চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও কিছুকথা

পুলক কান্তি বডুয়া | শুক্রবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, চট্টগ্রামের বৌদ্ধ বডুয়ারা মঘ বা আরাকানী এবং চাটগাঁইয়ারা আদি বাঙালি নয়, আরাকানী বা রোহিঙ্গা? এই নিরিখেই পুনরায় চর্যাপদ থেকে আমরা বাংলার চাটগাঁইয়া ও বাঙালির এক গভীর যোগসূত্রের সন্ধান খুঁজে পাই। বাংলা ভাষার শক্তিশালী আদি নিদর্শন চর্চাপদ, এ বিষয়ে যেহেতু পণ্ডিতদের মধ্যে আর কোন দ্বিমত নেই, তাই এই আলোকে আমরা কিছু পর্যালোচনা তুলে ধরতে চাই।
১. চর্যাপদ যেহেতু বৌদ্ধ সিদ্ধ্যাচার্য্যরা রচনা করেছিলেন, কাজেই চর্যাপদ শুধু ভাষা নয় বরং একটি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, আদি ধর্ম ইত্যাদি উন্মোচনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাই চর্চাপদের চর্যাকাররা চট্টগ্রামের অধিকাংশ ছিলেন, দেবপাহাড় ও আনোয়ারার পণ্ডিত বিহার ও দেয়াং পাহার এ বসেই সিদ্ধ্যাচার্য্য গণের অনেকেই চর্যাপদ গুলো রচনা করেছিলেন, প্রমাণ স্পষ্ট ।
২. চট্টগ্রাম ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার সাথে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ ও ভাষা অর্থের বৈসাদৃশ্যতায় চট্টগ্রাম ও সিলেটের জনপদ বাঙালি বা বাংলা ছিল কিনা বা আদৌ তারা বাঙালি না আলাদা কৃস্টির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নাকি আদিবাসী ইত্যাদি নানা কথিত বক্তব্য প্রায় শুনি। সে ক্ষেত্রে চর্যাপদ গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম ও সিলেটের ভাষা মূলত বাঙাল ভাষার আদিরূপ। এ বিষয় টি স্পষ্ট করতে চর্যাপদের কি কি শব্দ আঞ্চলিক চট্টগ্রামের ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তার কয়েকটি নমুনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি ।
যেমন-
চর্যা নং-৩এ
এক সে শুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই। চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধাইপৃ-১ (বিরুবাপাদানাম)আধুনিক বাংলায়- এক সে শুড়িনী দু ঘরে ঢোকে। চিকন বাকল দিয়ে সে বারুণী মদ চোলাই করে। শব্দের ব্যুৎপত্তি- চীঅণ < চিক্কণ < চিকন। চীঅণ শব্দ দিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য। দেহি খুব চিঅণ মনে অর। শুদ্ধ বাংলায়- দেখে খুব চিকন মনে হচ্ছে।চর্যা নং ৩-এ-দশমি দুআরত চিহ্ন দেখিয়া।আইল গরাহক আপনে বহি আ ॥ (বিরুবাপাদানাম)আধুনিক বাংলায়- দশম দ্বারে চিহ্ন দেখে, খদ্দের নিজেই (পথ) বেয়ে এল, দুআরত শব্দের ব্যুৎপত্তি- দ্বার > দু আর। দু আর + ত (অধিকরণে)চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য- দুআরত ঠেলা দিঅ (শুদ্ধ বাংলায়- দুয়ারে ধাক্কা দাও)
চর্যা নং ৬-এ-
কাহেরে যিনি মেলি আছহু কীস।
বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদীস ॥ (ভুসুকুপাদানাম)
আধুনিক বাংলায়- কাকে নিয়ে বা কাকে ছেড়ে কেমন করে আছি। চারপাশ ঘিরে হাঁক পড়ে। মেলি শব্দের ব্যুৎপত্তি মেলি > ছাড়িয়া মেল (পরিত্যাগ করা অর্থে) + ই অথবা মীল + ই > মিলি, মেলি।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য – দুআর খান মেলি দঅ। (শুদ্ধ বাংলা- দরজাটা খুলে দাও)
চর্যা নং ৭-
এজে জে আইলা তে তে গেলা।
অবণাগবণে কাহ্ন নিঅড়ি বিমনা ভইলা ॥ (কাহ্নপাদানাম) আধুনিক বাংলায় যারা যারা এল, তারা তারা গেল, আনাগোনা দেখে কানু দুঃখিত হলো। শব্দের ব্যুৎপত্তি – আইলা > আগত > আঅ + ইল্ল > আইল্লা > আইল + আ।
গেল- গত > গঅ + ইল্লা > গইল্ল > গেল + আ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য- আইলা কিল্লাই, গেলা কিল্লাই? শুদ্ধ
বাংলায়- এসেছ কেন? গিয়েছ কেন?
