চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের আয়না দৈনিক আজাদী

পিংকু দাশ | বুধবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে অনন্য এক মাধ্যম সংবাদপত্র। এক সময় সংবাদপত্রই ছিল গণযোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। বিজ্ঞানের অকল্পনীয় কল্যাণে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ও রেডিওর মতো সংবাদমাধ্যমের পাশে জায়গা করে নেয় বিশাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মানুষের হাতের মোবাইল, ফেইসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জার এবং ইমেইলের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সংযুক্ত হওয়া মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের ঐতিহাসিক দিনের পরদিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর অন্য কোনো পত্রিকা প্রকাশিত না হলেও দৈনিক আজাদী পত্রিকা ‘জয় বাংলাবাংলার জয়’ শিরোনামে নামমাত্র মূল্যে প্রকাশ এবং বিতরণ করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

ভালোবাসার, আস্থার এবং নির্ভরতার একটি নাম ‘দৈনিক আজাদী’। ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০ চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ ঐদিন পাঠকনন্দিত পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদীর’ আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই দৈনিক আজাদীর জন্ম। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা, ৬৯ এর গণ আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার সাধারণ মানুষের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে দৈনিক আজাদী।

আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আব্দুল খালেক পেশাগত জীবনে একজন তড়িৎ প্রকোশলী ছিলেন। তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার। তিনি নিজের পেশা ছেড়ে শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে তিনি ১৯২৯ সালে কোহিনুর লাইব্রেরি এবং ১৯৩০ সালে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছিল একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রয়ারিতে ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী এই কবিতাটি লিখেন। এভাবেই কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অনন্য হয়ে রয়েছে।

পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে জন্ম নেয় ‘দৈনিক আজাদী’। আজাদী প্রকাশের দুই বছরের মাথায় দেশ মাতৃকার সেবায় নিবেদিত মহান ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক ১৯৬২ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করলে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমৃত্যু কাজ করে যান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পত্রিকার সম্পাদক, নির্বাচিত সংসদ সদস্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ভারতে চলে গেলে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ে তৎকালীন পরিচালনা সম্পাদক এবং বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেকের ওপর। যিনি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেকের সুযোগ্য পুত্র। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ‘জয় বাংলাবাংলার জয়’ শিরোনামে দৈনিক আজাদী প্রকাশ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বার্তা চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পৌঁছে দেয়। ২০০৩ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মৃত্যুর পর দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব নেন এম এ মালেক। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান ও সাংবাদিকতার বিকাশে অনন্য অবদানের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’এ ভূষিত করেন। দৈনিক আজাদী লাভ করে ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল পদক’।

চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান মোহাম্মদ আব্দুল মালেক একজন যশস্বী সম্পাদক। সংবাদপত্র শিল্পের অগ্রগতি ও আধুনিকায়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বহুগুণে গুণান্বিত এম এ মালেক মন ও মননে প্রগতিশীল বাতাবরণকে ধারণ করে। সাংবাদিকতায় ‘একুশে পদক ২০২২’ লাভ করে দৈনিক আজাদীরএবং চট্টগ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, গৌরবান্বিত করেছেন চট্টগ্রামবাসীদের।

দৈনিক আজাদী শুধুমাত্র একটি সংবাদপত্র নয়, এটি চট্টগ্রামের আয়না হিসেবেও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। চট্টগ্রামের উন্নয়ন এবং জনস্বার্থ ইস্যুতে ‘দৈনিক আজাদী’ সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ যেকোনো বিষয়ে অসংগতি দেখলে ‘দৈনিক আজাদী’ তা ফলাও করে প্রকাশ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতামত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সমাধানের পথ উন্মুক্ত করে। চট্টগ্রামের মানুষের অধিকারের কথা, দুঃখ দুর্দশার কথা বলতে বলতে এটি পরিনত হয়েছে চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসার মুখপত্রে। যার পুরো কৃতিত্বের দাবিদার জনাব এম এ মালেক। খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামকে ভালোবাসেন উদার চিত্তে।

চট্টগ্রামের সুখদুঃখ, আনন্দবেদনার প্রতিচ্ছবি ‘দৈনিক আজাদী’। ক্যান্সার আক্রান্ত একজন রোগীর দুর্দশার কথা শুনে তিনি চট্টগ্রামে ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অধীনে দৈনিক আজাদীর পক্ষ থেকে ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য এক কোটি টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কল্যাণমুখী ভূমিকার অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে কৃতি শিক্ষার্থীদের জন্য দৈনিক আজাদী চালু করেছে শিক্ষা বৃত্তি। প্রতিবছর বেশ কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থী সেই বৃত্তি গ্রহণ করে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।

