জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আসমানী কিতাবের সমূহের প্রতি ঈমান
সম্মানিত ইসলামী ভাইয়েরা! যুগে যুগে নবী রাসূলগণের উপর আসমানী কিতাব ও অসংখ্য সহীফা অবতীর্ণ হয়েছে এর প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। তবে পবিত্র কুরআনে প্রসিদ্ধ চার খানা কিতাব ও কয়েকটি সহীফার অবতরণের কথা ঘোষিত হয়েছে। সংক্ষিপ্ত বা সামগ্রিকভাবে নাযিলকৃত সব আসমানী কিতাবের উপর ঈমান আনা মু’মিন মুসলমানদের উপর ফরজ করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআন ও পূববর্তী সকল কিতাবের উপর ঈমান আনা ফরজ:হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু থেকে সর্বশেষনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আলকুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের উপর ঈমান না থাকলে মু’মীন হিসেবে গণ্য হবে না। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “(মুত্তাকী তারাই) যারা ঈমান আনে আপনার (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপর অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি এবং আপনার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি।” (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ৪) বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর নাঈমী প্রণেতা হাকিমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র.) বলেন, যেমনিভাবে পবিত্র কুরআন মেনে নেওয়া অপরিহার্য তেমনি আসমানী কিতাবের উপর ঈমান রাখা আবশ্যকীয়। তবে এ ক্ষেত্রে ঈমান নেয়ার মধ্যে দু’ধরনের পার্থক্য রয়েছে। ১. সমস্ত কুরআন মেনে নেয়াও অপরিহার্য এবং এর (মুহকাম) (যেগুলোর অর্থ সুস্পষ্ট) আয়াতগুলোর ওপর আমল করাও অপরিহার্য। ২.অন্যান্য আসমানী কিতাবগুলো পূর্ববর্তী নবীদের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল সবগুলো সত্য। কিন্তু সেগুলোর উপর আমল করা আমাদের উপর কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত নয়।
পবিত্র কুরআনের বিধানবলী সবিস্তারে জানা অপরিহার্য। কিন্তু পূর্ববর্তী কিতাবগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা আমাদের জন্য প্রয়োজন নেই। (তাফসীর নাঈমী, ১ম খন্ড)
প্রসিদ্ধ আসমানী কিতাব সমূহ: নবী রাসূলগণের উপর অবতীর্ণ আসমানী চারটি, প্রসিদ্ধ কিতাব ও কয়েকটি সহীফার বর্ণনা পবিত্র কুরআনে এসেছে প্রথম: ১. সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর হযরত জিবরীল আমীন (আ:) এর মাধ্যমে ২৩ বৎসর ব্যাপী কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “বরকতময় সেই মহান সত্তা তাঁর বান্দার (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র প্রতি ফুরকান (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন। যেন তিনি সমগ্র জগতবাসীকে ভীতি প্রদর্শন করেন। (সূরা: ফুরকান, আয়াত: ১) যে কুরআন মানবজাতির জন্য খোদা প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “আমি প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ আপনার প্রতি কিতাব (কুরআন) অবতীর্র্ণ করলাম।” (সূরা: নাহল, আয়াত: ৮৯) যে কুরআনের আদ্য প্রান্ত প্রতিটি অক্ষর প্রতিটি শব্দ প্রতিটি বাণী এতে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা নিরেট অকাট্য সত্য এতে সন্দেহ সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “এই সেই কিতাব এতে কোন সন্দেহ সেই। মুত্তাকীদের জন্য তা পথ নির্দেশক।” (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২) এ কুরআনে রয়েছে উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা (রা.)’র প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে ৬৬৬৬টি আয়াত।
কুরআন আল্লাহর সর্বোত্তম বাণী: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সর্বোত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, সবচেয়ে উত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো পথ।” (সহীহ মুসলিম)
আল্লাহর কিতাব গোমরাহী থেকে রক্ষা করে: আল্লাহর কিতাব ও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বান্দাকে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ নির্দেশিকা। এরশাদ হয়েছে, হযরত মালিক ইবন আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দুটিকে শক্তভাবে আঁকডে ধরবে কখনও তোমরা বিভ্রান্ত হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত (হাদীস)। (মুয়াত্তা) দ্বিতীয় তাওরাত: এটি হযরত মুসা (আ.) উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “তিনি (আল্লাহ) সত্যসহ আপনার প্রতি কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন যা এর পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের সমর্থক। আর তিনি অবতীর্ণ করেছেন তাওরাত ও ইনজীল ইতোপূর্বে মানব জাতির সৎপথ প্রদর্শনের জন্য। এবং তিনি ফুরকানও অবতীর্ণ করেছেন।” (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৩-৪) আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন, “এবং আমি নিশ্চয়ই মুসাকে (আ.) কিতাব দিয়েছি, এবং তাঁর পর পর্যায়ক্রমে রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি।” (সূরা: বাকারা, আয়াত: ৮৭) তৃতীয় যবুর: এটি অবতীর্ণ হয়েছিল হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম’র উপর। পবিত্র কুরআনে যবুর সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, “আমি উপদেশের উপর যবুর কিতাবে লিখে দিয়েছি যে, আমার যোগ্যতা সম্পন্ন বান্দাগণ পৃথিবীর অধিকারী হবে। এতে রয়েছে বাণী সে সম্প্রদায়ের জন্য যারা ইবাদত করে।”(সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ১০৫-১০৬) আরো এরশাদ হয়েছে, “এবং আমি দাউদকে যবুর দিয়েছিলাম। (৪:১৬৩) চতুর্থ ইঞ্জিল: এটি হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম’র উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব। হযরত ঈসা (আ.)’র উপর ইনজীল শরীফ অবতীর্ণ হওয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “মরিয়ম তনয় ঈসাকে তাঁর পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে ওদের পশ্চাতে প্রেরণ করেছিলাম এবং তার পূবে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে এবং মুত্তাকীদের জন্য পথ নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাকে ইনজীল দিয়েছিলাম তাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো। (সূরা: মায়িদা, আয়াত: ৪৬) বর্ণিত প্রসিদ্ধ চারটি আসমানী কিতাব ব্যতীত পবিত্র কুরআনে হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত মুসা (আ.)’র সহীফার কথা উল্লেখ হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, “এ তে আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থে ইবরাহীম ও মুসার গ্রন্থে।” (সূরা: গাশিয়া, আয়াত: ১৮-১৯) এতে বুঝা যায় হযরত মুসা (আ:)’র উপর তাওরাত ছাড়াও কিছু সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল। এভাবে নবী ও রাসূলগণের যে আসমানী কিতাব ও সহীফা সমূহ নাযিল হয়েছিল এর কতিপয়ের বর্ণনা কুরআনে উল্লেখ করেছেন আরো অনেক কিতাব সহীফা রয়েছে যেগুলোর বর্ণনা আল্লাহ তা’আলা কুরআনে দেননি। তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল এসব কিতাব বর্তমানে পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকলেও এগুলো পৃথিবীর কোথাও অবিকৃতরূপে নেই। ইহুদী খৃষ্টানগণ এতে মনগড়া সংযোজন বিয়োজন করে বহু বিকৃতি তারা করেছে। হযরত মুসা (আ:)’র উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব তাওরাত। তিনি আল্লাহর রাসূল হিসাবে নির্বাচিত হন। (সূরা: কাসাস, আয়াত: ২৮-৩০) মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁকে আসমানী কিতাব ও বিশেষ মু’জিযা দান করেন। তাঁর লাটি মাটিতে নিক্ষেপ করলে তা জীবিত সর্পে পরিণত হতো। তাঁর হাত মুবারক বগলের নীচ থেকে বের করলে শ্বেতশুভ্র সমুজ্জ্বল আলোকিত হয়ে যেত। (সূরা: তা-হা, আয়াত: ১৭-২২) হযরত মুসা (আ:) ২৭ রজব থেকে ৬ রমজান পর্যন্ত ৪০ দিন তুর পাহাড়ে অবস্থান পূর্ণ করা এর পর আল্লাহর পক্ষ থেকে আসমানী কিতাব তাওরাত শরীফ লাভ করেন। তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে, তুর পাহাড়ে মুসা (আ.) রোজা অবস্থায় আল্লাহর ধ্যানে নিমজ্জিত ছিলেন। আসমানী কিতাব ১০৪টি, প্রসিদ্ধ কিতাব চারটি, ১০০টি হলো সহীফা। যথা: আদম (আ.)’র উপর অবতীর্ণ ১০টি, হযরত শীষ (আ.)’র উপর অবতীর্ণ ৫০টি, হযরত ইদ্রিস (আ.)’র উপর ৩০টি, হযরত ইবরাহীম (আ.)’র উপর ১০টি, দাউদ (আ.)’র উপর অবতীর্ণ যাবুর কিতাব টি আল্লাহর গুণাগান ও প্রশংসায় ভরপুর ছিল। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সুমধুর কন্ঠের অধিকারী করেছিলেন। তাঁর তিলাওয়াতে ছিল খোদা প্রদত্ত এক অসাধারণ আকর্ষণ। ইনজীল শরীফ হযরত ঈসা (আ.)’র উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব।
একমাত্র আলকুরআনই অবিকৃত: যুগে যুগে ইয়াহুদী খুস্টানগণ সংযোজন বিয়োজন পরিবর্তন পরিমার্জন করে মূল অস্তিত্বকে ক্ষত বিক্ষত করেছে। একমাত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআনই অবিকৃত ঐশীগ্রন্থ হিসেবে যেমনটি নাযিল হয়েছিল তেমনটি চির কালেই থাকবে। এর প্রতিটি সূরা আয়াত যবর যের পেশ দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনসহ লক্ষ লক্ষ হাফিজে কুরআনের বক্ষে কিয়ামত অবধি সংরক্ষিত থাকবে। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “এ কুরআন আমিই নাযিল করেছি আর আমিই এর সংরক্ষণকারী।” মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের বরকত ও হেদায়ত নসীব করুন। নিশ্চয় আপনি দানশীল সৃষ্টি জগতের মালিক পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।
লেখক : খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআলোর পথযাত্রী
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাভাইরাস টিকা প্রদানে উৎসবের আমেজ : প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য