কাল আজ কাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৯ মে, ২০২২ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

শহরের কিছু ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বাদ দিলে দেখা যাবে কয়েকটি দোকানের পরপরই একটি করে ওষুধের দোকান। শহরের পাড়ামহল্লা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়েও দেখা যায়। কোথাও এক সাথে কয়েকটি দোকানঘর উঠেছে। তাতে নিশ্চিতভাবে একটি ওষুধের, একটি চায়ের এবং তৃতীয়টি মোবাইলে টাকা রিচার্জ করার দোকান। বাংলাদেশে ফার্মেসি ছাড়াও মুদির দোকান এমনকি পানের দোকানেও ওষুধ বিক্রি হয়। এসব দোকানে গ্যাস্ট্রিক, মাথা ব্যথা, পেট খারাপের মতো অত্যন্ত কমন কিছু রোগের ওষুধ পাওয়া যায়। অনেকেই পান বিড়ির সাথে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কেনেন এমন দোকান থেকে। গ্রামে এমন অনেক দোকানে দেখেছি। দোকানদারকে পাড়ার পরিচিত কারো ছেলে বা মেয়ে এসে বলছে, বাবার জ্বর জ্বর লাগছে, বলছে ওষুধ দিতে। দোকানদারও সামান্যতম না ভেবে জ্বরের ওষুধ তুলে দিচ্ছেন শিশুর হাতে। বাংলাদেশে এত ওষুধের দোকানের আধিক্য দেখে বোঝা যায় জাতিটি কত রুগ্ন ও অসুস্থ। বাংলাদেশে এমন কোনো পরিবার আছে যেখানে কোনো না কোনোভাবে রোগাক্রান্ত মানুষ নেই? চল্লিশ পেরুনো কয়জনকে পাওয়া যাবে যার ডায়াবেটিস নেই? কতজন মানুষের কিডনি, লিভার, হৃদপিন্ড সুস্থ আছে? উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন না এমন মানুষের সংখ্যা কত? গ্যাস্ট্রিক নেই এমন কয়জন আছেন বাংলাদেশে?

পরিবেশ দূষণের কারণ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ আমাদের অনিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা। ভেজাল, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ, পচা, বাসী এবং অস্বাস্থ্যকর স্থানে তৈরি খাবার খেতে খেতে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য প্রচন্ড ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। বাংলাদেশে এমন পণ্য খুব কম আছে যার নকল বা ভেজাল নেই বাজারে। আমাদের দেশের ভোগ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতিদিন আমাদের খাদ্য তালিকায় যা থাকে তার অধিকাংশই স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। আমাদের দেশের হোটেল রেস্তোরাঁ বেকারিতে যা তৈরি হয় তার অধিকাংশই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। দেশে উৎপাদিত পণ্যও নিরাপদ নয়। আমাদের শস্য তাও নিরাপদ নয়। আমাকে এক কৃষি কর্মকর্তা বলেছিলেন, বেগুন গাছ রোপণ করা থেকে শুরু করে বেগুন তোলা পর্যন্ত অন্তত দু’শ বার কীটনাশক স্প্রে করা হয়। আমাদের এমন কোনো ফলন নেই যাতে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় না। এমনকি শাক, যা আমরা সামান্য তা’য়ে রান্না করি।

ফসলে কীটনাশক প্রয়োগের কিছু নিয়ম আছে। কোন ফসলে কী বিষ এবং কোন মাত্রায় তা প্রয়োগ করতে হবে তার বিশ্বস্বীকৃত মান আছে। কোন বিষ ছিটানোর কতদিন পর তা খাওয়ার জন্য উপযোগী হবে তারও হিসাব নির্ধারণ করা আছে কিন্তু আমাদের দেশে কে মানছেন এমন বিধিনিষেধ। আমরা যে সয়াবিন তেল খাই তা কতটা পরিশুদ্ধ তা জানি না। এদেশে তো মাস্টার গাম দিয়েও বাঘাবাড়ির এক নম্বর গাওয়া ঘি তৈরি করা হয়। ব্রয়লার মুরগিকে খাদ্য হিসেবে বা ফার্মের মাছকে খাদ্য হিসেবে কী খাওয়ানো হয় এবং তা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা আমরা জানি না। দেশে আন্তর্জাতিক মানের বয়লার চিকেনের অভাব আছে বলে এদেশে ‘ম্যাকডোনাল্ড’ তাদের বিক্রয়কেন্দ্র খোলেনি। ‘কেএফসি’ মান বজায় রাখতে পারছে না বলে চট্টগ্রাম শাখাটি বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের খাদ্যমান যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে তা দেশের বাইরে অবস্থান করেন এমন পরিবার তাদের সন্তানদেরসহ দেশে আসলে খুব বেশি টের পান। এদেশে মরা মুরগি চালিয়ে দেওয়া হয় হোটেলে। এদেশে পুকুরের মাছ তোলার খরচ বাঁচাতে মাছ তুলতে পুকুরে বিষ ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

