ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৭ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

শ্রীলংকার মহাসংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে
চটকদার প্রকল্পের মোহ পরিত্যাগ করুন
সাম্প্রতিককালে শ্রীলংকা তাদের স্বাধীনতা-উত্তর ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলংকা, যেখানে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারের বেশি। শ্রীলংকার ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গণমুখী। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, একমাত্র ভারতের কেরালার স্বাস্থ্যব্যবস্থা এর চাইতে উন্নততর ও সর্বজনীন। দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনের আকর্ষণের বড় ঠিকানাও ছিল শ্রীলংকা। অথচ, বছরখানেক ধরে শ্রীলংকার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানীকৃত পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনগণের জীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। বেশ কয়েকমাস ধরে ভয়ংকর খাদ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানীতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবেলার সামর্থ্য এখন তাদের নেই বললেই চলে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিভিন্ন আইটেম কেনার জন্য লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, ফলে ক্রুদ্ধ জনতার সরকারবিরোধী সমাবেশও দিনদিন বড় হচ্ছে। শ্রীলংকান রুপির বৈদেশিক মান কিছুদিন আগেও ছিল এক ডলারে এক’শ নব্বই রুপি, গত দু’মাসে সেটা বেড়ে তিন’শ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে, অথচ আগামী এক বছরের মধ্যে শ্রীলংকাকে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সুদাসলে পরিশোধ করতেই হবে। এর মানে, শ্রীলংকা ‘আর্থিক দেউলিয়া’ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। সম্প্রতি শ্রীলংকার সরকার দেশে ‘ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করেছে, কারণ দেশটি এখন রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগতকারী রাজাপাকসে পরিবারকে উৎখাত করার জন্য গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখীন। অনেকের হয়তো জানা নেই, শ্রীলংকার বর্তমান সরকারে রাজাপাকসে পরিবারের পাঁচজন–প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং আরো তিনজন মন্ত্রী রয়েছেন। শ্রীলংকার সরকারী বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে রাজাপাকসে পরিবার।
দেশটির এই দেউলিয়াত্ব ডেকে এনেছে করোনা ভাইরাস মহামারি, উল্টাপাল্টা নানা প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক এবং রাতারাতি কৃষিখাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। প্রেসিডেন্ট গোতাাবায়া দেশের কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের সাথে শলা-পরামর্শ না করেই নিজের খামখেয়ালী সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর সরকার নাকি জৈব কম্পোস্ট সার সরবরাহের প্রক্রিয়া গড়ে তুলবে, যাতে রাসায়নিক সারের ‘প্রকৃতি-বান্ধব বিকল্প’ ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করা যায়। কিন্তু, মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন অনেক কঠিন–এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড়ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি! কৃষক জৈব কম্পোস্ট সারের জন্য হাপিত্যেশ করলেও পুরো ফলন-মৌসুমে তার দেখা মেলেনি। ফলে, এক অভূতপূর্ব ফলন-বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলংকার কৃষিখাত। ‘অর্গানিক ফার্মিং’ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শ্রীলংকার কৃষিজাত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে এক-তৃতীয়াংশ কমে গেলো। অন্যদিকে, করোনা ভাইরাস মহামারি শ্রীলংকায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনলো শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। গত দু’বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এহেন বিপর্যয় গেড়ে বসেছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলংকার রফতানি আয়ের আরো দুটো প্রধান সূত্র এলাচি এবং দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির দু’বছরে। একইসাথে যুক্ত হলো শ্রীলংকার অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের অভূতপূর্ব ধস। ফলে শ্রীলংকার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামলো এমন এক সময়ে, যখন কৃষিখাতের ফলন-বিপর্যয় খাদ্যদ্রব্যসহ প্রায় সকল নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি সৃষ্টি করেছে।
এর সাথে যুক্ত হলো ২০০৯ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থে যত্রতত্র প্রকল্প গ্রহণের বদখাসলতের চরম মূল্য চুকানোর পালা। ২০০৯ সালে শ্রীলংকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কারণে ভারত থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন। চীনও শ্রীলংকার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশটিকে নিজেদের প্রভাববলয়ে টেনে নেয়ার জন্য বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর আওতায় হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কলম্বোয় সমুদ্রবন্দরের কাছে চাইনিজ সিটি নির্মাণ, জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে রাজাপাকসে বিমানবন্দর নির্মাণসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পে সহজ শর্তে শ্রীলংকাকে প্রকল্পঋণ প্রদান করে। পরবর্তীতে যখন হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হয় তখন দেখা গেল যে বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট চাহিদা নেই। বন্দরের আয় বাড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলংকা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে লীজ দিতে বাধ্য হয়। একই রকম বিপদে পড়তে হচ্ছে কলম্বোর চাইনিজ সিটি নিয়ে এবং বিমানবন্দর প্রকল্প নিয়ে। একইসাথে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সভরেন বন্ডের মাধ্যমে শ্রীলংকা প্রচুর বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ করেছিল, যেগুলোর ম্যাচুরিটি শুরু হচ্ছে ২০২২ সাল থেকে। কিন্তু, এখন তো সুদাসলে ঐ বন্ডের অর্থ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য শ্রীলংকার নেই। অতএব, পাকিস্তানের মত নিজেদেরকে ঋণ পরিশোধে অপারগ ঘোষণা করে আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের কাছে নাকে খত দিয়ে ‘রেসক্যু প্যাকেজ বা বেইলআউট প্যাকেজের’ জন্য হাত পাতা ছাড়া চলমান মহাবিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথ হয়তো খোলা নেই শ্রীলংকার।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশেও অত্যন্ত ব্যয়বহুল চটকদার (গ্ল্যামারাস) প্রকল্প গ্রহণের চিন্তাভাবনা দেশের ক্ষমতাসীন মহলের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোজগত দখল করার আলামত দেখে ভবিষ্যতে শ্রীলংকার মত বাংলাদেশও ‘ঋণের ফাঁদে’ আটকা পড়ার আশংকার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর মিউনিখে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে এ-ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প সম্পর্কে নূতনভাবে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে নিচে উল্লিখিত প্রকল্প-প্রস্তাবগুলোর নাম এসে যাবে: ১) ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন, ২) দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, ৩) দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ৪) পূর্বাচলে একশ’ দশ তলা-বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেঙ, ৫) শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৬) পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, ৭) নোয়াখালী বিমানবন্দর এবং ৮) ঢাকার বাইরে রাজধানী স্থানান্তর। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে প্রকল্প-মূল্যায়ন সম্পর্কে যেহেতু আমার উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয়েছে তাই এই প্রকল্পগুলোকে বর্তমান পর্যায়ে আমি গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করতে পারছি না।
২০১২ সালের ২৯ জুনে যখন বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু প্রকল্পে ঋণপ্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিল তখন জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমিই প্রথম ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের টক শোতে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন জানিয়েছিলাম, এবং এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত কলামে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তাঁকে যুক্তিসহকারে আহ্বান জানিয়েছিলাম। অন্যান্য অনেক অর্থনীতিবিদ তখন আমার ঐ প্রস্তাবকে অবাস্তব আখ্যা দিলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের পরমসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিলেন। ঐ একটি সিদ্ধান্তই বিশ্বে বাংলাদেশের ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ ইমেজকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। আগামী ৩০ জুন পদ্মা সেতু সড়ক-যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। পদ্মা সেতুর পথ ধরে গত এক দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একের পর এক অনেকগুলো মেগা-প্রজেক্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেগুলোর বাস্তবায়নকে প্রায় সম্পন্ন করে এনেছেন । এর মধ্যে দুটো প্রকল্প ছাড়া সবগুলোর ব্যাপারেই দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছি আমি। এই দুটো প্রকল্প হলো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং প্রস্তাবিত পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর। বিলম্বে হলেও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ থেকে সরকার পিছু হটেছে। ওখানে এখন একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে, যা আমি সমর্থন করেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক লক্ষ তের হাজার কোটি টাকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল ‘সাদা হাতি’ রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
উপরে যে আটটি চটকদার প্রকল্পের নাম উল্লেখ করা হলো সেগুলোর ব্যাপারে আমার আপত্তি কেন তা ব্যাখ্যা করছি:
১) ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন চালুর প্রস্তাবিত প্রকল্পটি আমার বিবেচনায় বর্তমানে একেবারে অপ্রয়োজনীয়। (প্রকল্পটি আপাততঃ গৃহীত হবে না বলে সরকারী সিদ্ধান্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও প্রকল্পের সমীক্ষা এগিয়ে চলেছে)। এই বুলেট ট্রেনের ডামাডোলে ঢাকা-লাকসাম বা ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন নির্মাণের প্রকল্প-প্রস্তাবটি পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে গেছে, এখানেই আমার আপত্তি। ঐ প্রস্তাবিত কর্ডলাইনটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বহুদিন আগেই সম্পন্ন হয়েছে এবং সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রায় ছয় বছর আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে অচিরেই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হবে। এই কর্ডলাইন বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে রেলপথে চট্টগ্রামের দূরত্ব বর্তমান ২১৩ মাইল থেকে মাত্র ১৫০ মাইলে কমে আসবে। ফলে, ৬৩ মাইল দূরত্ব কমে যাওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রামের বিরতিহীন ট্রেন মাত্র তিন ঘন্টায় গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
২) বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের ব্যাপারে আমার আপত্তির কারণ হলো প্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের এক তৃতীয়াংশ ক্যাপাসিটিও এখনো আমরা ব্যবহার করতে সক্ষম হইনি।
৩) পটুয়াখালিতে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কে আমার আপত্তি রূপপুর প্রকল্পের অনুরূপ। পারমাণবিক প্রযুক্তি বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য অতিশয় বিপজ্জনক। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়াকেই আমি প্রয়োজনীয় মনে করি। দেশে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য জায়গার অভাব রয়েছে বলে যে ধারণা রয়েছে সেটাকে আমি গ্রহণযোগ্য মনে করি না। দেশের নদ-নদীগুলোর দু’পার বরাবর সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হলে জায়গার অভাব হবে না। একইভাবে, বঙ্গোপসাগরের উপকূল জুড়ে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার বিরাট সম্ভাবনা তো রয়েছেই। দেশের বাড়ীঘরের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের সম্ভাবনার কতটুকু আমরা ব্যবহার করতে পেরেছি?
৪) পূর্বাচলের প্রস্তাবিত একশ’ দশ তলা বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স নেহায়তই একটি ‘গ্ল্যামারাস’ প্রকল্প!
৫) শরীয়তপুরের প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ভবিষ্যতে দেশের জন্য হয়তো প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখন যখন শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন হতে চলেছে তখন সম্প্রসারিত শাহজালাল বিমানবন্দর আগামী এক দশক দেশের প্রয়োজন ভালভাবেই মেটাতে সক্ষম হওয়ার কথা।
৬) পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত দ্বিতীয় পদ্মাসেতু নির্মাণের চাইতে ওখানে একটি টানেল নির্মাণের যুক্তি অনেক বেশি শক্তিশালী মনে হয়। দু’দুটো পদ্মাসেতু পদ্মা ও যমুনা নদীর পানিপ্রবাহকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করবে।
৭) নোয়াখালী বিমানবন্দর খুব বেশি ব্যবহৃত হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। শ্রীলংকার রাজাপাকসে বিমানবন্দরের মত এটিও বোঝা হয়ে পড়বে।
৮) ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্তও বর্তমান বাস্তবতায় পরিহারযোগ্য মনে করি।
ভৌত অবকাঠামোর অপর্যাপ্ততা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড়সড় বাধা, তাই অবকাঠামো নির্মাণ ত্বরান্বিত করতেই হবে। কিন্তু, প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি চটকদার ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্পের মোহ দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে পেয়ে বসে তাহলে শ্রীলংকার মত ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশেরও দেরি হবে না। বাংলাদেশের আমদানি ২০২১-২২ অর্থ-বছরে বেড়ে প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে, যার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর আশংকা রয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০২২ সালের এপ্রিলে ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। ২০২০-২১ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের মোট ঋণ জিডিপি’র ৪২.৫ শতাংশ ছিল, কিন্তু এর মধ্যে জিডিপি’র ১৭.৫ শতাংশ ছিল ৬২.৪৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ। গত নয় মাসে বৈদেশিক ঋণ হয়তো ৬৯/৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। ২০২১-২২ অর্থ-বছরের বাজেটে ঋণের সুদাসল পরিশোধ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৮,৫৮৮ কোটি টাকা। সরকারের কর-জিডিপি’র অনুপাত যেখানে ৯ শতাংশের নিচে নেমে গেছে সেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য এত বেশি বরাদ্দ অশনি সংকেতের শামিল। একইসাথে খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পোষাক রফতানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এই দুটো খাতে ধস নামলে আমাদের অর্থনীতিও মহাসংকটে পড়বে। সাধু সাবধান!
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্ণফুলী বাঁচাতে ও জলাবদ্ধতা রোধে নগরপিতার বিশেষ উদ্যোগ
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়া ও লোহাগাড়ায় ২৫ ব্যবসায়ীকে ৩৭ হাজার টাকা জরিমানা