জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

সুন্নাত নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করুন! পঞ্জেগানা নামায আদায় করুন। ফরজ ও সুন্নাত নামাযের প্রতি যত্নবান হোন। আল্লাহ ও তদীয় রসূলের আনুগত্য করুন, কুরআন ও সুন্নাহর বিধি মোতাবেক আমল করুন।
সুন্নাতের অর্থ ও তাৎপর্য: প্রখ্যাত অভিধানবেত্তা ইবনুল মানযুর বলেন, “সুন্নাহ শব্দের অর্থ হলো রীতি, পদ্ধতি, পথ, নিয়ম, জীবন-চরিত।” (লিসানুল আরব ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ৩৯৯)
কুরআন ও হাদীসে সুন্নাত শব্দের ব্যবহার: পবিত্র কুরআনের বহুস্থানে সুন্নাত শব্দের উল্লেখ রয়েছে, এরশাদ হয়েছে, “আমার রাসূলগণের মধ্যে আপনার পূর্বে যাদেরকে পাঠিয়েছিলাম, তাদের ক্ষেত্রেও ছিল এরূপ নিয়ম আর আপনি আমার নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবেন না। (সূরা: আলা ইসরা: আয়াত: ৭৭)
এভাবে পবিত্র কুরআনের ১১টি আয়াতে ১৪বার সুন্নাত শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। মহান আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “পূর্বে যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি তুমি কখনো আল্লাহর রীতিতে কোন পরিবর্তন পাবে না। (সূরা: আল আহযাব: আয়াত: ৬২)
হাদীস শরীফে সুন্নাতের বর্ণনা: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এরশাদ করেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিষ রেখে যাচ্ছি যা আঁকড়ে থাকলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না । একটি হলো আল্লাহর কিতাব অপরটি হলো আঁধার নবীর সুন্নাহ।” (ইমাম মালিক (র.) প্রণীত আল মুয়াত্তা, হাদীস নং ৩৩৩৮)
সুন্নাত নামাযের গুরুত্ব ও ফযীলত: দৈনিক পঞ্জেগানা ফরজ নামাযের পূর্বাপর আমরা সুন্নাত নামায আদায় করি, অসংখ্য হাদীস শরীফ দ্বারা সুন্নত নামাযের গুরুত্ব ও ফযীলত প্রমাণিত। যে সব নামায নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম আদায় করেছেন। তা আমাদের জন্য সুন্নাত হিসেবে গণ্য।
সুন্নতের প্রকারভেদ: সুন্নাত দু’প্রকার। ১. সুন্নাতে মুআক্কাদাহ, ২. সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ। সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ হচ্ছে সে নামায যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম সর্বদা আদায় করেছেন। ওজর ব্যতীত কখনো ত্যাগ করেননি। যে সুন্নতের ব্যাপারে শরীয়তের তাগিদ রয়েছে বিনা ওজরে একবারও বর্জন করলে গুনাহ হবে। কোন কোন ইমামগণ সুন্নাতে মুআক্কাদাহ বর্জনকারীকে পথভ্রষ্ট হিসেবে গণ্য করেছেন। বর্জনে অভ্যস্থ ব্যক্তি ফাসিক। শরয়ী বিধানে তার সাক্ষ্য পরিত্যাজ্য। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড)
সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নামাযের রাকা’আত সংখ্যা: ফজরের ফরজের পূর্বে দু’রাকা’আত। জোহরের ফরজের পূর্বে চার রাকা’আত, পরে দু’ রাকা’আত। মাগরিবের ফরজের পর দু’ রাকা’আত। এশার ফরজের পর দু’রাকা’আত। মোট বার রাকা’আত। সুন্নাতে মুআক্কাদাহ বিধানগতভাবে ওয়াজিবের কাছাকাছি। (ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ, খন্ড: ০৩, পৃ: ২৭৯)
জুমাবারে দু’রাকাআত ফরজের পূর্বে চার রাকা’আত। ফরজের পর প্রথম নিয়্যতে চার রাকা’আত,দ্বিতীয় নিয়্যতে দু’রাকা’আত, মোট দশ রাকা’আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ আদায় করতে হবে।
হাদীস শরীফের আলোকে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নামায প্রসঙ্গ: হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি বার রাকা’আত সুন্নাত নামায নিয়মিত আদায় করে তার জন্য জান্নাতে একখানা ঘর তৈরি করা হবে। (তা হলো) জোহরের আগে চার রাকা’আত, জোহরের পরে দু’রাকা’আত, মাগরিবের পরে দু’রাকা’আত, এশার পরে দুই রাকা’আত এবং ফজরের আগে দুই রাকা’আত। (ইবনে মাজাহ, ১ম খন্ড, হাদীস নং: ১১৪০)
ফজরের দু’রাকাআতের ফযীলত: হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ফজরের দু’রাকাআত সুন্নাত সালাত দুনিয়া থেকে এবং দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবকিছু থেকে উত্তম। (সহীহ মুসলিম ১/৫০১)
জুম’আর আগে পরে সুন্নাতের বর্ণনা: জুম’আর আগে চার রাকা’আত ও পরে এক বর্ণনায় চার রাকা’আত, দ্বিতীয় বর্ণনায় ছয় রাকা’আত সংক্রান্ত সহীহ বর্ণনা রয়েছে, এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু আবদুর রহমান আস সুলামী (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন যেন আমরা জুম’আর আগে চার রাকা’আত এবং পরে চার রাকা’আত সালাত আদায় করি। (ফিকহস সুনানি ওয়াল আছার, ১ম খন্ড, ৩০২)
হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, যদি কেউ জুম’আর পর সালাত আদায় করে তবে সে যেন ছয় রাকা’আত সালাত আদায় করে (তাহাবী শরীফ)।
মাসআলা: জুম’আর পূর্বে চার রাকা’আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ, জুম’আর সালাতের পর চার রাকা’আত পড়বে। অতঃপর দু’রাকা’আত পড়বে, যেন উভয় হাদীসের উপর আমল করা হয়। (গুণীয়া, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড)
ফজর ও জোহরের সুন্নাত অত্যধিক গুরুত্ববহ: হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের পূর্বের চার রাকা’আত এবং ফজরের পূর্বের দু’রাক’আত পরিত্যাগ করতেন না। (বোখারী শরীফ)
জোহরের সুন্নাত: জোহর বা জুম’আর সুন্নাত পড়তে পারেনি, ফরজ পড়ে নিবে। ফরজের পর পূর্বের সুন্নাত পড়ে নেবে উত্তম হলো পরের সুন্নাত আদায়ের পর পূর্বের সুন্নাত পড়ে নেয়া। (ফতহুল কদীর, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড)
ফজরের সুন্নাত কাযা হলে: ফজরের সুন্নাত কাযা হল, সূর্যোদয়ের পর পড়ে নেয়া উত্তম (গুনীয়া) ফরজ নামাযের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে পড়া সর্ব সম্মতভাবে নিষিদ্ধ। (রদ্দুল মোখতার, ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ, খন্ড ৩, পৃ:৪৬২, বাহারে শরীয়ত ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২৪)
আসরের সুন্নাত: আসরের সুন্নাত শুরু করল এমতাবস্থায় জামাত শুরু হল, তখন দু’রাকাত সুন্নাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে জামাতে শামিল হয়ে যাবে, এই সুন্নাত পুনরায় পড়ার প্রয়োজন নেই। (ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ)
আসরের নামাযের পর কোন প্রকার নফল নামায পড়া নিষেধ সূর্যাস্ত এবং মাগরিবের ফরজ নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে নফল নামায পড়া নিষেধ। (দুররুল মুখতার, আলমগীরি)
আসরের ফরজের পূর্বে চার রাকা’আত সুন্নাতে যায়েদাহ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে রহমত করুন যে ব্যক্তি আসরের পূর্বে চার রাকা’আত সালাত আদায় করে। (তিরমিযী, ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার)
আসরের চার বাকা’আত সুন্নাতে যায়েদাহ সময় সুযোগের অভাবে চার রাকা’আকের স্থলে দু’রাকা’আত আদায় করারও অনুমতি রয়েছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের পূর্বে দু’রাকা’আত নামায আদায় করেছেন। (আবু দাউদ)
মাগরিবের সুন্নাত: মাগরিবের ফরজের দু’বাকা’আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের ফরজ সালাত আদায় করতেন এরপর তিনি আমার ঘরে ফিরে এসে দু’রাকাআত সালাত আদায় করতেন। (ইবনে মাযাহ, ১ম খন্ড, হাদীস নং: ১১৬৪)
মাগরিবের পর ছয় রাকা’আত আওয়াবীন নামায: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে ছয় রাকা’আত সালাত আদায় করবে এবং এর মাঝখানে কোন মন্দ কথা বলবে না। তাকে বার বছর ইবাদতের সওয়াব দেওয়া হবে। (ইবনে মাযাহ ১ম খন্ড, হাদীস নং: ১১৬৭)
মাগরীব নামাযের পর ছয় রাকা’আত সালাতুল আওয়াবীন পড়া খুবই ফযীলতপূর্ণ। হাদীস শরীফে এসেছে যে মাগরিবের পর ছয় রাকা’আত পড়বে তার গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমপরিমাণ হয়। (তাবরানী, মুমীন কী নামায, পৃ: ১২৬)
নফল ও সুন্নাত নামাযের প্রত্যেক রাকাতেই সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা মিলাতে হবে। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও দ্বিপ্রহর নিষিদ্ধ তিনটি সময় ছাড়া দিনে রাতে যে কোন সময় নফল নামায আদায় করা যায়। তবে ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং আসরের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত এবং ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর ফজরের দু’রাকা’আত সুন্নাত ব্যতীত অন্য কোন নফল নামায পড়া নিষেধ। (বাহারে শরীয়ত)
সুন্নাত ও নফল নামায ঘরে পড়া উত্তম: ফকীহগণের বর্ননা মতে সুন্নাত ও নফল নামায মসজিদের চেয়ে ঘরে পড়া উত্তম। নবীজি একদল লোককে মসজিদে নফল নামায আদায় করতে দেখে এরশাদ করেন, তোমরা এসব নামায ঘরে আদায় করবে। (তিরমিযী ও নাসাঈ শরীফ)
কিন্তু তারাবীহ নামায, তাহিয়্যতুল মসজিদ এবং সফর হতে প্রত্যাবর্তন করে দু রাকা’আত নফল নামায মসজিদে পড়া উত্তম। ইতিকাফ পালনকারী নফল নামায এবং সূর্য গ্রহণের নামায মসজিদে পড়বে। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড)
যদি ঘরে ব্যস্ততা ও একাগ্রতা কম হওয়ার আশঙ্কা হয় তখন মসজিদে পড়বে। (রদ্দুল মোখতার)
তবে অনেক সময় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম মসজিদের সুন্নাত ও নফল আদায় করতেন। তবে তারাবীহর ক্ষেত্রে জামাতের বিধান থাকার কারণে মসজিদে আদায় করা উত্তম। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড)
জুম’আর ফরজের পর সুন্নাতের সংখ্যা: জুম’আর দু’রাকা’আত ফরজের পর সুন্নাতের মুআক্কাদা’র সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে সতর্কতামূলক অভিমত হচ্ছে ছয় রাকাআত ।(দুররে মোখতার, ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ)
হে আল্লাহ আমাদেরকে ফরজ ও সুন্নাত নামায সঠিকভাবে আদায় করার তাওফিক দিন। পবিত্র কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা নাজাত দান করুন। নিশ্চয় তিনি দানশীল, সৃষ্টিজগতের মালিক, পুণ্যময়, অনুগ্রহশীল ও দয়ালু, আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা ও সামাজিক বন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধনতুন বছর হোক প্রত্যাশা পূরণের