চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবক নূর আহমদ চেয়ারম্যান

এ.কে.এম. আবু বকর চৌধুরী | রবিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

বৃটিশ শাসনামলে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও উন্নয়নের ইতিহাসে চট্টগ্রামের তার হিরণ্ময়ী সন্তানদের মধ্যে নূর আহমদের (আহমেদ চেয়ারম্যান খ্যাত) আপোষহীন ভূমিকার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।

পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি আমার পূর্ব পুরুষ তথা বিশ দশক থেকে ষাট দশক পর্যন্ত চট্টগ্রামবাসীর কাছে ‘নূর আহমদ চেয়ারম্যান’ খ্যাত আলকরণ নিবাসী নূর মোহাম্মদকে যিনি ত্রিশ দশকে মহানগরীতে ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে ছিলেন। ১৮৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর নুর আহমদ জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন এই উপমহাদেশের শাসক ছিল বৃটিশ (২৩ জুন, ১৭৫৭ ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭)। তাই তাঁকে দেখা যায় মওলানা মুহাম্মদ আলী মওলানা শওকত আলী (আলী ভ্রাতৃদ্বয়) যৌথ নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন আর পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অন্যতম অগ্রণী নেতা হিসাবে। রাজনীতিতে যতটুকু থাকার দরকার ততটুকুর মাঝে দৃঢ় অবস্থান নিয়েও সামাজিক উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ পুরুষ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন।

সমাজ হতে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে যদি বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয় তবে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতারও প্রয়োজন হয়। যার ঐতিহাসিক প্রমাণ নূর আহমদ চেয়ারম্যান থাকাকালে চট্টগ্রাম পৌর এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছিলেন।

নূর আহমদ ১৯২১ হতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ গৌরবময় চট্টগ্রাম পৌরসভার বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে শিক্ষার মান উন্নয়নে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। তার একক প্রচেষ্টার ফলে অবিভক্ত বাংলায় চট্টগ্রাম পৌরএলাকা শিক্ষার হারের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ আসন অলঙ্কৃত করেছিল। তাঁর এহেন ঐতিহাসিক অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭৪৩) শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক (সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণর ১৯৫৬৫৮ ও মুখ্যমন্ত্রী ২ এপ্রিল ৩০ মে ’৫৪ এবং পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষামন্ত্রী ১৯৫৫৫৬) ১৯৪২ সালে তৎকালীন বঙ্গীয় আইন পরিষদে (১৯৩৭৪৫) বলেছিলেন ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলার মানুষ আজ আর পিছিয়ে নেই। আমি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হতে এই পর্যন্ত শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রদত্ত প্রতিবেদনে দেখতে পাই শিক্ষার হার ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হারের দিক থেকে সমগ্র বাংলার পৌর এলাকায় চট্টগ্রাম পৌর এলাকা ও থানা এলাকায় চট্টগ্রাম জিলার পটিয়া থানা সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে। আর চট্টগ্রাম পৌর এলাকার এই সম্মানজনক অবস্থানের জন্য এই পরিষদের সম্মানিত সদস্য নুর আহমদই সমস্ত কৃতিত্বের দাবীদার। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি (বঙ্গীয় আইন পরিষদ কার্য বিবরণী ১৯৪২/পৃষ্ঠা২১৭১৯/তাং১৭//৪৭ইংরেজি/ভলিয়্যুম)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস প্রসঙ্গ এলেই মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, নুর আহমদ চেয়ারম্যান, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী বাদশা মিয়া চৌধুরী ও অধ্যাপক আহমদ হোসেনের নাম সর্বাগ্রে আসে। মওলানা ইসলামাবাদী চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মহান স্বপ্নে দেয়াং এর পাহাড়ে তাঁর নিজস্ব, সম্পদ দান, অবিভক্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য (১৯৩৭৪৫) ও চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে নূর আহমদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করে (২৭ জুলাই ’৪২) চট্টগ্রাম পৌরসভার পক্ষ হতে তৎসময়ে পাঁচশ টাকার একখানি চেক প্রধানমন্ত্রী শেখ বাংলা এ কে ফজলুল হকের কাছে হস্তান্তর করেন দৈনিক আজাদ ও দৈনিক স্টেসম্যান / পৃষ্টা/তাং২৮//৪২ইং)। আর ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী (১৩ জুন ’৬২ ৩০ অক্টোবর ’৬৩) ও জাতীয় পরিষদের স্পিকার (২৯ নভেম্বর ’৬৩ ৬ জুন ’৬৫) থাকাকালে ৬বার পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে ’৬২র সংবিধানিক ক্ষমতাবলে ক্ষমতার সদ্ববহার করে চট্টগ্রামেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসাবে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী বাদশা মিয়া চৌধুরী ও সদস্য সচিব অধ্যাপক আহমদ হোসেন আপোষহীন সংগ্রাম করেছিলেন প্রবহমানকাল দরে চট্টগ্রামবাসীর কাছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, প্রস্তাবক নূর আহমদ চেয়ারম্যান, রূপকার ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আন্দোলনকারী বাদশা মিয়া চৌধুরী ও অধ্যাপক আহমদ হোসেন স্মরণে বরণীয় হয়ে থাকবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ভ্রান্ত ভূমিকার জন্য ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছেন ফজলুল কাদের চৌধুরী।

আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮৫২) তথা পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭৭১) সাংবিধানিকবাবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দেয়ার দাবী আন্দোলন ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা অধ্যায়। আর এখানেও নূর আহমদ চেয়ারম্যান এক বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে চট্টগ্রামবাসীকে সমুজ্জ্বল করেছেন তৎসময়ে তিনিই একমাত্র মুসলিম লীগ তথা সরকার দলীয় সদস্য হিসাবে পাকিস্তান গণপরিষদের বাংলা ভাষাকে উর্দুর সাথে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃত দেয়ার দাবীসহ ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে গুলিবর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন – ‘আমার উর্দুভাষী বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আজকের এই পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমগ্র উপমহাদেশে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানীরাই মুসলিম লীগকে নিরঙ্কুশ ব্যালট রায় দিয়ে এককভাবে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। …… আরও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সমগ্র পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা হল শতকরা ৫৬ জন। আর এই ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা দাবী করা কি দোষনীয় যার জন্য ঢাকার রাজপথে মিছিলের উপর গুলি চালাতে হয়েছে, প্রাণ হরণ করতে হয়েছে? দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বাংলা ভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে আমাদের সরকারের দলের, জাতীয় নেতাদের এই হীনম্মন্যতার হেতু কি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান সাহেব আপনারা বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলের ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করেও কেন বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে মর্যাদাদানে বিরোধীতা করছেন? (পাকিস্তান গণপরিষদ কার্যবিবরণী / ভলিয়্যুম৩৭/তাং২৩৫২ইং/পৃষ্ঠা ৯৭৯৯)

১৯৫৪র ১০ অক্টোবর পাকিস্তান গণপরিষদে গৃহীত শাসনতন্ত্রের খসড়া মূলনীতি ’৫৪ (মুহাম্মদ আলী বগুড়া ফরমূলা খ্যাত) এতে উর্দুর সাথে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের ধারার সংযোজনের যে প্রস্তাব নুর আহমদ চেয়ারম্যান উত্থাপন করেছিলেন তাও গৃহীত হয়েছিল। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৭ এপ্রিল ’৫৩ ২০ আগস্ট ’৫৫) ছিলেন বগুড়ার নবাব সৈয়দ মুহাম্মদ আলী চৌধুরী (মুহাম্মদ আলী বগুড়া খ্যাত) কিন্তু ৫৪র ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের পশ্চিমানেতাদের ঘৃণ্য চক্রান্তে গভর্ণর জেনারেল (১৯৫১৫৫) গোলাম মুহাম্মদ গণপরিষদ ভেঙে দিলে মোহাম্মদ আলীর ফরমুলা আর বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তান গণ পরিষদের (১৪ আগস্ট ’৪৭ ২৪ অক্টোবর ’৫৪) নূর আহমদ চেয়ারম্যানই একমাত্র সদস্য যিনি সংসদের সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রশ্নকারী হিসেবে সংসদীয় ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন।

অবিভক্ত বাংলায় আইন পরিষদে সরকার (১৯৩৭৪১ ও ১৯৪৩৪৫) দলীয় সদস্য হিসাবে প্রজাস্বত্ব আইন, সূর্যাস্ত আইন ও যৌতুকপ্রথা বিলুপ্ত করণে অন্যতম সহযোগী ছিলেন তেমনি শিক্ষা, শিল্পবাণিজ্যখাদ্যকৃষি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ খাতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিমাতাসূলভ আচরণে সংসদে প্রতিবাদ মুখর ছিলেন, অথচ তিনি ছিলেন সরকারি দলীয় তথা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। পাকিস্তান গণপরিষদের (১৯৪৭৫৪) কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তৎকালীন মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি সদস্যদের মধ্যে একমাত্র নুর মুহাম্মদ চেয়ারম্যান পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিদের বৃহত্তর স্বার্থে সংসদের আপোষহীন মনোভাব প্রদর্শন করতে দ্বিধান্বিত হননি।

১৯১৮ সালে অধুনালুপ্ত চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত প্রতিটি পৌরসভা নির্বাচনে যেমনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পৌর কমিশনার নির্বাচিত হয়েছেন তেমনি ১৯২১ সাল থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে একক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টির ধারক ছিলেন। তৎসময়ে পৌরসভার নির্বাচিত কমিশনারদের ভোটে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচনের পদ্ধতি ছিল।

চট্টগ্রামের এই হিরণ্ময়ী পুরুষ নুর আহমদ চেয়ারম্যানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আমাদের হীনম্মন্যতাকে পরিহার করতে হবে। তিনি অর্থ ও সম্পদ লোভী ছিলেন না। অবশ্য ৭০ দশকের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের নেতাদের মাঝে লোভ জিনিসটা ছিল না বলে দৃঢ়তার সাথে বলা যায়। মানবতাবাদী হিসাবে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল সমাজে গ্রহণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৫৪ সালে স্বেচ্ছায় তিনি চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদ ছেড়ে দিয়ে এর বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

লেখক : জীবন সদস্যবাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধগণমানুষের নেতা শেখ হাসিনা নেতৃত্বে ও সরকারে যাঁর তুলনা নেই