কাল আজ কাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১১ আগস্ট, ২০২২ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

ডিসি হিল : ‘আটটা বাইজ্জি বাইর হই য’ন’
মহামারি পরিস্থিতি একটু ভালো হওয়ার পর মাঝেমধ্যে হাঁটতে বের হই সন্ধ্যায়। চট্টগ্রামে হাঁটার কোনো জায়গা নেই। পুরো কভিডকালীন ডিসিহিলে লোক ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেটাও খুলে দেওয়া হয়েছে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে। কাছাকাছি আছে সিআরবি। সেখানেও আর বেশিদিন হাঁটা যাবে কিনা মনে হয় না। বেসরকারি হাসপাতাল ইউনাইটেডের জন্য অন্য কোথাও এখনো জায়গা বরাদ্দ হয়নি ফলে একটা দুর্ভাবনা রয়ে গেছে নগরবাসীর। ফুটপাতে তো হাঁটার সুযোগই নেই এই শহরে। অগত্যা আমাকে ডিসিহিলে যেতে হয়। একটু হাঁটাহাঁটি করে বসতে না বসতেই রাত আটটা বেজে যায় আর তার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় হ্যান্ডমাইক দিয়ে গার্ডের তীক্ষ্‌ণ আদেশ, ‘আটটা বাইজ্জি বাইর হই য’ন।’ অর্থাৎ আটটা বেজেছে বের হয়ে যান। একপ্রকার জোর করেই লোকজনকে বের করে দেওয়া হয়। এই গরমে এখন দিন বড়। সন্ধ্যা হতে হতে সাতটা বাজে। এরপর রাত আটটার মধ্যেই যদি বেরিয়ে যেতে হয় তাহলে মানুষগুলো যাবে কোথায়? একটু খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার অধিকারও কি তাদের নেই? রাষ্ট্রটি কি জনগণের না?
চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পীঠস্থান ছিল ডিসি হিল বা নজরুল স্কয়ার। প্রায় বছরব্যাপী এখানে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উৎসব ও বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। সেটা এখন অতীত হয়ে গেছে। নববর্ষ ও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেয় না প্রশাসন। একটি সময় ছিল যখন এই পাহাড় বিভিন্ন বড় বড় বৃক্ষরাজীতে পরিপূর্ণ ছিল। বিশাল বিশাল শিশু গাছের শেকড়ে বসে মানুষ আড্ডা দিতো। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হওয়া নববষের্র অনুষ্ঠান হতো এসব গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে, ছায়ায় ছায়ায়। এই পাহাড়ের পাশ দিয়ে আসতে যেতে হঠাৎ কখনো পলাশ বা শিমুল গাছের ফুল দেখে বোধ হয়েছে এখনতো বসন্তকাল। আমাদের কৈশোর-তারুণ্যে এত এত মিডিয়া টিভি বা পত্রিকা ছিল না। অনেক ঘটা করে আড়ম্বর করে বসন্ত উৎসবও পালিত হতো না। ডিসি হিলের পলাশ ফুল দেখে আর তার ডালে বসা কোকিলের কুহুতান শুনে বুঝতে পারতাম ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ডিসি হিলের সংস্কার করে বর্তমান মঞ্চ ও স্থায়ী গ্যালারি নির্মাণ করে।
এক সময় চট্টগ্রাম শহরেই অনেক পাহাড় ছিল। বর্তমান ডিসি হিলটি এই এলাকার কয়েকটি পাহাড়ের মধ্যে একটি। আন্দরকিল্লা নজির আহমদ সড়কের পশ্চিমে, মোমিন রোডের দক্ষিণ-পূর্ব, বৌদ্ধ মন্দিরের পূর্ব ও সিনেমা প্যালেসের উত্তর অংশ জুড়ে কয়েকটি পাহাড়। ১) ফরেস্ট হিল, ২) তুলসী ধাম, যা কাটার পর একদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও টেলিগ্রাফের টাওয়ার, ৩) কমিশনারের পাহাড় ও ৪) জাফর আলী হিল বা বর্তমানের ডিসি হিল। ইতিহাস বিবৃত করলে পাঠকদের সুবিধা হবে বুঝতে তাই একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই।
ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে ইংরেজ শাসকরা পার্বত্যবাসীদের খুশি করতে তৎকালীন চাকমা রাজাকে এই চারটি পাহাড়ের মালিকানা প্রদান করে। পরবর্তীতে আঠারো শতকের শেষ দশকে ইংরেজ সরকার চাকমা রাজাদের কাছ থেকে ওর বেশির ভাগ অংশ পওনি হিসেবে নেয়। দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার বর্তমান এই পাহাড়গুলো হুকুম দখল করে। তবে ডিসি হিলের পূর্ব দিকে চাকমা রাজাদের সম্পত্তি এখনও আছে। তাদের একটি দীঘি ছিল যার নাম ছিল রাজাপুকুর। এখন পুকুর নেই রাস্তার নাম রয়ে গেছে রাজাপুকুর লেইন। বর্তমান ডিসি হিল এক সময় জাফর আলী হিল নামে খ্যাত ছিল। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে এটি তৎকালীন সরকারি উকিল বাঁশখালীর জাফর আলী খানের বাস ভবন ছিল। পরবর্তীকালে সাব জজ এবং জাফর আলী খানের সন্তান আনোয়ার আলী সেখানে বসবাস করতেন। এখানেই আনোয়ার সাহেবের পুত্র দার্শনিক ও চিন্তাবিদ শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো স্থাপিত হয়। ওই পদ বিলুপ্ত হলে ডিসি বা জেলা প্রশাসকরা বর্তমানে এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত বাংলোতে বসবাস করে আসছেন।
