জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ at ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ

সূরা ফীল’র তাৎপর্য ও শিক্ষা

সূরা ফীল প্রসঙ্গ: সূরা ফীল মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ১০৫ তম সূরা, মক্কী সূরা হিসেবে প্রসিদ্ধ, এতে রুকু সংখ্যা একটি, আয়াত সংখ্যা পাঁচটি, শব্দ সংখ্যা বিশটি, বর্ণ সংখ্যা ছিয়ানব্বই।
সূরার অনুবাদ: ১. হে মাহবুব! আপনি কি দেখেন নি, আপনার প্রতিপালক ঐ হস্তী আরোহী বাহিনীর কি অবস্থা করেছেন? ২. তিনি কি তাদের যাবতীয় চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি, ৩. এবং তিনি তাদের উপর (ঝাঁকে ঝাঁকে) আবাবীল পাখি প্রেরণ করেছেন, ৪. এ পাখীগুলো (এ সুসজ্জিত) বাহিনীর উপর কংকর পাথর নিক্ষেপ করছিল, ৫. অত:পর তাদেরকে ক্ষেতের তৃণ সদৃশ করেছেন। (সূরা: ফীল, আয়াত: ১-৫)
সূরা ফীল’র সংশ্লিষ্ট ঘটনা: আরব দেশ ইয়ামেন ও হাবশাহ তথা আবিসিনিয়ার বাদশাহর নাম ছিল আবরাহা, সে ইয়ামেনের রাজধানী সানআয় মূল্যবান মর্মর পাথর খচিত একটি উপাসনালয় (গীর্জা) নির্মাণ করেছিলো। আবরাহা দেখতে পেলো ইয়ামেনবাসীরা নিজেদের নযর মান্নত উপটোকন কা’বা মুয়াযযমায় প্রেরণ করছে। ক্বাবার প্রতি ইয়ামেনবাসীদের এ সম্মানবোধ তার সহ্য হলো না। তার অন্তরে কাবা ঘরের প্রতি হিংসার আগুন জ্বলে উঠলো, তার মনোবাসনা ছিলো হজ্বব্রত পালনকারীগন মক্কা মোকাররমার পরিবর্তে তার নির্মিত উপসনালয়ে এসে তাওয়াফ করুক, সে তার নির্মিত উপাসনালয়ের নাম রাখলো ক্বালীস, সে বাধ্য করে ইয়ামেনবাসীদের দ্বারা তার নির্মিত গীর্জার তাওয়াফ করাতে শুরু করলো, মক্কার প্রতি অনুরাগী আরববাসীদের নিকট এ দৃশ্য খুবই কষ্টদায়ক ছিলো, বনী কানানাহ গোত্রের যোবায়র ইবনে আমর মক্কী নামক এক ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে আবরাহার গীর্জায় প্রবেশ করে পায়খানা করে গীর্জা আবর্জনাময় করে দিলো। অত:পর মক্কার এক মুসাফির কাফেলা গীর্জার সন্নিকটে আগুন প্রজ্বলিত করলে আগুনের ফুলিঙ্গ গীর্জায় গিয়ে পড়লো এতে গীর্জা ভস্মিভূত হয়ে পুড়ে গেল। এতে আবরাহা ভীষণ ক্রোধান্বিত হলো, তার বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে ক্বাবা গৃহ ধ্বংস করার অঙ্গীকার করলো। তার সৈন্যবাহিনীর অসংখ্য হাতী ছিলো। ক্বাবাঘর ধ্বংসের অভিপ্রায়ে আবরাহা তার বিশাল সৈন্য বাহিনী ও হাতির বিশাল বহর নিয়ে মক্কায় পৌছলো, বড় হাতির নাম ছিল মাহমুদ, আবরাহা মক্কাবাসীদের জীবজন্তুগুলো আটক করে নিলো, তম্মধ্যে হযরত আবদুল মুত্তালিবের দু’শ উট ছিলো হযরত আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য আবরাহার শরণাপন্ন হলেন, আবরাহাও তাঁর প্রতি সম্মান জানালো, আবরাহা উদ্দ্যেশ্য জানতে চাইলে হযরত আবদুল মুত্তালিব বললেন, আমার উটগুলো ফেরত দেয়া হোক। এ কথা শুনে আবরাহা আশ্চর্য হলেন, হযরত আবদুল মুত্তালিবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি আপনাদের ও আপনার পূর্ব পূরুষদের পবিত্র স্থান ক্বাবা শরীফকে ধ্বংস করার জন্য এসেছি, মনে করেছিলাম আপনি ক্বাবা শরীফকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করার আবেদন নিয়ে