চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন এখনো প্রাসঙ্গিক

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ

৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডের স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় শেখ হাসিনা আবারো স্মরণ করেছিলেন চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। তিনি বক্তৃতায় চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেন “আমরা এই চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল তৈরি করেছি। এই টানেল দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আনোয়ারা হয়ে কক্সবাজার চলে যেতে পারছে। আনোয়ারা উপশহর হয়ে গড়ে উঠবে। আজকে এই টানেলের কথা বললে মহিউিদ্দিন চৌধুরীর কথা মনে পড়ে। এর আগেও আমি বলেছি। উনি দেখে যেতে পারেন নি। একটা টানেল নির্মাণ হোক এটা তিনি সবসময় চেয়েছিলেন। তাঁর একটা দাবিও ছিল। আজ এই টানেল উদ্বোধনের পথে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি যেখানেই থাকুক, নিশ্চয়ই সেখান থেকে দেখবেন”। তাই বলা যায় চট্টগ্রামের যা কিছু অর্জন, যা চট্টগ্রামের জন্য গৌরবের সেটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম। এমন চট্টগ্রাম দরদি, চট্টগ্রাম-অন্তপ্রাণ নেতা আর আসেনি আমাদের এই জনপদে। এমন একটা নেতা পাওয়া জাতির জন্য সৌভাগ্যের। বলা যায়- মহিউদ্দিন চৌধুরী মানে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম মানেই মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাই চট্টলবাসীর বুকের ভেতর থেকেই উচ্চারিত হয়েছে- “যখন ছিল দুর্দিন/তখন ছিল মহিউদ্দিন।” এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনীতির এক অবিস্মরণীয় সাধক। ‘অ্যা কমপ্লিট লিডার’ বলতে যা বোঝায়, এরই প্রতিরূপ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী রাউজানের গহিরার শান্তিরদ্বীপ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হোসেন আহমেদ চৌধুরী এবং মাতার নাম বেদেরা বেগম। তাঁর জন্ম ১৯৪৪ মালের ১ ডিসেম্বর। বাবা-মা তাঁর নাম রেখেছিলেন আবুল বশর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী। পিতা ছিলেন রেলওয়ের চাকুরে এবং পিতার বদলিজনিত কারণে বিভিন্ন স্থানে তাঁকে পাঠ গ্রহণ করতে হয়। ১৯৬২ সালে এস. এস. সি. পাস করে ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে। এখানেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। যুক্ত হলেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে।

দুঃসাহসী পুরুষ মৌলভী সৈয়দ আহমদ ও মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে চলে আসে। তখন ষাটের দশকের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যাভিমুখী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দুর্গ ছিল সিটি কলেজ। রাজনীতিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর গুরু ছিলেন জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী। ১৯৬২ সালের হামিদুর রহমানের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি ছিলেন সিপাহ্‌সালার।

১৯৬৭ সাল থেকে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্চ মাসে গ্রেফতার হলেন। অকথ্য নির্যাতন সহ্য করলেন। কারাগার থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ মাউন্টেন ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুবলীগ- শ্রমিক লীগের রাজনীতির পর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন অন্যান্য আওয়ামী নেতাদের মতো মহিউদ্দিন চৌধুরী নিস্তেজ হয়ে বসে থাকেন নি। তিনি ও মৌলভী সৈয়দ ৭১’র মতো আবারো অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। অতঃপর দেশে স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও পুরোধা যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রবাস জীবন থেকে দেশের রাজনীতিতে সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনেও মহিউদ্দিন ভাইয়ের বিশাল ভূমিকা ছিল। জিয়াউর রহমানের শাসন শেষ হয়ে তখন এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন। সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য তখন রাউজান। অকুতোভয়ে বুক চিতিয়ে তিনি রাউজান থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী- সাকার বিরুদ্ধে সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। এরকম বুকের পাটা তখন আর কারো ছিল না। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পর পর ৩বার চট্টগ্রামের নির্বাচিত মেয়র। তাঁকে বলা হয় চট্টগ্রামের মাহাথির মোহাম্মদ। মাহাথির যেমন মালয়েশিয়ার খোলসকে বদলে দিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীও তেমনি চট্টগ্রামকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। এজন্যই তাঁকে বলা হয় ‘চট্টলবীর’, ‘চট্টলদরদী’, ‘চট্টলবন্ধু’।

কী শিক্ষায়, কী স্বাস্থ্যসেবায়, কী নাগরিক জীবন-যাপনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর যাদুকরি হাতের স্পর্শ পেয়ে চট্টগ্রাম সমৃদ্ধ হয়েছিল। ক্ষমতায় তখন বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী তখন খালেদা জিয়া, তিনিও অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের মহিউদ্দিন চৌধুরীেেক অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইনকাম জেনারেটিং প্রজেক্ট করে মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি কর্পোরেশনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছিলেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল ও চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অবদান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। গড়ে তুলেছেন চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউট। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা তাঁর আরো একটি স্মরণীয় কীর্তি।

সেবাব্রতে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন অকুতোভয়। মনে আছে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর তৎপরতা। তিনি নিজ হাতে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছিলেন। মুসলিম হলে স্থাপন করেছিলেন স্যালাইন তৈরির কার্যক্রম। কী অতিথি আপ্যায়নে, কী সংগ্রামে-রাজপথে, কী হজ্ব কাফেলা অথবা ত্রাণ বিতরণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর তুলনা নেই। বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে চাঁটগায়ের মেজবান, রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা, হজ্ব কাফেলা, রোজাদারদের জন্য মাসব্যাপি ইফতার ব্যবস্থা তাঁর অনন্য কীর্তি।

চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্নে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলে অনমনীয় ও আপসহীন ব্যক্তিত্ব। এক্ষেত্রে তিনি কোনো রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা করতেন না। নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল, সাইফ পাওয়ার টেক-বিরোধী আন্দোলনে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরকে বেসরকারিকরণ এবং বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী মতো জনহিতৈষী রাজনীতিক দুর্লভ। তিনি সিটি কর্পোরেশনের ঝাড়ুদারদের সেবক উপাধি দিয়েছিলেন। এছাড়া দলিত পরিবারের সন্তান কৃষ্ণদাশকে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দান করেছিলেন।

নগর চট্টগ্রাম, উন্নয়ন দর্শন ও সংগ্রাম প্রশ্নে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম সামষ্টিক হয়ে উঠে। তাঁর উত্তরাধিকার জ্যেষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, এম.পি. বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য। মেধাবী, নিরহংকার-সাহসী-সৎ কর্মবীর এই নেতা জনমানুষের হৃদয় জয় করেন।

শিক্ষকদের প্রতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। তিনি শিক্ষকদের স্যার বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আপন অনুজের মতো তাঁর স্নেহছায়া পেয়েছি। আজ এই পুণ্যাত্মার মৃত্যুদিন। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি এই ক্ষণজন্মা মানুষটিকে।

লেখক : সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; প্রাবন্ধিক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহিউদ্দিন চৌধুরী : যুগ যুগের মানবতাবাদ
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল