চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রতিষ্ঠা-আন্দোলনের’ একটি অজানা অধ্যায়

অধ্যক্ষ জসীম উদ্দীন হায়দার চৌধুরী | রবিবার , ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

(ছ) চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার বাসিন্দা, অধ্যাপক আহমদ হোসেন তখন ঢাকায় ‘বাংলা একাডেমির’ সেক্রেটারী পদে কর্মরত। তিনি সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপকের পদ থেকে এখানে এসেছেন। তিনি ছিলেন অমায়িক স্বভাবের সুন্দর মানুষ। বাংলা একাডেমি কার্যালয়ে আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন-প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনা নাই-তবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে যতবারই তাঁর দেখা হবে ততবারই তিনি তাঁকে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। ১৯৬৩ সনের ১০ই মার্চ, ঢাকায় ‘নিখিল পাকিস্তান আইনজীবী সম্মেলন’ (All-Pakistan Lawyers Convention) অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত ছিল।

এই সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে, আগেভাগে ঢাকায় এসে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের তদানিন্তন ‘শিক্ষা ও বেতার সম্প্রচার দফতরে’ মন্ত্রী (তিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাাচিত হয়েছিলেন) এ.কে.এম, ফজলুল কাদের চৌধুরী, বাংলা একাডেমির দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত বাগান-পরিবেষ্টিত সরকারি রেস্ট-হাউসের দোতলায় অবস্থান করছিলেন। ০৯ মার্চ, আতাউর রহমান খান কায়সারের নেতৃত্বে, সকাল বেলা নয়টার সময় আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সেখানে উপস্থিত হই। পরিপাটি স্যুট ও জিন্নাহ টুপী পরিহিত দীর্ঘ-দেহী মন্ত্রী মহোদয় ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আমাদেরকে জিগ্যেস করলেন-আমরা কী জন্য এসেছি। তখন কায়সার ভাই বললেন-আন্দোলনের জোয়ারে, চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’ সিলেট অথবা কুমিল্লায় চলে যাচ্ছে। এ কথার জবাবে মন্ত্রী মহোদয় বললেন, সিলেট আর কুমিল্লার লোকেরা যদি পারে, তাঁদের প্রত্যেকটি বাড়ির আঙ্গিনায় একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করুক।

কিন্তু প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামেই স্থাপিত হবে। এটা নিশ্চিত-‘তোমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও গিয়ে। তখন কায়সার ভাই বললেন- চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে আগামীকালের ‘আইনজীবী সম্মেলনে’ আমরা একটা স্মারকলিপি বিতরণ করতে চাই। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে এটা ছাপানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এই মুহূর্তে, আমাদের হাতে নেই- আমাদেরকে কিছু আর্থিক অনুদান দিন’। তখন মন্ত্রী মহোদয় তাঁর কোট-প্যান্টের পকেট হাতরিয়ে দেখেন-মানিব্যাগ তাঁর সঙ্গে নেই। তখন সেখানে উপস্থিত হাটহাজারীর এম.এল.এ, (Member of the Legislative Assembly) আবুল খায়ের সিদ্দিকীকে তাঁর বিছানার বালিশের নীচে থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে আসতে বললেন, সিদ্দিকী মানিব্যাগ নিয়ে এলে-তিনি সেখানে কত টাকা আছে জিজ্ঞেস করলেন-সিদ্দিকী বললেন- ছয়শত টাকা। তখন তিনি পুরো টাকাটাই কায়সার ভাইকে দিয়ে দিতে বললেন।

(তখনকার দিনে, এটা ছিল-বড় অংকের টাকা সে’ সময় এক টাকায় আড়াই সের চাল পাওয়া যেত, দশ টাকায় ছোট জাপানী ক্যামেরা কেনা যেতো, দেড় টাকা-পাঁচ সিকায় এক সের গরুর মাংস পাওয়া যেত, দশ-বারো আনা দিয়ে রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টে মাছ-মাংস দিয়ে ডাল ভাত খাওয়া যেত, এক কাপ চায়ের দাম ছিল দশ পয়সা) কায়সার ভাই তখন মন্ত্রী মহোদয়কে বললেন যে, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরা তো আমাদেরকে ঐ আইনজীবী সম্মেলনে ঢুকতে দেবে না- তিনি যদি একটু বলে দেন- তিনি বললেন-তিনি বলে দেবেন। ঐদিন দিবাগত রাত্রির মধ্যেই, কায়সার ভাই চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষে যাবতীয় যুক্তি ও তথ্যাদি সম্বলিত ‘স্মারকলিপি’ রচনা (ইংরেজীতে) করে কয়েক হাজার মুদ্রিত কপি প্রস্তুত করে রাখেন। পরের দিন, ১০ মার্চ, ঢাকা হাইকোর্টের (বর্তমানে যে ভবনে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের’ বিচার কাজ চলছে) সামনের মাঠে সকাল বেলায় বিশাল প্যান্ডেল বানিয়ে ও সামিয়ানা টাঙিয়ে ‘নিখিল পাকিস্তান আইনজীবী সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়-সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান।