বর্তমানে ডিসি হিলে একটি মুক্ত মঞ্চ ও দর্শক গ্যালারি আছে। আছে কিছু নার্সারি ও ফুলের দোকান। ডিসিহিল নিয়ে আমি কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলাম বেশ কয়েকবছর আগে তার মধ্যে ছিল, সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর গাছ কেটে পুরো পাহাড়জুড়ে দেশীয় ফলের গাছ রোপণ করা। আমাদের সন্তানরা বেশিরভাগ দেশীয় ফল চেনে না, গাছ দেখা তো দূরের কথা। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সারা পাহাড় জুড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে দিলে সবাই ঘুরে ঘুরে গাছ চিনবে, ফল চিনবে। এর মধ্যে কয়েকটি অ্যাপ্রোচ নির্মাণ করে দিলে রোদ ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সেখানে আশ্রয় নেবে তারা। ফলের বাগান হলে সেখানে আপনা থেকেই পাখি আসবে। গড়ে উঠবে পাখিদের অভয়াশ্রম। এর মধ্যে কিছু মনুষ্যবান্ধব পশু যেমন খরগোস, বানর ইত্যাদি ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
লিখেছিলাম, ‘এই ফলের বাগান থেকে হয়ত আর্থিক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গাছ, ফুল, ফল চেনাতে ও মৃত্তিকা সংলগ্ন করতে বিশাল ভূমিকা রাখবে। এই পাহাড়ে আর একটিও স্থাপনা চাই না। আর এক ইঞ্চিও ইট-চুন-সুরকীর প্রলেপ চাই না। এই পাহাড় তার সবুজ নিয়ে অক্ষত থাকুক।’
এই বিরাট নগরীজুড়ে শুধু ইট-সিমেন্টের অট্টালিকা। কোথাও একটু খোলা ময়দান নেই। আমাদের চট্টগ্রামে কোনো ‘রমনা পার্ক’ নেই, ‘সোহরাওয়ার্দী’ ও ‘ওসমানী উদ্যান’ নেই, আমাদের জাতীয় উদ্যান নেই। তেমন কোনো খোলা মাঠ নেই, সরোবর নেই, লেক নেই, নয়ন জুড়ানো একটু সবুজ নেই। এই বিস্তৃত-বিস্তীর্ণ শহরে একটু খোলা মাটি নেই যে মাটি একটু বৃষ্টির জল শোষণ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আমাদের সন্তানদের জন্য অন্তত এই ডিসি হিলকে উন্মুক্ত রাখুন- যেখানে জল-কাদা মাখামাখি করতে পারে তারা। হাজারো ভেজালের ভিড়ে এখনও এখানে ভোরে ও সন্ধ্যায় শত শত স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ আসে একটু খোলা নিঃশ্বাস নিতে এই ব্যবস্থাটি রুদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত যেন করা না হয়। এই নগরীর হৃদপিণ্ড এই ডিসি হিলকে সবুজে সবুজময় করা জরুরি। এর জন্য খুব বেশি ব্যয়ের প্রয়োজন নেই। মাত্র কয়েক লাখ টাকায় পুরো পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন সম্ভব। দখলে-দূষণে চট্টগ্রাম দিন দিন বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এই শহরের হাজার হাজার দীঘি-পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। পাহাড় কেটে কেটে চট্টগ্রামের ভৌগোলিক বিশেষত্ব খর্ব করা হয়েছে। নদী-খাল দখলে-দূষণে-তার গতিপথ হারিয়েছে। আমরা আমাদের সন্তানদের কী বীভিষীকাময় ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এর দায় থেকে আমরা কেউই রক্ষা পাব না।
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষে। উন্নত বিশ্বের পাপের দায় নিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে। এই অবস্থায় আমাদের সকল উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার দিকে নজর দিতে হবে প্রথমে। আর সে সঙ্গে এটাও স্মরণে রাখা দরকার যে, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে জাতিকে সমৃদ্ধ করা যাবে না। এর সঙ্গে মানবিক উন্নয়নের সমন্বয় যদি না ঘটে তাহলে একটি অন্ধ কূপমণ্ডূক প্রজন্ম গড়ে উঠবে তাতে দেশ ও জাতির প্রকৃত কল্যাণ সাধন হবে না। তার জন্য দরকার উদার সংস্কৃতিচর্চা। আজ সমাজে যে অবক্ষয় শুরু হয়েছে তার জন্য দায়ী সংস্কৃতিচর্চার অভাব। সংস্কৃতিচর্চা যে মানুষের মধ্যে সতত, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও মানবতাবোধোর উন্মেষ ঘটায় তা যত দ্রুত বুঝতে পারব তত দ্রুতই আমাদের উজ্জ্বল উদ্ধার হবে।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কমাতে হবে আমদানি নির্ভরতা
পরবর্তী নিবন্ধসরকার নির্ধারিত ভাড়ার বাড়তি না দিতে যাত্রীদের প্রতি আহ্বান সুজনের