ বানিয়ে না ফেলে। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছেই দেশের খেলাপি ব্যাংকঋণের ৮০ শতাংশেরও বেশি আটকে রয়েছে, এবং এই ব্যাংকঋণ লুটেরারা ঋণের সিংহভাগ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। টরোন্টোর ‘বেগম পাড়া’ এবং মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোমের’ বাসিন্দাদের সিংহভাগই এদেশের রাঘববোয়াল পুঁজি পাচারকারী। বাংলাদেশের এই পুঁজি পাচারকারীরা জাতির শত্রু। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জারজ সন্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাব মোতাবেক গত এক দশক ধরে প্রতি বছর দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার হয়ে চলেছে গড়ে ৭-৯ বিলিয়ন ডলার। পুঁজি পাচার দমনে বর্তমান সরকার মোটেও আন্তরিক নয়।
সবশেষে দুটো গুরুতর বিষয়কে সামনে আনতে চাই। প্রথমত, এখনো এদেশের জনগণের জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা, যাতনা ও হয়রানি ঘটিয়ে চলেছে সর্বব্যাপ্ত দুর্নীতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও গত তিন বছরে এই অঙ্গীকার পূরণকে সত্যিকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে লাইনচ্যুত গণতন্ত্রকে আবারো লাইনে পুনঃস্থাপন করা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ঐ নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র যে জালিয়াতির দুষ্টচক্রে বন্দী হয়ে গেছে তা থেকে সহজে জাতির নিষ্কৃতি মিলবে না।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধমহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন গণমানুষের নেতা