জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৬ মার্চ, ২০২১ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে শবে বরাতের গুরুত্ব
শাবান শব্দের তাৎপর্য: শাবান আরবি শব্দ। আরবি বর্ণমালার পাঁচটি বর্ণের সমষ্টি হলো শাবান। শীন, আঈন, বা-আলিফ, নূন, “শীন” বর্ণ শরফুন তথা মর্যাদার দিকে ইঙ্গিতবহ। “আঈন” বর্ণ উলুব্বুন তথা উচ্চ, উন্নত অর্থের ইঙ্গিত সূচক, “বা” বর্ণ বিররুন তথা পুণ্য অর্থ প্রকাশক। ‘আলিফ’ বর্ণ উলফাতুন তথা ভালবাসা অর্থ জ্ঞাপক। “নূন” বর্ণ নুরুন তথা জ্যোতি, আলো অর্থ প্রকাশক। এ বরকতময় মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে নেক বান্দাদের জন্য উপরোক্ত দয়া, অনুগ্রহ, দান, করুণা, রহমতের সওগাত অবারিত ও উন্মক্ত। কল্যাণের মাস শাবান, বরকত নাযিলের মাস শাবান, পাপরাশি মোচনের মাস শাবান, গুণাহসমূহ বিলুপ্তির মাস শাবান, নবীজির উপর অধিক হারে দরুদ-সালাম পরিবেশনের মাস শাবান।
পবিত্র কুরআনের আলোকে শবে বরাত: আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, অর্থ: হা-মীম সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, আমি সেটাকে বরকতময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী, তাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ বিভাজন করে দেয়া হয়। আমার তরফ থেকে নির্দেশক্রমে নিশ্চয় আমি প্রেরণকারী। আপনার পালন কর্তার পক্ষ হতে রহমত। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। (সূরা দুখান আয়াত: ১-৬)
বর্ণিত আয়াতে “লায়লাতুম মুবারাকা” এর ব্যাখ্যা মুফাসসিরকুলের শিরোমনি হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বর্ণনা করেন, “হামীম” অর্র্থ আল্লাহর ফায়সালা যা কিয়ামত অবধি সংঘটিত হবে। “কিতাবুল মুবীন” দ্বারা আলকুরআন “লায়লাতুল মুবারাকা” হলো অর্ধ শাবানের রজনী এটি হলো লায়লাতুল বারাত। (সূরা: দুখান, আয়াত: ১-৪)
তাফসীরে কুরতুবীতে “লায়লাতুম মুবারাকা” দ্বারা লায়লাতুল ক্বাদর বুঝানো হয়েছে। কারো কারো মতে এর দ্বারা “লায়লাতুন নিস্‌ফে মিন শাবান” অর্ধ শাবানের রজনী অর্থাৎ শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রজনী বুঝানো হয়েছে। এ রজনীর চারটি নাম রয়েছে। ১. লায়লাতুম মুবারাকা বা বরকতময় রজনী, ২. লায়লাতুল বারাত বা মুক্তির রজনী, ৩. লায়লাতুচ্ছেক তথা পুরস্কারের সনদ প্রাপ্তির রজনী, ৪. লায়লাতুল কাদর বা ভাগ্যনির্ধারণ রজনী। (তাফসীরে সাবী)
“লায়লাতুম মুবারাকা” বলার কারণ হলো এ রজনীতে মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের উপর অসংখ্য বরকত কল্যাণ ও সওয়াব দান করেন। (তাফসীরে কুরতুবী, খ: ১৬, পৃ: ১২৬)
মোল্লাআলীক্বারী প্রণীত হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিরকাতে উল্লেখ হয়েছে সালফে সালেহীনদের মতে বর্ণিত আয়াতে “লায়লাতুল মোবারাকা” দ্বারা উদ্দেশ্য শাবানের ১৫ তারিখ রজনী। (তুহফাতুল আহওয়াজী : ৩/৩৬৭ পৃ:)
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রা.)’র মতে “লায়লাতুল মোবারকা” সেটি হলো শাবানের ১৫ তারিখের রজনী। (শাওকানী: ফতহুলকদীর ৪/৬৫৩ পৃ)
হাদীস শরীফের আলোকে শবে বরাত:
১. হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন শাবানের মধ্যরাত হবে তখন তোমরা রাত্রি জাগরণ করো ও দিনের বেলায় রোজা রাখো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা সে রাতে সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে তাঁর তাজল্লী, প্রভা প্রকাশ করেন এবং বলতে থাকেন ক্ষমা প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। জীবিকা প্রার্থী কেউ আছে কি? আমি তাকে জীবিকা দান করবো, বিপদগ্রস্ত কেউ আছে কী? আমি তাকে মুক্ত করে দিব। কেউ আছে কি, কেউ আছে কি? এভাবে বরাতের ভোর তথা সূর্যোদয় হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর ঘোষণা আসতে থাকে। (ইবনে মাযাহ শরীফ: ১/৪৪৪)
২. লায়লাতুল বারাতে বান্দার সারা বছরের বাজেট নির্ধারণ করা হয়, এ প্রসঙ্গে হযরত ইকরামা বর্ণনা করেন। লায়লাতুম মুবারাকা অর্থ হলো লায়লাতুম নিসফে মিন শাবান তথা শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রজনী, এ রাতে বছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়। জীবিতদের থেকে মৃতদের তালিকা চূড়ান্ত হয়। হাজী ছাহেবানদের তালিকা লিপিবদ্ধ হয়। তালিকা থেকে কাউকে বাদ দেওয়া হবে না বা বৃদ্ধি করা হবে না। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী, খ.২৫, পৃ: ১৭৪)
৩.প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা অর্ধ শাবানের রজনীতে তাঁর তজল্লী কৃপাদৃষ্টি দান করেন। তিনি শিরককারী ও পরস্পর বিদ্বেষকারী ফাসাদ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ছাড়া তাঁর সকল বান্দাকে মার্জনা করেন। (ইবনে মাজাহ, পৃ: ৯৯)
বরকতময় রাত সমূহ: গাউসুল আযম শায়খ সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী (র.) বলেন, বৎসরে যে রজনীগুলোতে নফল ইবাদত করা অতি উত্তম ও মুস্তাহাব শরীয়তের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম তার সংখ্যা ১৪ টি উল্লেখ করেছেন, যথাক্রমে ১.মহররম মাসের প্রথম রাত ২. আশুরার রাত ৩. রজব মাসের প্রথম রজনী ৪. রজব মাসের ১৫ তম রাত ৫. ২৭ রজব মিরাজের রজনী ৬. ১৫ শাবান বরাতের রজনী ৭. শাওয়ালের প্রথম রাত ঈদের রাত ৮. আরাফাতের রাত ৯ জিলহজ্ব ৯. কোরবানীর ঈদের রাত ১০ জিলহজ্ব (১০-১৫) রমজানের শেষ দশকের বিজোড় ৫ রজনী (২১,২৩,২৫,২৭,২৯ রমজানের বেজোড় রজনী সমূহ)
নফল রোযা ও নফল নামায: হযরত ওসামা বিন যায়েদ (র.) থেকে বর্ণিত, আমি আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে এত রোযা রাখতে কোন মাসে দেখিনি যে রকম শাবান মাসে রোযা রাখেন, নবীজি এরশাদ করেন এটা বরকতময় মাস। এ মাসে বিশ্বজগতের প্রভুর দরবারে আমল সমূহ পেশ করা হয়। আমি চাই আমার আমল রোযা অবস্থায় আল্লাহর দরবারে পেশ করা হোক। হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান মাস ছাড়া আর অন্য কোন মাসে পূর্ণ মাস রোজা রাখতে দেখিনি যে মাসে সর্বাধিক নফল রোজা রাখতেন সে মাসটি হলো শাবান মাস। (আবু দাউদ শরীফ, হদীস নং : ২৪৩৪)
কবর যিয়ারত পুণ্যময় আমল: লায়লাতুম মিন নিছফে শাবান বা শবে বরাতের আমল নবীজির অসংখ্য হাদীস শরীফ ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও বুজুর্গানেদ্বীনের আমল ও এতদসংক্রান্ত মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত। উম্মুল মুমোনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হারিয়ে ফেললাম। (অর্থাৎ রাত্রে বিছানায় পেলাম না) ঘর হতে বের হয়ে জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে দেখতে পেলাম। (সুনানে তিরমিযী, বাব লাইলাতুম মিন নিসফি শাবান, খন্ড ১, পৃ: ১৫৬)
হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী চার মাযহাবে লায়লাতুল বরাতে ইবাদত বন্দেগী স্বীকৃত: হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফাতওয়া গ্রন্থ “আলমগীরি’তে উল্লেখ আছে, সপ্তাহের ৭ দিনের যে কোন দিনে যিয়ারত করতে নিষেধ নেই তবে কবর যিয়ারতের জন্য চারটি দিন উত্তম বলা হয়েছে, যথা: সোমবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার। শুক্রবার জুমার নামাযের পর যিয়ারত করা উত্তম। শনিবার সূর্যোদয়ের সময়, বৃহস্পতিবারে দিবসের প্রথম ভাগে বা দিবসের শেষ ভাগে অনুরূপ বরকতময় রাত সমূহে বিশেষ করে লায়লাতুল বরাতে কবর যিয়ারত করা উত্তম। (ফাতওয়া-এ আলমগীরি, খন্ড: ৫, পৃ: ৩৫০)
সন্তানের দুআয় পিতার মর্যাদা বুলন্দ হয়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে নেককার বান্দাদের মর্যাদা বুলন্দ করেন। বান্দা আল্লাহর দরবারে আবেদন করেন, হে আল্লাহ এ মর্যাদা আমার কিভাবে অর্জিত হল? তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন তোমার সন্তানের দুআর বদৌলতে। (শরহুস সুদূর, পৃ: ৩৭, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড ২, পৃ: ৫২৭)
শবে বরাতে করণীয়: এ রাতে অধিক পরিমাণ নফল নামায, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত, দরুদ সালাম পাঠ, মিলাদ শরীফ পাঠ, গরীব মিসকীন, অভাবী বান্দাদের দান সাদকা করা, মাতা-পিতা, আউলিয়ায়ে কেরাম ও মুরব্বীদের কবর যিয়ারত করা উত্তম ও বরকতময় আমল হিসেবে কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী মনীষীগণের আমল দ্বারা স্বীকৃত ও অনুমোদিত।
শবে বরাতে বর্জনীয়: এ পুণ্যময় রজনীর মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষা প্রতিটি ঈমানদারের কর্তব্য। এ রাতের ইবাদত বন্দেগী পরিহার করা অথবা সময় বিনষ্ট করা, দলবদ্ধভাবে ঘুরাঘুরি করা,আড্ডাবাজি করা, আতশবাজি করা, ফটকা ফুটানো গর্হিত ও অসামাজিক শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া জগন্যতম অপরাধ। বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কবরে মাযারে অহেতুক মোমবাতি আগরবাতি লোবান জ্বালানো সম্পূর্ণরূপে ইসরাফ তথা অপচয়। শরীয়তে অপচয় নিষিদ্ধ। কবরবাসী, মাযারবাসী, নেককার বান্দাগণ আগরবাতি ও লোবানের মুখাপেক্ষী নন। এ সব অপপ্রয়োজনীয় কাজ দ্বারা মৃত ব্যক্তির উপর অনধিকার চর্চা ও অবৈধ হস্তক্ষেপ করা হয়। (ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ, খন্ড ৪র্থ, পৃ: ১৪১, ১৮০,১৮১, ফাতওয়া-এ আফ্রিকা, পৃ: ৭০), যে সব কাজ দ্বীনি কল্যাণ ও দুনিয়াবী বৈধ কল্যাণ থেকে শূন্য হয় তা অর্থহীন অনর্থক কাজ হিসেবে পরিগণিত। যা শরীয়ত অনুমোদন করে না। (ইরশাদাত-ই আলা হযরত)। হে আল্লাহ আমাদের কে আপনার সু-পথ প্রাপ্ত মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
বন্দর; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা আমার
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়