খোকা থেকে জাতির জনক

রেজাউল করিম | বুধবার , ১৩ মার্চ, ২০২৪ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

মধুমতী যায় বয়ে যায়/ কবির তুলিতে আঁকা/ পুণ্য মমতা মাখা/ আপনার মন বয়ে যায়/ শ্যামলী দুই তীরে/ সন্ধ্যা নামে ধীরে/ ঘরে ঘরে দীপ জ্বলে/ ছায়া দোলে পলে পলে/ চাঁদ হাসে মধুর জোছনায়।’ মধুর সেই জোছনায় আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। গোপালগঞ্জের মধুমতীর তীরে ঘেঁষে টুঙ্গিপাড়ায় এ দিন জন্মগ্রহণ করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মা সায়েরা খাতুন। মুজিব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন টুঙ্গিপাড়া, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে।

মধুমতীবাইগার নদীর পানিতে ভিজে, তালতমালহিজলের সবুজভরা হৃদয় নিয়ে ক্রমেই বেড়ে ওঠেন শেখ মুজিব। সেই ছোট্ট খোকা থেকে পরিণত হন জাতির পিতায়। এরপর বিশ্বনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেজন্য মুজিব মানেই মুক্তি, মুজিব মানেই বাংলাদেশের প্রতিধ্বনি।

১৯৩৮ সালে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়েন। শহরে আসবেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির দায়িত্ব পড়ে শেখ মুজিবের ওপর। সভা শেষে তারা গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। স্কুলের ছাত্রদের পক্ষে সংবর্ধনার নেতৃত্বের ভার শেখ মুজিবের কাঁধে। তাদের পথ আগলে স্কুলের ছাত্রাবাসের জীর্ণ দশা কথা তুলে ধরেন। সোহরাওয়ার্দী তাঁর দাবি শুনে পূরণের আশ্বাস দেন। কলকাতায় গেলে কিশোর মুজিবকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের কথা বলেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় শেখ মুজিবকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করলেন। নোটবুক বের করে নামঠিকানা লিখে নিলেন। পরে একটা ধন্যবাদ চিঠিও পাঠান। অবশ্য বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় গেলেন, সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির দারোয়ান প্রথমে ঢুকতে দিতে চাননি। সোহরাওয়ার্দী তখনো মন্ত্রী। তাঁর দেওয়া কার্ডটি দারোয়ানকে দেখানোর পর তাড়াতাড়ি তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘ম্যাট্রিক তো পাস করে ফেলেছ, এখানেই ভর্তি হও। আমার সঙ্গে কাজ করো। এভাবে মুজিব কাজ শুরু করেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক শাখায়। কিছুদিনের মধ্যে মুসলিম ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে যায়।’

আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ায় রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এরমধ্যে স্কুলে পড়াকালীন ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। জীবনের ১৪টি বছর কাটিয়েছেন জেলে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন কারাগারের অন্ধকারে প্রকোষ্ঠে বসেই। ১৯৩৮ সালে কারাভোগ শুরু। এরপর থেকে কারাগার যেন তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠে। ভাষার জন্য সংগ্রাম শুরু করায় ১৯৪৮ সালেই কারাগারে যেতে হয়। আর ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন। কারাগারে বসেই তিনি ভাষাসংগ্রামীদের যোগাযোগ রাখতেন। আর ছয় দফার পর তিনি দফায় দফায় গ্রেপ্তার হন।

১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ শুক্রবার। ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাইবেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত।তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধ হয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না। আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়ে কাটালাম। আমিও হাত দিলাম।’ [কারাগারের রোজনামচা’২০৯২১০ পৃষ্ঠা]

১৯৬৩ সালের কথা। শেখ মুজিব তখনো বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি। জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে সেই সময় কচি কাঁচার মেলায় শিশু আনন্দমেলায় এসেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে তিনি মিশেন মনটাকে হালকা করার জন্য। এই ছোট্ট বক্তব্য শিশুদের প্রতি তাঁর আবেগ ফুটিয়ে তুলেছিল। ১৯৭২ সালে শিশু আইন তৈরি করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বিশ্বাস করতেন শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ সোনার বাংলা গড়তে পারবে। কিন্তু ঘাতকরা তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। কিন্তু তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শিশুরা যেন অনুপ্রাণিত হয়। সে জন্য দিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনভাবে স্বাধীন দেশে বাঁচতে শিখিয়েছেন তিনি। বাঙালি তাঁর আদর্শকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির জনক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুজিব
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষার মান উন্নয়নে অভিভাবকদের ভূমিকা পালন করতে হবে