জটের কবলে বন্দর

কোটি কোটি টাকা লোকসান আমদানিকারকদের

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৫ মার্চ, ২০২১ at ৪:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ভয়াবহ রকমের জটের কবলে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। একেকটি জাহাজ গড়ে এক থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান দেয়ার পর পাচ্ছে বার্থিং। বিশেষ করে খোলা পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কন্টেনার জাহাজের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে জট। কন্টেনার জটের পাশাপাশি এখন জাহাজ জট নিয়েও সংকটে পড়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কন্টেনার ও জাহাজ জট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জট সামলানোর লক্ষ্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের সাথে আলোচনা করে কন্টেনার খালাসে গতিশীলতা আনার আহ্বান জানানো হয়েছে। পণ্য খালাসে গতি আসলে বন্দরের জট পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। সূত্র জানিয়েছে, দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে ভয়াবহ রকমের জট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও কন্টেনারের ক্ষেত্রে জট তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা খোলা পণ্যবাহী একেকটি জাহাজকে দশ পনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর বার্থিং নিতে হচ্ছে। একটি জাহাজ একদিন অলস বসে থাকলে পনের থেকে বিশ হাজার ডলার ফিঙড অপারেটিং কস্ট বা এফওসি বাবদ পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে জাহাজের ভাড়া বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনের লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে। এক্ষেত্রে গড়ে বিশ হাজার ডলারও যদি এফওসি হয় তাহলে একটি জাহাজ পনের দিন অলস বসে থাকলে তিন লাখ ডলার বা আড়াই কোটিরও বেশি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে গত বেশ কয়েকদিন যাবত এই ধরনের অসংখ্য জাহাজ অলস বসে আছে। জেটি স্বল্পতার কারণে জাহাজগুলোকে বার্থিং দেয়া সম্ভব হয় না বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে পাঁচটি জেটিতে খোলা পণ্যবাহী জাহাজ বার্থিং দেয়া যায়। অথচ প্রতিদিন গড়ে আট দশটি পর্যন্ত জাহাজ পণ্য নিয়ে আসছে। একেকটি জাহাজকে তিন চারদিন জেটিতে অবস্থান করে পণ্য খালাস করতে হয়। ফলে বহির্নোঙরে অপেক্ষমান জাহাজের সারি ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হচ্ছে। দেশের আমদানিকারকদেরকে কোটি কোটি টাকা ফিঙড অপারেটিং কস্ট বা এফওসি বাবদ বিদেশী জাহাজ মালিকদের পরিশোধ করতে হচ্ছে। যে টাকার যোগান কার্যতঃ পণ্যমূল্যের সাথে দিতে হয় দেশের সাধারণ ভোক্তাকে।
খোলা পণ্যবাহী জাহাজের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার জাহাজেও হালকা জট দেখা দিয়েছে। গড়ে তিন চারদিন অপেক্ষার পরই প্রতিটি কন্টেনার জাহাজ বার্থিং পাচ্ছে। কন্টেনার জাহাজের জট একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা পুনরায় দেখা দিতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে আমদানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জেটি স্বল্পতা বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে বড় ধরনের কন্টেনার জটও রয়েছে। ৪০ হাজার টিইইউএস এর বেশি কন্টেনার বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে রয়েছে। সময়মতো কন্টেনার খালাস না করায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কন্টেনারের ভাড়া দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নিয়েও ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরে এসেছে। অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাস্টমসের জটিলতাসহ নানা ধরনের সংকটে ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও তারা কন্টেনার খালাস করতে পারছেন না। চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে স্ক্যানিং মেশিনের সংকট, পণ্য পরিক্ষা নিরীক্ষাসহ নানা ধরনের সমস্যায় আটকা পড়েছে বহু কন্টেনার। খাদ্য শষ্যবাহী কন্টেনার খালাসে কোয়ারেন্টাইন সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সনদ নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ব্যবসায়ীদের খুব সামান্য একটি অংশ ইচ্ছেকৃতভাবে কন্টেনার খালাস করছেন না। এই সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু ৯৫ শতাংশ কন্টেনারই আটকা পড়ে আছে সিস্টেমের গোঁজামিলের কারণে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করে কাস্টমস এবং অন্যান্য বিভাগগুলো কাজ করলে কন্টেনার খালাসের বন্ধ্যাত্ব বহুলাংশে ঘুচে যেতো বলে ব্যবসায়ী নেতারা মন্তব্য করেছেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহানের সাথে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জটের কথা নিশ্চিত করে বলেন, পরিস্থিতির উপর আমরা নজর রাখছি। বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রমজানকে সামনে রেখে আমদানি বেড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু আমাদের সক্ষমতা সেভাবে বাড়েনি। এতে করে জাহাজ বার্থিং পেতে কিছুটা সময় লাগছে। কন্টেনার খালাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক্ষেত্রেও একই সংকট। পণ্য বেশি আসছে। কিন্তু আমদানিকারকরা সেভাবে পণ্য খালাস করছেন না বা করতে পারছেন না। ফলে বন্দরের অভ্যন্তরে জট তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, বন্দর শুধু পণ্য রিসিভ করে। পণ্য ছাড় দেয়ার ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে কাস্টমস। এক্ষেত্রে বন্দরের কিছুই করার থাকে না। কাস্টমস যত বেশি গতিশীল হবে বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রম তত গতি পাবে।
এদিকে কাস্টমসের বিভিন্ন হয়রানির ব্যাপারটি বন্দর চেয়ারম্যানের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তুলে ধরেন ব্যবসায়ী নেতারা। পণ্য পরিক্ষা নিরীক্ষার নামে নানাভাবে হয়রানি করা হয় বলেও তারা অভিযোগ করেন। যাতে বলা হয়, কন্টেনার খালাসে অহেতুক দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে। এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টমসের একজন ডেপুটি কমিশনার বলেন, বিষয়টি ঠিক নয়। কন্টেনারের ভিতরে কী পণ্য আমদানি হয়েছে, ঘোষণার সাথে বাস্তবতার মিল আছে কিনা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা ইত্যাদি পরীক্ষা করা ছাড়া একটি কন্টেনার ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এতে যদি কিছুটা বাড়তি সময় লাগে তা মেনে নিতে হবে। আমদানিকারকরা যদি মিথ্যা ঘোষণা না দিতেন বা গোঁজামিল না করতেন তাহলে হয়তো আমাদেরকে এত কাঠখড় পুড়িয়ে চালান পরীক্ষা করতে হতো না। পাশাপাশি নিজেদের লোকবল সংকটে পণ্যের পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিছিল-মিটিংয়ে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা চমেকে
পরবর্তী নিবন্ধমামলা গ্রহণ করেছে আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