চর্যা নং ৮-এ-
খুন্টি উপাড়ী মেলিলি কাছি। বাহ তু কামলি সদগুরু পূছি ॥ (কম্বলাস্বরপাদানাম)
আধুনিক বাংলায় খুঁটি উপড়িয়ে কাছি মেলে দিয়ে (হে) কামলি, তুমি সদগুরুকে জিজ্ঞাসা করে বেয়ে চল। কাছি শব্দের ব্যুৎপত্তি -কাছি – কাচ্ছিকা মোটা দড়ি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য -লসি (রসী) কাছি কিছু ঘরত নাই? শুদ্ধ বাংলা রশি দড়ি ঘরে নাই?
চর্যা নং-৯-এ-
জিম জিম করিআ করিণিরে রিসই।
তিম তিম তথতা মঅগল বরিসই ॥ (কাহ্নপাদানাম)
আধুনিক বাংলায়- হস্তী যেমন যেমন হস্তিনীকে ঈর্ষা করে মদকল (অর্থাৎ খাদে পতিত হস্তি) তথতা বর্ষণ করে। শব্দের ব্যুৎপত্তি- রিসই ঈর্ষা (আসক্ত অর্থে) রিস + ই (প্রথম পুরুষ এক বচনে) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য রিসই লাভ নাই। শুদ্ধ বাংলায় ঈর্ষা করে লাভ নেই।
চর্যা নং-১৪-এ-
পাঞ্চ কেডুআল পড়ন্তে মাঙ্গে পীঠত কাছি বান্দী।
গঅন দুখোলে সিঞ্চহু পাণী ন পইসই সান্ধি ॥
আধুনিক বাংলায়- নৌকার গলুইয়ে পাঁচটি ফেলে পিঠে কাছি বেঁধে গগন সেঁউতি দ্বারা জল সেচক কর। (যেন কোন) জোড়ার ফাঁকে (জল) প্রবেশ না করে। পীঠত শব্দের বুৎপত্তি- পীঠত- পৃষ্ঠ > পীঠ + ত (৭মী) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য- বস্তা পীঠত দড়ি কাছি দি বান্ধি লঅ। শুদ্ধ বাংলায় – বস্তাটা পীঠে রশি দিয়ে বেঁধে নাও।
চর্যাপদ ১৫-এ-
কুলে কুল মা হোহি রে মূঢ়া উজু বাট সংসারা।
বাল তিন একু বাঙ্ক ণ ভুলহ রাজ পথ কণ্টারা ॥
(শান্ত পাদানাম)আধুনিক বাংলায় ওরে, কুলে কুলে মূঢ় ইয়ে ঘুরো না সংসার পথ সোজা। মুখ বাঁকা পথে তিল মাত্রও ভুল করো না, রাজ পথ কানাত ঘেরা। বাল শব্দের বুৎপত্তি- বাল – জ্ঞানহীন, মূর্খ (তৎসম শব্দ) চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য – বালরে বুঝান যায় (শুদ্ধ বাংলায় মূর্খকে বুঝানো যায় না)
চর্যাপদ নং ২৩-এ-
জীবন্তে ভইলা বিহাণি মইল রঅণি।
বিণু মাঁসে ভুসুকু পা ঘর ন পইসনি নি ॥
(ভুসুকু পাদানাম) আধুনিক বাংলায়- সকালে জীবন্ত হলো, রাত্রে মৃত। ভুসুকু পাদ মাংস নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে না। বিহাণি শব্দের ব্যুৎপত্তি- বিহান + ই – প্রভাতে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য- বিহানি আইসসি (শুদ্ধ বাংলায় সকালে এসেছি।)
চর্যা নং-৩৩-এ-বলদ বিআল গবিআ বাঁঝে।
পীঢ়া দুহি অই এ তীনি সাঝে ॥ (ঢেণ্টণপাদানাম)
আধুনিক বাংলায়- বলদ প্রসব করল, গাই বন্ধ্যা, পাত্র (ভার) দোয়ানো হলো এ তিন সন্ধ্যা (বেলা)। শব্দের ব্যুৎপত্তি- বি আল প্রসব করিল। বেদন > বি অ ল + এল > বি আ এল। বাঁঝে ু বন্ধ্যা > বাঝা + এ – বাঁঝে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য- বাঁঝে গাই কেনে বিআল? শুদ্ধ বাংলায়-বাঁকা গাই কিভাবে প্রসব করল?