এসেছেন। আপনি দেখছি ক্বাবা ঘরের ব্যাপারে কিছুই বললেন না। বরং নিজের উটগুলো রক্ষার কথাই বলছেন। হযরত আবদুল মুত্তালিব উত্তর দিলেন, উটগুলোর মালিক আমি নিজেই এ জন্য উটগুলোর কথা বলছি। ক্বাবা ঘরের মালিক স্বয়ং আল্লাহ, যিনি এ পবিত্র গৃহের মালিক তিনিই এ ঘরের হিফাজত করবেন। হযরত আবদুল মুত্তালিব পবিত্র ক্বাবা দরজার নিকট গিয়ে ক্বাবার মালিক মহান আল্লাহর দরবারে কা’বা ঘর হিফাজতের প্রার্থনা করলেন, এদিকে আবরাহা তার বিশাল বাহিনীকে খুব ভোরে মক্কা আক্রমনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলো, সৈন্যদল হাতির বিশাল বহর প্রস্তুত করে নিলো, হঠাৎ পরিস্থিতি পাল্টে গেল, বড় হাতি মাহমুদ ক্বাবার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল না, হঠাৎ দেখা গেল জিদ্দার দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ রং এর আবাবীল পাখি আত্ন প্রকাশ করলো সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আগত প্রত্যেকটি ছোট ছোট পাখীর নিকট তিনটি করে কংকর ছিল দু’টি দু’পায়ে, একটি ঠোঁটেু। পাখীগুলো হস্তী বাহিনীর উপর এমন ভাবে কংকর নিক্ষেপ করছিল কংকরগুলো সৈন্যের মস্তক দিয়ে প্রবেশ করে দেহ ছিদ্র করে হাতীর দেহে প্রবেশ করে মাটি পর্যন্ত ছেদ করতো, প্রতিটি কংকরে আবরাহার কাফির সৈন্যের নাম লিখা ছিল, যে কংকরে যে সৈন্যের নাম লিখা ছিলো সেটা সে কাফির সৈন্যের দেহে পতিত হয়ে মস্তক ছিদ্র করে দেহ ভেদ করে মাটি পর্যন্ত ছেদ করছিল। এভাবে মহান আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারী খোদাদ্রোহী আবরাহার দাম্ভিকতা ও সকল চক্রান্তকে ক্ষুদ্র সৃষ্টি দিয়ে নস্যাৎ করে দিলো। [তাফসীরে খাযাইনুল ইরফান, কৃত: সদরুল আফাযিল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ নঈমউদ্দীন মুরাদাবাদী (র.), তাফসীরে নূরুল ইরফান, কৃত: মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]
সূরা ফীল’র শিক্ষা ও তাৎপর্য: আজকের এ যুগেও পশ্চিমা বিশ্ব খোদাদোহী কুফরী শক্তি ইসলামের অগ্রযাত্রা ও মুসলামানদের ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ম্লান করতে বিশ্বব্যাপী নানাবিধ কূটকৌশল ও বহুমাত্রিক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মুসলিম উম্মাহর অনৈক্য, দূর্বলতা ও অসহায়ত্বের এ সুযোগে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র অপশক্তিগুলো আজ দোদু- প্রতাপে নিজের অবৈধ কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের মহড়া প্রদর্শন করছে। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র ভূমি আজ জালিম, অত্যাচারী, বর্বর, পাপিষ্ট, সন্ত্রাসী, ইসরাঈলীদের নির্মমতা ও বর্বরতার শিকার। মজলুম ফিলিস্তিনি মুসলমানদের আর্তনাদে পূণ্যভূমি আজ রক্তাক্ত, নিগৃহীত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, মুসলমানরা আজ নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত। সমগ্র দুনিয়া জুড়ে আগ্রাসী শক্তির তান্ডব লীলা ও বিজয় উল্লাস সত্ত্বেও ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত মুসলমানদের কণ্ঠে কলেমার আওয়াজ আজো উচ্চকিত। মহান আল্লাহ যিনি আবরাহার সকল চক্রান্ত অনায়াসে ব্যর্থ করে দিয়েছেন বর্তমানেও ইসলাম বিদ্বেষী সকল চক্রান্ত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, খন্ড-বিখন্ড করে মুসলমানদের প্রাধান্য ও কর্তৃত্বকে বিশ্বব্যাপী পূণ:প্রতিষ্ঠিত করে মুসলমানদেরকে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
আবাবীল শব্দের ব্যাখ্যা: আবাবীল শব্দটি বহুবচন এর একবচন নেই। হযরত হাম্মাদ ইবনে সালমা (রা.) ও হযরত আবু সালমা ইবনে আবদুর রহমান (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেন, আবাবীল অর্থ ঝাঁকে ঝাঁকে। হযরত হাসান বসরী ও হযরত কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, আবাবীল অর্থ “আল কাসীরা” অর্থ বিপুল সংখ্যক। হযরত ইকরিমা (রা.) “ত্বাইরান আবাবীল’র” ব্যাখ্যায় বলেন, পাখীগুলোর রং ছিল সবুজ, পাখিগুলো ছিল সামুদ্রিক যে গুলোর মাথা ছিল হিংস্র জন্তুর মস্তকের মতো। পাখীগুলো হস্তীবাহিনীর মাথার উপর এসে সারিবদ্ধভাবে উচ্চস্বরে আওয়াজ তুলে ঠোঁঠে রাখা কংকরগুলো নিক্ষেপ করেছিল। তাফসীরে ইবনে কাছীর’র বর্ণনা মতে, আবরাহার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল বিশ হাজার। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে শুভাগমনের পঞ্চাশ দিন পূর্বে আবরাহার হস্তী বাহিনীর ঘটনা সংঘঠিত হয়েছিল। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আমি হাতী চালকদের অন্ধ ও পুঙ্গ অবস্থায় মক্কা অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতে দেখেছি। [তাফসীর ইবনে কাছীর, একাদশ খন্ড, পৃ: ৫৯৮, কৃত: আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাছীর (র.)]
আবরাহার বড় হাতী মাহমুদ’র পরিচয়: আবরাহার বড় হাতীর নাম ছিল মাহমুদ, যেটা আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশী আবরাহাকে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে হাবশা থেকে প্রেরণ করেছিলেন, দেহাবয়ব ছিল বিরাটকায় পাহাড়গম। হাতীটির রং ছিলো সাদা। (তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা, ৩০, পৃ: ১০৪৮)
কাবা গৃহের প্রতি বড় হাতীর সম্মান প্রদর্শন: আবরাহা খুব ভোরে হাতীর বিশাল বহর প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলো কিন্তু বড় হাতীটি উঠানো সম্ভব হলোনা। হাতীটিকে কোন ভাবেই কা’বার দিকে অগ্রসর করা সম্ভব হলো না, অন্যদিকে চালাতে চাইলে চলে। যখনই কা’বার দিকে অগ্রসর করার চেষ্টা করা হতো তখনই হাতীটি বসে পড়তো। এ ছিল কা’বার প্রতি হাতীর সম্মান প্রদর্শন। [তাফসীরে ফুয়জুর রহমান, পারা:৩০, পৃ: ১০৪৭, কৃত: আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসী (র.)]
হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র ক্বা’বা ঘরকে হিফাজত করুন, দ্বীনের শত্রুদের সকল প্রকার চক্রান্ত ও পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিন। আমাদের অন্তরে পবিত্র ঘর বায়তুল্লাহ শরীফের ভালোবাসা বৃদ্ধি করে দিন। আমাদেরকে ঈমানের উপর ইস্তিকামত নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৃত্যু আজিকে হইলো অমর
পরবর্তী নিবন্ধবেগম মুশতারী শফী : এক অগ্নিশিখার মহাপ্রস্থান