সারা পাকিস্তান থেকে বিশিষ্ট আইনজীবী, (শীর্ষ-আইনজীবী,এ.কে, ব্রোহীসহ) মন্ত্রীবর্গ, আইন-প্রণেতাগণ, উচ্চ পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাগণ, বিদেশী কুটনীতিকবৃন্দ এবং বিশিষ্ট নাগরিকগণ এই সম্মেলনে যোগদান করেন। কায়সার ভাইয়ের নেতৃত্বে, সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই, আমরা সম্মেলনের প্রবেশ-দ্বারে উপস্থিত হই। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মিলিটারী অফিসাররা আমারেদরকে জিগ্যেস (উর্দুতে) করেন-আপনারা কি চৌধুরী সাহেবের লোক? আমরা বললাম হ্যাঁ। তখন তাঁরা আমাদেরকে সম্মেলনের ভিতরে ঢুকতে (সারিবদ্ধভাবে) দেন। ঢুকেই আমরা ক্ষিপ্র- গতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ‘স্মারকলিপি’ বিতরণ শুরু করি। কায়সার ভাই যখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে ‘স্মারকলিপি’ দিতে গেলেন তখন তিনি ইশারায় তাঁর সামরিক সচিবকে (একজন মেজর জেনারেল) ডেকে ওটা গ্রহণ করতে বললেন। প্রেসিডেন্ট, কায়সার-ভাইকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। আমাদের কর্মকাণ্ডে উপস্থিত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ‘অনুসন্ধানী-কৌতুহল’ ও বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছিল। (১০ মার্চ, দিবাগত সন্ধ্যায়, প্রধান বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর বড় মেয়ের বিবাহ-অনুষ্ঠানে-(বিচারপতির সরকারি বাসভবনে) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সপারিষদ যোগদান করেন এবং বর-কনেকে শুভেচ্ছা জানান।

বর ছিলেন- রাঙ্গুনীয়া নিবাসী ডাক্তার ফজলুল কাদের- ঢাকা মেডিকেল কলেজের জুনিয়র লেকচারার)। ১৯৬৪ সনের দ্বিতীয়ার্ধে, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দক্ষিণ পাশে কয়েকটি অনুচ্চ টিলা পাহাড় কেটে জায়গা সমান করা হয়। ঐ বছরের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে (নির্দিষ্ট তারিখটা স্মরণে আসছে না) হেলিকপ্টার যোগে এখানে এসে, এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। আমন্ত্রিত হয়ে আমরা নিকটবর্তী নাজিরহাট কলেজের শিক্ষকগণ ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন ঐ কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক। সরকারি ডেপুটেশনে, কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন-চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ইংরেজী বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক, তোফায়েল আহ্‌মদ। সমগ্র উত্তর-চট্টগ্রামে এটা ছাড়া আর কেনো কলেজ ছিল না।

চট্টগ্রাম শহর এবং সমগ্র জেলায় তখন সরকারি-বেসরকারি কলেজ ছিল মাত্র ছয়টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য্য ও প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের দালান-কৌঠার নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণ কাজের জন্য কন্সাল্টিং ফার্ম (পরামর্শক প্রতিষ্ঠান) নিয়োজিত হয়- ‘বাস্তকলাবিদ লি.’। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ছিলেন-তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ-স্থানীয় স্থাপত্য প্রকৌশলী-মাযহারুল ইসলাম। তিনি ছিলেন-চট্টগ্রাম কলেজের উপাধ্যক্ষ ও গণিতের অধ্যাপক ও রাউজানের কোয়েপাড়া গ্রামের বাসিন্দা, প্রফেসর ওমদাতুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি, তাঁর নির্বাচনী পোস্টারে-‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক’ হওয়ার তথ্যটি সংযুক্ত (মুদ্রিত) করেছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী চট্টলার এই কৃতি সন্তানের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দ্যেশে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, তাঁর স্ত্রীর নামসহ যুক্ত করে, চট্টগ্রাম শহরে ‘নিলুফার-কায়সার কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। আমি প্রস্তাব রাখছি-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভবন বা হলের নাম-প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সার-এর নামে নামকরণ করা হোক। (সমাপ্ত)

পূর্ববর্তী নিবন্ধফ্রান্সকে ‘আক্রমণের পথ জানা আছে’ আর্জেন্টিনার
পরবর্তী নিবন্ধমাটি : খাদ্যের সূচনা যেখানে