কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা
হলে জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে

ভাষাকে যদি একটা নদীর সাথে তুলনা করি তাহলে আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে বলতে হয় খাল বা শাখা নদী । একটি নদীকে যেমন বাঁচিয়ে রাখে, প্রবহমান রাখে তার উপনদী, শাখানদী, খাল ও ছড়া তেমনি একটি জাতীয় সংস্কৃতি ও ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে, সমৃদ্ধ করে আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি । এ বাস্তবতা শুধু বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বের নানা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বিদ্যমান ।
ভাষার সংজ্ঞায় আঞ্চলিক ভাষাগুলো পূর্ণ ভাষা নয়, উপভাষা । কারণ এর নিজস্ব বর্ণ নেই । লেখ্য রূপ নেই । বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি প্রচলিত। এর মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি থেকে তুলনামূলকভাবে অধিক ভিন্ন এবং তা দুর্বোধ্যও বটে ।
চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেমন-
১। চট্টগ্রামের মানুষ পরস্পরের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে । চট্টগ্রামের মানুষ তাদের পরস্পরের সাথে প্রমিত বাংলায় কথা বলাকে এক প্রকার অসৌজন্যতা বলে মনে করে। পরিচয় পাওয়ার পরপরই তারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা শুরু করে। ২। এ ভাষায় বক্তারা খুব দ্রুত কথা বলে । ফলে অন্যভাষার লোকের পক্ষে এ ভাষা বোঝা আরও কঠিন হয়ে পরে। অনেকে উচ্চৈঃস্বরেও কথা বলে। ৩।এ ভাষায় গালাগালি ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার বেশি । অবশ্য বিশ্বের নানা দেশের আঞ্চলিক ভাষায় অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ বেশি দেখা যায়। ৪। শুধু ভাষাগত নয়, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক পরিচ্ছদ, অনুষ্ঠানাদি, আচার-আচরণ ও ব্যবহারের দিক দিয়েও চট্টগ্রামবাসীর আলাদা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ৫। এই ভাষায় রচিত গানগুলো শ্রুতিমধুর, রোমান্টিক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদিরসাত্মক। ৬। বিশ্বের নানা ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। ইংরেজি, আরবি, উর্দু, হিন্দি, ফার্সি, বার্মিজ শব্দের ব্যবহারে এই আঞ্চলিক ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। ৭। বর্তমানে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। ৮। যেহেতু এই ভাষার কোনো লেখ্যরূপ নেই সেহেতু এটি আঞ্চলিক বা উপভাষা হিসেবে পরিগণিত। ৯। লক্ষণীয়, শুধুমাত্র একটি বর্ণে একটি অর্থবোধক শব্দ বা বাক্য প্রকাশ করা যায় এই ভাষায় । যেমন, ‘ব’- বয় বা বসো, ‘ল’- নে বা নাও, ‘দ’- দে বা দাও ইত্যাদি । এই ভাষার কিছু শব্দ উচ্চারণের জন্য যথার্থ বর্ণ বা অক্ষর বাংলায় নেই । যেমন- ক ও খ, প ও ফ, চ, ছ, ও স ইত্যাদি শব্দের মাঝামাঝি উচ্চারিত হওয়ার মতো বর্ণ বাংলায় নেই । ফলে বানান দেখে প্রকৃত উচ্চারণ করা অন্য জেলার মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । শোনা ও অনুশীলন ছাড়া এই ভাষা রপ্ত করা খুব কঠিন। আরেকটি উদাহরণ দিই, পুকুর, ফকির ও পালককে চট্টগ্রামের ভাষায় লিখতে গেলে লিখতে হবে- ‘ফইর’। অথচ উচ্চারণের দিক থেকে তিনটির মধ্যে সূক্ষ পার্থক্য আছে যা একমাত্র চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষেই উচ্চারণ করা সম্ভব। ১০। একই জেলার মধ্যেও উচ্চারণ ও অর্থগত দিকের ভিন্নতা লক্ষণীয় । উত্তর জেলার সাথে দক্ষিণ জেলার মানুষের উচ্চারণ ও শব্দগত অর্থের ভিন্নতাও লক্ষ করার মতো । আবার দক্ষিণ জেলার চাটিগ্রাঁই (খাঁটি চট্টগ্রামী) ও রোঁয়াইদের (রোহিঙ্গা থেকে আগত) মধ্যেও তারতম্য আছে। ১১। উচ্চারণ ও শব্দ ব্যবহারে