চর্যা নং-৪৭-এ-
কমল কুলিশ মাঝে ভইঅ মইলী।
সমতা জোএ জলিঅ চণ্ডালী ॥ (ধামপাদানাম)
আধুনিক বাংলায়- কমল কুলিশ মাঝে মৃতা হয়ে চণ্ডালী সমতা যোগে প্রজ্বলিত হলো। মইলী শব্দের বুৎপত্তি- মইলী মৃত + ইল (বিশেষণ) > মইল + ঈ (স্ত্রী লিঙ্গ) মৃতা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাক্য – আঁই মইলী তারপর বুঝিবি। শুদ্ধ বাংলায়- আমি মারা গেলে তারপর বুঝবে।
ব্যাকরণে ও চট্টগ্রামের ভাষার সাথে ব্যাকরণগত মিল খুঁজে পাই। যেমন নঞর্থক পদ ক্রিয়াপদের আগে বসে। যা প্রচলিত বাংলায় পরে বসে। যেমন- দুলি দুহি পীঢ়া ধরন ন জাই। (চর্যা নং ২), জোইনি তঁই বিণু খনহি ন জীবমি (চর্যা নং ৪), দু আন্তে চিখিল মাঝে ন থাহী (চর্যা নং ৫), খনহ ন ছাড়ই ভুসুক অহেরী (চর্যা নং ৬), হরিণা হরিণীর নিলয় ন জানী (চর্যা নং
উপসংহারে তাই বলতে চাই –
আজ পর্যন্ত এই চট্টগ্রামেই বডুয়া নামের একটি সমপ্রদায় চর্যাকারদের ধর্মমত অনুসারী, এরা বৌদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
চর্যাপদের সমাজচিত্রতেও দেখি নদী, অরণ্য, পাহাড়, টিলা, সমুদ্র প্রভৃতির বর্ণনা, এর সব কিছুই আমরা দেখতে পাই সিলেট, চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রকৃতিতে। চর্যায় আছে হরিণ শিকারের কথা। বন্য হাতির কথা। চোলাই মদের প্রসঙ্গ। আছে নৌকা, পাড়, সাঁকো ঘাট প্রভৃতির কথা। এই বর্ণনাগুলো। চট্টগ্রামের ভাষার বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন শব্দ ও বৌদ্ধসাধকদের আশ্রয় প্রমাণ করে যে, চর্যার পদকর্তাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামবাসী ছিলেন। হিন্দি, উড়িয়া, মৈথিলী, অসমীয়া, ভাষাবাসীর কেউ কেউ চর্যাপদকে তাদের প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করলেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন দাবি করেছেন চর্যাপদ বাংলা ভাষারই প্রাচীন নিদর্শন।
চর্যাপদের হাড়ি পা নামের যে সিদ্ধ্যাচার্যের নাম পাই তার বর্তমান প্রজন্ম বংশধরদের মধ্যে প্রয়াত বৌদ্ধপণ্ডিত মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো, বর্তমান বৌদ্ধ সর্বোচ্চ ধর্মগুরু সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাথেরো, আমেরিকা ও ফ্রান্স প্রবাসী পন্ডিত প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো প্রমুখকে পাই যাদের বংশের নাম হাড়ি পা।
এই সূত্র ও আলোচনাসমূহ খুব সহজেই বলে যে চট্টগ্রাম এর আঞ্চলিক ভাষা বাংলাভাষারই আদি একটি রূপ, এই অঞ্চলে বসবাসরত বৌদ্ধ বডুয়া সমপ্রদায় মগ নয় ও চট্টগ্রামের বৌদ্ধ, হিন্দু-মুসলমানরা কেউই বাইরের আগন্তুক নয়, এই চাটগাঁইয়ারাই আদি বাঙালি, তাদের আন্‌চলিক ভাষা বাংলাভাষার বিবর্তনের পূর্বের আদিরূপ এবং বাঙালির মূলবাসী নিবাসী। তাই চট্টগ্রামের ভাষাতত্ববিদ ও নৃতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের আমাদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আরো ব্যাপক অনুসন্ধানের আহ্বান জানাই ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদু’টি কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধশাহাদাত হোসেনের সমর্থনে প্রচারণা