পচা, বাসী, ভেজাল খাবারতো নিত্যদিন খাচ্ছি বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁয়। নিজের ঘরে যা খাচ্ছি তাও তো নিরাপদ নয়। কারণ কিনে তো নিয়ে যাচ্ছি সেই ভেজাল পণ্যই।

এ দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এই ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে অসুস্থ হচ্ছেন। তারপর সুস্থ হওয়ার জন্য যে ওষুধ খাচ্ছেন তা ভেজাল হওয়ায় সুস্থ না হয়ে উল্টো মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন। মাঝখানে অনেকের আবার ভেজাল ও মানহীন চিকিৎসকের পাল্লায় পড়ার দুভার্গ্যও হয়। এদেশে ওষুধে ভেজাল হয়। এমন কি শিশু ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল হয়। ওষুধের দোকানগুলো ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করে তা সকলে জানে কিন্তু তাদের কিছু বলার সামর্থ্য যেন কারোরই নেই।

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু গ্রামে একটি ওষুধের দোকান খুলেছিলেন। মাস ছয়েক করার পর তা বন্ধ করে দিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন, ওষুধের দোকানে নকল ওষুধ না বেচলে লাভ হয় না তেমন। কারণ ওষুধে মার্জিন খুব কম। যারা প্রতিদিন প্রচুর বিক্রি করেন তারা নকল ওষুধ বিক্রি না করেও লাভ করতে পারেন। নকলুভেজাল ওষুধ বিক্রির কৌশল জানতে চাইলে তিনি জানান, বিক্রেতা ক্রেতা বুঝে নকল ওষুধ ধরিয়ে দেয়। বোকাুসরল এবং কম লেখাপড়া জানা সাধারণ ক্রেতাদেরই নকল ওষুধ গছিয়ে দেওয়া হয়। তার মতে বিক্রি হওয়া ওষুধের ৫০ শতাংশই নকল। আর নকল ওষুধ ধরার উপায় খুব কঠিন। ফার্মাসিস্ট ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে নকল ও ভেজাল ওষুধ শনাক্ত করা কঠিন।

নকল ও ভেজাল ওষুধ ছাড়াও ওষুধের দাম নিয়েও আছে চরম নৈরাজ্য। মানুষ সাধারণত ওষুধের দোকানে দরদাম করে না। কারণ এত এত ওষুধের ভিড়ে প্রকৃত দাম জানাটাও কঠিন। ফলে ওষুধের দোকানদার হিসাব করে যত টাকা দাবি করেন ক্রেতারা তাই পরিশোধ করে থাকেন। বছর দুয়েক আগে এন্টাসিড প্লাস সাসপেনসন পাওয়া যেত ৩৫ টাকায়। হঠাৎ করে দুয়েক সপ্তাহ ওষুধটি বাজার থেকে গায়েব হয়ে গেল। এরপরে যখন আবার বাজারে সরবরাহ বাড়ল তখন তার দাম এক লাফে উঠে গেল ৭০ টাকায়। এখন সম্ভবত ৭৫ টাকা। এভাবে কখন, কেন ওষুধের দাম বাড়ে তা ক্রেতাদের জানার উপায় নেই। ওষুধ কোম্পানিকেও এর জন্য কোথাও জবাব দিতে হয় বলে মনে হয় না। যে কারণে বাংলাদেশের ওষুধ বাজার নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলে বছরের পর বছর যদিও ওষুধ প্রশাসন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে বাংলাদেশে।

ভেজাল ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকে। চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসনের অভিযান নিয়ে ওষুধের পাইকারি বাজার হাজারী লেনে বেশ অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে অতীতে । প্রতিবার অভিযানে হাজারী গলি থেকে বিপুল পরিমাণ নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ উদ্ধার করা হয়। কোনো কোনো দোকান মালিককে জরিমানা করা হয়। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় কিন্তু এরপর আবার স্বাভাবিক নিয়মে সেখানে নকল ওষুধ বিক্রি হয়। তবে এবার একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। ৬৮ হাজার ৮০০ প্যাকেট ভেজাল ওরস্যালাইনসহ এক ওষুধ সরবরাহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার নাম সুজন কান্তি সিকদার (৪২)। গত বুধবার রাতে নগরের বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৭২ কার্টনে ভর্তি এসব ভেজাল ওরস্যালাইন উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার সুজনের বাড়ি সীতাকুণ্ড থানার মধ্যম সোনাইছড়ি এলাকায়।

কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির পত্রিকাকে বলেন, হাজারীগলিতে ৭০ কার্টন ভেজাল ওরস্যালাইনসহ এসএমসি কোম্পানির প্রতিনিধি মনোয়ার হোসেন ও বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির নেতারা প্রথমে সুজনকে আটক করেন। পরে পুলিশকে খবর দিলে সমিতির অফিসে গিয়ে তাকে ভেজাল ওরস্যালাইনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর আন্দরকিল্লা বিনিময় মার্কেটের নিচতলায় জননী কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে অভিযান চালিয়ে আরও ১০২ কার্টন ভেজাল ওরস্যালাইন উদ্ধার করা হয়। ১৭২ কার্টনের মধ্যে মোট ৬৮ হাজার ৮০০ প্যাকেট ভেজাল ওরস্যালাইন পাওয়া যায়।

প্রায় প্রতিটি ওষুধের দোকানে ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হয়। মূলত ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রির নামে এক ধরনের প্রতারণা চলছে দেশে। দেশের বেশিরভাগ ফার্মেসিতে ফুড সাপ্লিমেন্টের নামে ভেজাল, নকল ও মানহীন পণ্য বিক্রি করছে ফার্মেসিগুলো। আমদানিকারকরা ফুড সাপ্লিমেন্ট আমদানি ও তার বাজারজাত করার জন্য সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছে। ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখার জন্য আমদানিকারকরা চিকিৎসকদের নানা ধরনের অবৈধ সুবিধা ও উপটৌকন দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞার পরও কিছু শ্রেণির চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে রোগীদের ফুড সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্বের উন্নত দেশে কোনো কোম্পানির ওষুধের ব্র্যান্ড নাম লেখেন না চিকিৎসকরা। তারা শুধু জেনেটিক নামটিই লিখে থাকেন। ফলে সেখানে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা চিকিৎসককে প্রভাবিত করার সুযোগ পান না। চিকিৎসকরাও কোনো কোম্পানির সুবিধা গ্রহণ করে তাদের মানহীন ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার সুযোগ পান না। বাংলাদেশের বাজারে মানহীন ওষুধ বিক্রি হওয়ার পেছনে চিকিৎসকরাও কম দায়ী নন। তারা ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পক্ষান্তরে কোম্পানির কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে তাদের মানহীন ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিয়ে রোগীদের ঠকাচ্ছেন, প্রতারিত করছেন। চিকিৎসকদের চেম্বারের দরজায় কিংবা হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক চেম্বারে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের ভিড় দেখে বোঝা যায় এ বিষয়ে উভয় পক্ষ কেমন তৎপর। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে ঘাপটি মেরে থাকা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসা রোগীর ব্যবস্থাপত্র নিয়ে কাড়াকাড়ি করেন। তারা তড়িঘড়ি করে মোবাইলে ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলার জন্য রোগীদের হাত থেকে ব্যবস্থাপত্রটি এক প্রকার ছিনিয়ে নেন। এ বিষয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। বছর দশেক আগে, তখন মোবাইলে মোবাইলে ছবি তোলার এত সুযোগ ঘটেনি। এমনি একদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বের হয়ে একটি ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি ওষুধ কেনার জন্য। পকেট থেকে বের করে ব্যবস্থাপত্রটি হাতে নিতেই একজন তা আমার কাছ থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিলেন। আমার ব্যবস্থাপত্র ছিনতাই হয়েছে ভেবে আমি যখন চিৎকার করছিলাম তখন দোকানদার বললেন, আপনার প্রেসক্রিপসন ফটোকপি করতে গেছেন। এখনই চলে আসবে। ‘ছিনতাইকারীঠিকই কিছুক্ষণ পর আসলেন এবং আমার ব্যবস্থাপত্র ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমি ততক্ষণে অনেক কিছু মনে করেছি। তা ঝাড়ার উদ্যোগ নিতেই দোকানদার ভদ্রলোক বললেন, বেশি কিছু বলবেন না, কারণ এখানে ওরা দলে ভারী আর আপনি একা।

এই ওষুধ ব্যাপারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন থেকে অভিযান পরিচালনা করতে গেলেই তারা দোকান বন্ধ করে দেয়। ওষুধের দোকানে ধর্মঘট ডাকে। ওই ওষুধ ব্যাপারীরা ভালো করেই জানে এই জাতি অন্যকিছু ছাড়া চলতে পারলেও ওষুধ ছাড়া একদিনও চলতে পারবে না। ফলে এক সময় প্রশাসন শিথিল হয় আর ওষুধ ব্যাপারীরা মহাউৎসাহে আবার নেমে পড়ে মানহীন, মেয়াদহীন, নকল, ভেজাল ওষুধ বিক্রির মহোৎসবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শেখ হাসিনা : সত্যের সারবত্তা
পরবর্তী নিবন্ধএকটি হুইলচেয়ার ও সাফায়াত খান