দৈনিক আজাদী সবসময় চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতি সবার সামনে তুলে ধরে। আঞ্চলিক ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে মাঝে মাঝে খবরের হেডলাইন করে মানুষের ভালোবাসা কেড়ে নেয়। যেমন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন দৈনিক আজাদীর শিরোনাম, ‘আঁরার ইউনুস নোবেল পাইয়্যে’। তেমনি বন্যার সময় ‘চট্টগ্রাম শহর ডুবি গেইয়ে’। এরকম অসংখ্য সুন্দর সুন্দর শিরোনাম তিনি আঞ্চলিক ভাষায় করে, পাঠকমন জয় করেছেন।

দৈনিক আজাদী’ মানুষের নির্ভরতার প্রতীক। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাদের সন্তানরা মোবাইলের মাধ্যমে ঘরে বসে নিমিষেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল সংক্রান্ত সব তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। আমাদের সময় পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল সংগ্রহ অতটা সহজ ছিল না। ফলাফল প্রকাশের আগেরদিন রেডিও টেলিভিশনের সংবাদে আমরা জানতে পারতাম, আগামীকাল ফলাফল প্রকাশ করা হবে। শহরের ছাত্রছাত্রীরা সন্ধ্যায় আজাদী অফিসের সামনে ভিড় করতো একটু আগেভাগে ফলাফল জানার প্রত্যাশায়। আর যারা গ্রামে থাকত তারা সকাল থেকে গ্রামের বাজারে পত্রিকার দোকানে এসে বসে থাকত। কখন আসবে সেই আকাঙ্খিত পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’, যেখানে ছোট ছোট অক্ষরে প্রিন্ট করা থাকবে তাদের স্বপ্নপূরণের রোল নম্বর! দুপুরের দিকে যখন আজাদী পত্রিকা হাতে আসত তখন একটা পত্রিকায় অনেকজন উৎসুক দৃষ্টিতে নিজের রোল নং খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। অনেকসময় টানাটানিতে পত্রিকা ছিড়েও যেত। আরও দুএকটা পত্রিকা চট্টগ্রামে থাকলেও আমরা নির্ভর করতাম আজাদীর উপর। ‘দৈনিক আজাদী’ নামটা দেখলেই এখনও এধরনের মধুর স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে আসে।

বিশ্বকাপ ফুটবল অথবা ক্রিকেট চলাকালীন সময়ে আজাদী পাড়ায় ক্রীড়াপ্রেমীদের জমজমাট আসর বসত। কারণ তখন খেলা নিয়ে আজাদী বিভিন্ন কুইজের আয়োজন করত। কুইজের সঠিক উত্তর দিতে পারলে টেলিভিশনের মত লোভনীয় পুরস্কার ও দেওয়া হত। যে পুরস্কার পেত তার ছবি আজাদীতে ছাপা হত। কী আগ্রহ নিয়ে তখন সে ছবি দেখতাম! ভাবতাম যে পুরস্কার পাচ্ছে সে কত ভাগ্যবান। কারণ সে আজাদীর মত জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে পুরস্কার পাচ্ছে।

দৈনিক আজাদী নতুন লেখকদের বাতিঘর। দৈনিক আজাদীর হাত ধরে বহু লেখক এবং সাংবাদিকের জন্ম হয়েছে। প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি নুতন লেখকদের চিন্তা ,চেতনা এবং সৃষ্টিশীলতাকে সম্মান জানিয়ে দৈনিক আজাদী প্রকাশ করে ‘আগামীদের আসর’। শিশু কিশোরদের সাহিত্য চর্চার একমাত্র মাধ্যম। বর্তমানে আজাদীর সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ ভাই তাঁর অকৃত্রিম নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতায় চালু করেছেন ‘সুখেদুখে ফেসবুকে’। যেখানে প্রবীন লেখকদের সাথে সাথে নবীন লেখকরাও তাদের লেখা এবং মতামত শেয়ার করতে পারেন।

সংবাদপত্রের সাথে পরিচয় আমার ‘দৈনিক আজাদী’র মাধ্যমে। ছোটকালে মনে করতাম সংবাদপত্র মানেই ‘দৈনিক আজাদী’। এ প্রসঙ্গে একটা কথা কৃতজ্ঞচিত্তে বলতে চাই, আমার আনন্দের দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দিন, যেদিন প্রথম আমার একটি লেখা ছবিসহ ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকায় ছাপা হয়। সেদিন সকালে খুশিতে বাসার সবাইকে জড়ো করে ফেলি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি! অশেষ ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা প্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘দৈনিক আজাদী’র সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাই।

সূত্র: সমকালীন চট্টগ্রাম সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রসঙ্গ ( রাশেদ রউফ), পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি,

বোয়ালখালী হাজী মো: নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইতিহাসের পাতায় দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধগৌরবের চট্টগ্রাম, হাজার বছরের চট্টগ্রাম