সমপ্রদায়গত ভিন্নতাও আছে চট্টগ্রামে । কিছু কিছু শব্দ আছে যা হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে । কিছু কিছু শব্দ ব্যবহারে হিন্দু বা মুসলিম পরিচয় শনাক্ত করা যায়। এটি অন্য জেলায় আছে বলে আমার জানা নেই। যেমন- মুসলিমরা বলেন, আইয়ুন কিংবা আইয়ুন জে। হিন্দুরা বলেন, আসতক। মুসলিমরা বলেন, বইয়ুন, হিন্দুরা বলেন, বসতক । ১২। চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিতে বাঙালি সংস্কৃতির চেয়ে আরাকানি বা বার্মিজ সংস্কৃতির প্রভাব বেশি। একসময় চট্টগ্রামের অধিকাংশ নারী বার্মিজদের মতো থামি, লুঙ্গি পরিধান করতো। এখনও দক্ষিণ চট্টগ্রামেসহ গ্রামাঞ্চলে থামি পরার প্রচলন আছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতির মতো বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ওপরও আগ্রাসনের প্রভাব পড়েছে। আর আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রভাবটি আরও বেশি। কারণ নতুন প্রজন্মের সন্তানরা এখন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। বাবা মায়েরাও তাদের সন্তানদের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না। ফলে আশংকাজনকভাবে এই ভাষা ও সংস্কৃতির সংকোচন ঘটছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, উপভাষা বা আঞ্চলিকভাষাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেলে, হারিয়ে গেলে তা জাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে । তা মূলভাষার সমৃদ্ধি ও বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। প্রতিনিয়ত একাধিক ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে । যদি কোনো ভাষা কোন কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় এবং সে ভাষায় বিকল্প ভাষা ব্যবহার শুরু হয় তাহলে সে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায় । এ ধরনের অনেক বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় ভাষা আছে। যেমন: সংস্কৃত ভাষা, লাতিন ভাষা, হিব্রু, ওল্ড চার্চ স্যালভোনিক, পুরনো তিব্বতীয়, গিজ, ইত্যাদি । এছাড়াও অন্য অনেক ভাষা আছে যেগুলো ছোট ছোট জনগোষ্ঠী, উপজাতীয় ও আঞ্চলিক ভাষা । সেগুলো চর্চা বা ব্যবহারের অভাবেও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে । এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে মোট ৬,৯১২টি জীবন্ত ভাষা আছে । আর এই ভাষায় পৃথিবীর ১৮৯টি স্বাধীন দেশের প্রায় ছয় বিলিয়নের মতো মানুষ কথা বলে । ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ ভাষাগুলোই কোনো না কোনো দেশের মানুষ ব্যবহার করে । একটি দেশের অধিকাংশ লোক যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষা রাষ্ট্রীয় সব কাজে ব্যবহৃত হয় সেটিকে বলা হয় রাষ্ট্রভাষা।
ভাষা মৃত হওয়ার কারণ: ১. ভাষা সঠিকভাবে ব্যবহার না করা। ২. নতুন নতুন শব্দ হালনাগাদ না করা। ৩. কোন ভাষা বা শব্দটি হারিয়ে যাচ্ছে সেটি শনাক্ত না করা। ৪. নিজেদের ভাষা বা শব্দ ব্যবহারে অন্য ভাষার প্রাধান্য বা বিকল্প ভাষা ব্যবহার করা। ৫. আঞ্চলিক ভাষাকে অবমূল্যয়ন বা তুচ্ছ করা। ৬. নতুন নতুন শব্দ ও হারিয়ে যাওয়া ভাষা প্রচার-প্রচারণা না করা। ফলে আঞ্চলিকভাষা, সেগুলোর লেখ্যরূপ নেই, যা শুধু শ্রুতির মাধ্যমে পরম্পরায় টিকে আছে, তেমন ভাষার হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি । জাতীয় স্বার্থে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বার্থে আমাদের উচিত আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা । আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা মানে আঞ্চলিকতা নয়।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআঞ্চলিক গানের বিশ্বায়নে শেফালী ঘোষ
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম