জেনে নিন আপনার যত অধিকার নামজারী খতিয়ান কেন প্রয়োজন

এ এম জিয়া হাবীব আহসান | শনিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

অনেক শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত লোককেও বলতে শুনেছি ‘মিউটেশান’ খতিয়ানকে ভুলভাবে ‘ইমিটেশন’ খতিয়ান উল্লেখ করতে। এই সম্পর্কে সকলের সম্মক জ্ঞান থাকা দরকার। যদিও খতিয়ান স্বত্বের একমাত্র প্রমাণ নয়, তবুও এটা সম্পত্তির মালিকের দখলের প্রমাণ বহন করে। খরিদ সূত্রে, ওয়ারিশ সূত্রে, দান, হেবা, এওয়াজ, লীজ, অছিয়ত ইত্যাদি যে কোন হস্তান্তর দলিল সূত্রে স্থাবর সম্পত্তি বা ভূমির (জমির) মালিকানা অর্জন করা যায় কিন্তু অর্জিত মালিকানায় দখলের প্রমাণ হলো খতিয়ান। এ জন্যে পূর্বের মালিকের স্থলে বর্তমান মালিকের নামে নামজারী করাকেই খারিজ খতিয়ান বা নামজারী (মিউটেশান) খতিয়ান বলে। বর্তমানে সম্পত্তির নামজারী জমাভাগ খতিয়ান ছাড়া সম্পত্তি হস্তান্তর বা বেচা-বিক্রি, বন্ধক ইত্যাদি করা যায় না। সরকার কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ নামজারীর অভাবে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ লাভেও ব্যর্থ হয়। ফলে নানা মামলা-মোকদ্দমা ও বিরোধের সৃষ্টি হয়। ভূমির মালিক নিজ নামে সরকারি সেরেস্তায় ভূমি কর দিতে হলেও তার নামজারী প্রয়োজন। পৃথক নামজারী ছাড়া কোন ব্যক্তি এজমালী সম্পত্তি বন্ধক দিতে পারেন না।
কেন খারিজ/ নামজারী/ মিউটেশান করবেন : যে কোন সময় জমি বিক্রয় করা যাবে (রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮- এর ৫২এ ধারা এবং সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ -এর ৫৩সি ধারা অনুসারে, দলিল মূলে প্রাপ্ত জমির নামজারী খতিয়ান না থাকলে সে জমি বিক্রয় করা যাবে না। মিউটেশান করলে ভূমির মালিকানা হালনাগাদ হবে। ভূমি উন্নয়ন কর আদায়/প্রদান করা সহজ হবে। খতিয়ান হালনাগাদ না থাকার ফলে জরিপ কাজে সুবিধা হবে। সরকারের খাস জমি সংরক্ষণে সুবিধা হবে। নদী সিকস্তি পয়স্তি জনিত কারণে রেকর্ড সংশোধন করা হবে। মূল ভূমি মালিকের মৃত্যুতে উত্তরাধিকারীগণের মালিকানার নির্দিষ্ট অংশ সম্বলিত খতিয়ান প্রস্তুত হবে। রেজিস্ট্রীকৃত দলিল মূলে জমি হস্তান্তরের কারণে ক্রেতা বা গ্রহীতার নামে খতিয়ান প্রস্তুত হবে। মামলা-মোকদ্দমা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। বিক্রেতা আপনার ক্রয়কৃত জমি দ্বিতীয়বার বিক্রয় করতে পারবে না। সর্বোপরি যে কোন বিতর্কের সময় মালিকানা বা দখল প্রমাণের ক্ষেত্রে নামজারী সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি গুরুত্বপূর্ণ দলিল বা প্রমাণ কাগজ হিসাবে বিবেচিত হবে ।নামজারী তিন ভাবে হয়ে থাকেঃ- ক) শুধু নামজারী বা নামপত্তন- কোন রেকর্ডীয় মালিকের নামের পরিবর্তে একই খতিয়ানে পরবর্তী গ্রহীতা ও ওয়ারিশগণের নামভুক্ত হলে তা শুধু নামজারী বা নামপত্তন হিসাবে পরিচিত। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪০ ধারা মতে এ ধরনের নামজারী বা নামপত্তন হয়ে থাকে। খ) নামপত্তন ও জমা খারিজ : কোন দাগের জমি বিক্রয় বা অন্য কোন প্রকার হস্তান্তরের মাধ্যমে বিভক্ত হলে এবং এই বিভক্তির জন্য পৃথক হিসাব বা হোল্ডিং খুলে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের আদেশ দিলে তা নামপত্তন ও জমা খারিজ নামে পরিচিত। এ ক্ষেত্রে জমির মালিকানার পরিবর্তন হবে এবং পৃথক খতিয়ান এবং হোল্ডিং নম্বর পড়বে। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৩ ও ১১৭ ধারা মতে নামপত্তন ও জমা খারিজ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে থাকে। গ) নামপত্তন ও জমাখারিজ একত্রীকরণ : কোন ব্যক্তির একই মৌজার ভিন্ন ভিন্ন খতিয়ানে জমি থাকলে, এই খতিয়ানগুলোর মাধ্যমে প্রাপ্ত জমি একই খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন খতিয়ান প্রস্তুত করলে, তাকে নামপত্তন ও জমা একত্রীকরণ করা বলা হয়। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৩ ও ১১৬ ধারা অনুসারে এ প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। নামজারীর সময়সীমা মহানগরের ক্ষেত্রে ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) কর্মদিবস এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ৩০ (ত্রিশ) কর্মদিবস। সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর আবেদন দাখিল। (ভূমি অফিসের নির্ধারিত ফরমে অথবা িি.িসরহষধহফ.মড়া.নফ এই ওয়েবসাইট থেকে বিনা মূল্যে ফরম ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ সরাসরি অনলাইনে আবেদন দাখিল করা যায়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক প্রাথমিক যাচাই বাছাই শেষে সরেজমিন তদন্তের জন্য আবেদনটি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রেরণ করা হয়। ইউনিয়ন ভূমি অফিস কর্তৃক প্রস্তাব/প্রতিবেদন সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে প্রেরণ করা হয়। তারপর সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে শুনানীর জন্য নোটিশ প্রদান করা হয়। নোটিশ প্রাপ্তির পর যাবতীয় মূল কাগজপত্রসহ আবেদনকারী কর্তৃক শুনানীতে অংশগ্রহণ করতে হয়। পরিশেষে কানুনগো কর্তৃক প্রতিবেদন এবং নথিপত্র যাচাই করত সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক আদেশ প্রদান পূর্বক নামজারী জমাভাগ খতিয়ান সৃজন করা হয়। নামজারীর ফিস ও আবেদনপত্রের সঙ্গে কাগজপত্র খারিজ/ মিউটেশান/ নামজারীর জন্য নিম্নলিখিত হারে ফিস প্রদান করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে কোর্ট ফি ২০/- (বিশ) টাকা, নোটিশ জারী ফি ৫০/- (পঞ্চাশ) টাকা, রেকর্ড সংশোধন বা হালকরণ ফি ১,০০০/- (এক হাজার) টাকা, প্রতি কপি মিউটেশান খতিয়ান সরবরাহ বাবদ ১০০/- (একশত) টাকা ফি নির্ধারিত আছে । উল্লেখ্য, আবেদনপত্রের কোর্ট ফি ছাড়া বাকিগুলো ডিসিআরের মাধ্যমে আদায় করা হয়, তাই বাকি ১,১৫০/- টাকা অফিসে নগদে ফিস জমা দিয়ে ডিসিআর সংগ্রহ করতে হয়। ডিসি আর মানে খতিয়ানের টোকেন বা ডুপ্লিকেট কার্বণ রিসিট এটাও একটা গুরত্বপূর্ণ ডুকুমেন্ট যা হারালে আর নকলের কপি পাওয়া যায় না। নামজারীর আবেদনে যে সব কাগজপত্র লাগবে : ১) ২০/- (বিশ) টাকার কোর্ট ফি সহ মূল আবেদন ফরম। ২) আবেদনকারীর ১ (এক) কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি (একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জন্য ছবি প্রয়োজন। ৩) আবেদনকারীর পরিচয়পত্রের সত্যায়িত অনুলিপি (জাতীয় পরিচয়পত্র/ ভোটার আইডি/ জন্ম নিবন্ধন সনদ/ পাসপোর্ট/ ড্রাইভিং লাইসেন্স/ ইত্যাদি। ৪) খতিয়ানের ফটোকপি/ সার্টিফাইড কপি। ৫) বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রশিদ। ৬) সর্বশেষ জরিপের পর থেকে বায়া দলিলের সার্টিফাইড কপি বা ফটোকপি। ৭) উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা লাভ করলে অনধিক তিন মাসের মধ্যে ইস্যুকৃত মূল উত্তরাধিকারী সনদ। ৮) ডিক্রির মাধ্যমে জমির মালিকানা লাভ করলে ঐ ডিক্রির সার্টিফাইড কপি বা ফটোকপি জমা দিতে হবে। তবে শুনানী গ্রহণকালে দাখিলকৃত কাগজের মূলকপি অবশ্যই আনতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দখল/ প্রয়োজনীয় মালিকানার রেকর্ডপত্র দেখাতে হবে কেননা খতিয়ান ভুল লিপি হলে তার বিজ্ঞ দেওয়ানি আদালতে ঘোষণা মোকাদ্দমা করে তা সংশোধনী এর রায় ডিক্রি নিয়ে তার সরকারের ভূমি অফিসে দাখিল করতে হয়। বর্তমানে এজমালী মৌরশী সম্পত্তি বিভাগবন্টন দলিল ছাড়া পৃথক মিউটেশান করা যায় না। এ ব্যাপারে উত্তরাধিকারীদের খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এর প্রজাস্বত্ব আইনে ১৪৩ (খ) সংযোজন করে গত ৭ই জুলাই ২০১৯ ইং সাল বাংলাদেশ সরকার গেজেট প্রকাশ করা যায়নি। উক্ত ধারার ২ টি উপধারায় উল্লেখ করা হয়।
যথাক্রমে- (১) কোন ব্যক্তি যিনি তাহার বংশধর বলিয়া পরিচয় দেন সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি আপোষমুলক ভাবে বিভাজন ব্যক্তির আইন ধারা বাটোয়ারা কার্যকরী হইবে। এই রূপ বাটোয়ারার পর একটি বাটোয়ারা দলীল প্রস্তুত করিতে হইবে এবং ১৯০৮ সনের রেজিস্ট্রেশন আইনে রেজিস্ট্রি করিতে হইবে। (২) এইরূপ বাটোয়ারা চুক্তি প্রস্তুত এবং রেজিস্ট্রেশনের পর রাজশ্ব অফিসার খতিয়ান সংশোধন করবেন। সুতরাং কোন ব্যক্তি কোন জমির মালিকানা লাভ করার পর তার নাম সংশ্লিষ্ট খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা বা তার নিজ নামে নতুন খতিয়ান খোলার যে কার্যক্রম তাকে খারিজ/ নামজারী বা মিউটেশান বলে। সাধারণত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জরিপের মাধ্যমে রেকর্ড সংশোধন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। ফলে দুই জরিপের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে জমি প্রাপ্তির ফলে কিংবা দলিলের মাধ্যমে জমি হস্তান্তরের ফলে ভূমির মালিকানার পরিবর্তনে খতিয়ান হালনাগাদকরণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সহকারী কমিশনার (ভূমি) খারিজ/ নামজারী বা মিউটেশনের মাধ্যমে খতিয়ান হালকরণের কাজ করে থাকে। আশা রাখি এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় খতিয়ান সৃজন সংক্রান্ত বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভে সহযোগী হবে।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযে ফুলের খুশবুতে সারা জাহান মাতোয়ারা
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক অর্থনীতি অলিম্পিয়াড-২০২০ এবং বাংলাদেশের অর্জন