জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

সূরা ক্বোরাইশ’র ফযীলত ও তাৎপর্য

সূরা ক্বোরাইশ প্রসঙ্গ: প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে সূরা ক্বোরায়শ মক্কায় অবতীর্ণ। এতে রুকু একটি, আয়াত সংখ্যা চার, শব্দ সংখ্যা সতেরটি, বর্ণ সংখ্যা তিয়াত্তর।
সূরার আলোচ্য বিষয়: ১. শীতকালে ও গ্রীষ্মকালে সফরের প্রতি আসক্তির বর্ণনা, ২. আল্লাহর ঘরের গুরুত্ব ও মর্যাদার আলোচনা, ৩. কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে ক্বোরাইশদের করণীয় সম্পর্কে বর্ণনা। ৪. আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই ক্বোরাইশদের মর্যাদার বর্ণনা।
ক্বোরাইশ নামকরণ: আরবের একটি প্রসিদ্ধ গোত্রের নাম ক্বোরাইশ, আরবি কারশুন শব্দ থেকে ক্বোরাইশ শব্দটি উদ্ভুত। এর অর্থ উপার্জন ও রোজগার কারা। এ গোত্রের লোকেরা ব্যবসা বানিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতো বিধায় তাদেরকে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে। এক বর্ণনা মতে সমুদ্রের বড় আকৃতি মাছের নাম যে মাছ অন্য মাছের উপর প্রভার ও প্রাধান্য বিস্তার করতো, তেমনিভাবে ক্বোরাইশ গোত্রের লোকেরা অন্য গোত্রের উপর প্রাধান্য বিস্তার করার কারণে তারা ক্বোরাইশ নামে অভিহিত। (কুরতুবী)
তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে ফিহর বিন মালিক ইবন নদ্বর ইবনে কিনানাহ এর বংশধরদেরকে ক্বোরাইশ বলা হয়।
ক্বোরাইশদের মর্যাদা: হযরত উম্মেহানী বিনতে আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা সাতটি বিষয়ে ক্বোরাইশদের মর্যাদামন্ডিত করেছেন, ১. আমি তাদের মধ্য হতে, ২. নবুওয়াত তাদের মধ্য হতে এসেছে, ৩. ক্বাবা গৃহের তত্বাবধান, ৪. হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব পালন, ৫. তাদেরকে হস্তী বাহিনীর উপর বিজয় দান করেছেন, ৬. উক্ত ঘটনার পর সব ক্বোরাইশরা দশ বছর যাবৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করেনি, ৭. আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রসঙ্গে কুরআনে পৃথক সূরা নাযিল করেছেন যে সূরায় অন্য কারো আলোচনা হয়নি, অত:পর তিনি বিসমিল্লাহসহ সূরাটি তিলাওয়াত করেন। [তাফসীরে ইবনে কাছীর, কৃত: ইমাম আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাছীর (র.) একাদশ খন্ড, পৃ: ৬০০, তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা: ৬০, পৃ: ১০৬২ কৃত: আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসী (র.)]
ক্বোরাইশ নামকরণ: নবীজি ছিলেন ক্বোরাইশ বংশের, হযরত ওয়াসেলা ইবন আসকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বণির্ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা হযরত ইসমাঈল (আ:) এর সন্তানদের মধ্যে বনু কিনানাহকে মনোনীত করেন এবং তাদের মধ্যে ক্বোরাইশকে এবং ক্বোরাইশদের মধ্যে বনু হাশিমকে এবং আল্লাহ আমাকে বনু হাশিম থেকে মনোনীত করেছেন। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং: ২২৭৬, তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং: ৩৬০৫)
সূরার সংশ্লিষ্ট তাফসীর: তৎকালীন সময়ে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে লোহিত সাগরের দুই প্রান্তে অবস্থিত ইয়ামেন ও সিরিয়া দুটি অঞ্চলই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পবিত্র মক্কা নগরী এ দু’অঞ্চলের মধ্যস্থলে লোহিত সাগরের অদূরে অবস্থিত হওয়ার প্রেক্ষিতে আরবের তথা ক্বোরাইশ বণিকরা এর সুবিধা ভোগ করছিল। আল্লাহ তা’আলা বিশেষ অনুগ্র করত ব্যবসার উদ্দ্যেশে এ দুদেশের সফর করার জন্য ক্বোরায়শদের অন্তরে আগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। শীত কালে তাদের বানিজিক কাফেলা ইয়ামেনে এবং গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় সফর করতো, মক্কার অধিবাসী হওয়ার কারণে সকলে তাদেরকে সম্মান করতো। নির্ভয়ে নির্বিগ্নে নিরাপদে তারা ব্যবসা বানিজ্যের সুযোগ লাভ করতো ব্যবসায় তারা প্রচুর লাভবান হতো আবরাহা বাদশাহর চক্রান্ত নস্যাৎ ও ক্বোরাইশ সম্প্রদায়কে নিরাপদে মুক্তিলাভের পর শত্রু ভাবাপন্ন গোত্র সমুহের মধ্যেও তাদের সম্মান ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলো অবাধ নিরাপদে ব্যবসা বাণিজ্যের দ্বার তাদের জন্য উন্মূক্ত হয়ে গেলো। মহান আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী হওয়ার কারণে তাদের জন্য এ অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন, জীবন ধারণের উপায় উপকরণ সহজতর করে দিয়েছেন। এ ছিল তাদের প্রতি মহান আল্লাহর এক বড় দয়া অনুগ্রহ ও নিয়ামত। সূরা ক্বোরাইশে আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তারা যেন কুফর শির্ক মূর্তিপূজা ত্যাগ করে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অনুগ্রহের কথা ভুলে না গিয়ে সদা সর্বদা তারই মহানত্ব শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা তাঁরই গুণগান ও মহিমা প্রকাশে নিয়োজিত থাকে এ নির্দেশই মহান প্রভূর পক্ষ থেকে বিঘোষিত হয়েছে। (কানযুল ঈমান অবলম্বনে তাফসীর খাযাইনুল ইরফান)
মক্কা নগরী শান্তির নগরী: আরব জাতির মধ্যে অরাজকতা বিশৃঙ্খলা রক্তপাত যুদ্ধবিগ্রহ কলহ বিবাদ পারস্পরিক শত্রুতা হিংসা বিদ্বেষ অনৈতিক কর্মকান্ড নারীদের প্রতি অমানবিক আচরণ নিপীড়ন নির্যাতন ছিল নিত্য নৈমিত্তিক সাধারণ বিষয়, এহেন ক্রান্তিকালে শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.) এ নগরীকে মানব ইতিহাসের নজীরবিহীন শান্তির জনপদ হিসেবে পরিণত করার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলো। ‘হে প্রতিপালক! আপনি এ শহরকে শান্তির নগরীতে পরিণত করুন।’ (সূরা: ইব্রাহীম, আয়াত: ৩৫)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবীর দুআর বদৌলতে বায়তুল্লাহ কে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য নিরাপদ ও শান্তির গৃহ হিসেবে পরিণত করেছেন, পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “যে এখানে প্রবেশ করবে, সে সব ধরনের (অবৈধ) হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদে থাকবে।” (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭)
অবিশ্বাসীরা মক্কার প্রতিবেশী হলেও তারা তাদের কর্মফল ভোগ করবে: ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে সমগ্র মানবজাতি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে মু’মিন কাফির বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলে আল্লাহর রিযক প্রাপ্ত হবে। পার্থিব জীবনের সুখ শান্তি ও ধন সম্পদের প্রাচুর্যতা পেতে পারে। কিন্তু পরকালে অবিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর রহমতের কোন অংশ থাকবেনা। আখিরাতের উত্তম প্রতিদান কেবল মুমিনদের জন্যই। তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাত ও কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক কঠিন শাস্তি। এটা হলো হযরত ইবরাহীম (আ:)’র দুআর বাস্তব প্রতিফলন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “স্মরণ করুন! যখন ইবরাহীম বলেছিল, হে প্রতিপালক! এ নগরীকে একটি নিরাপদ শহরে পরিণত করুন। এর বাসিন্দাদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে এবং পরকালে বিশ্বাসী হবে তাদেরকে নানারূপ ফলমূল দিয়ে রিযক দান করুন। আল্লাহ বললেন তবে যারা কুফরি করবে তাকেও আমি স্বল্পকালের জন্য (পার্থিব জীবনে) উপভোগের সামগ্রী দান করব। অত:পর (মৃত্যুরপর) তাকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে হেচড়িয়ে নিয়ে যাব যা কতই নিকৃষ্টতম ঠিকানা। (সূরা: আল বাক্বারা: ১২৬)
ক্বোরাইশদের প্রতি নবীজির ভাষণ: আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী হওয়ার কারণে ক্বোরাইশরা আজ সর্বত্র সম্মানিত। খোদা প্রদত্ত শান্তি ও নিরাপত্তা প্রাপ্তি তাদের জন্য এক মহান অনুগ্রহ। মহান আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদের উচিত আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করা। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে হযরত ইবন আবু হাতিম (র.) হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদ থেকে বর্ণনা করেন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ওহে ক্বোরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে নিরাপত্তা ও শান্তি দান করেছেন। অন্য হাদীসে এরশাদ হয়েছে, তিনি তোমাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছেন, ক্ষুধার্ত অবস্থায় আহার দিয়েছেন, অতএব তোমরা তাঁর একত্ববাদকে স্বীকার কর এবং তাঁর ইবাদত করো। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, একাদশ খন্ড, পৃ: ৬০২)
সূরা ক্বোরায়শ এর ফযীলত: বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে এ সূরার বিভিন্ন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, প্রখ্যাত তাফসীরকার হযরত কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী (র.) বর্ণনা করেন, আমার পীর ও মুর্শিদ হযরত মির্যা মাজহার জানে জানান আমাকে দু:খ দুর্দশা ও মুসীবতের সময় সূরা ক্বোরাইশ তিলাওয়াতের পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি আরো বলেছেন, সব ধরনের বালা মুসিবত ক্ষেত্রে পরিত্রানের জন্য এ সূরার আমল আমার নিকট বারবার পরীক্ষিত ও প্রমানিত। (তাফসীরে মাযহাবী)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে আল কুরআনের বরকত দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা-বাবার প্রতি সদাচরণ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে