কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৩ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

পুরনো খালের খবর নাই, নতুন খালের উদ্বোধন

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৩৬টি খালের মধ্যে ১৮ থেকে ২০টি খালে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে শেষ হবে। এরপর খালগুলোতে বর্তমানে কাজের সুবিধার্থে যে মাটির বাঁধ দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অপসারণ করা হবে। একইসঙ্গে সম্পূর্ণ খনন করা হবে খালগুলো। এতে বর্ষায় দ্রুত পানি নিষ্কাশনে আর বাধা থাকবে না। এছাড়া বর্ষার আগেই ১৭টি খালের মুখে সুইস গেট বসানোর কাজ শেষ হবে। এতে জোয়ারের পানি ঢুকে সৃষ্ট জলাবদ্ধতাও নিয়ন্ত্রণে আসবে। আহা শান্তি! এমন সংবাদ পড়েও শান্তি, শুনেও শান্তি! এমন যদি সত্যি ঘটতো! কিন্তু গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, ঘটবে না তেমন কিছু। এ শুধু তর্জন-গর্জনই সার।
চট্টগ্রাম মহানগরের জলাবদ্ধতা নিরসন সংক্রান্ত অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় এমন আশাজাগানিয়া! আশ্বাস উঠে আসে। গত ৯ জানুয়ারি টাইগারপাস নগর ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সভায় এই কথা বলা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। অতিথি ছিলেন সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ।
এ সভায় মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১টি খাল খননের ওপর জোর দেওয়া হয়। সিডিএ’সহ উপস্থিত বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কাছে প্রস্তাব করেন, খালগুলো নিয়ে যেন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। অবশ্য সভার শুরুতে মেয়র সিডিএ’কে তাদের প্রকল্পে খালগুলো অন্তর্ভুক্ত করার আহ্‌বান জানান। এছাড়া যে ৩৬ খালে সিডিএ কাজ করছে তার তালিকা সরবরাহের অনুরোধ করেন। সভায় মেয়র ও সিডিএ চেয়ারম্যান উভয়ই সমন্বয়ের ওপর জোর দেন। এছাড়া সুইচ গেট স্থাপন শেষে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
আহা প্রতিশ্রুতি, আহা পরিকল্পনা! নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে যুগের পর যুগ কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা দেখতে দেখতে ক্লান্ত নগরবাসী এখন প্রতিশ্রুতির শ্রুতি আর পরিকল্পনার কল্পনা নিয়ে দিন কাটান। সম্ভবত এখন নগরবাসী জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়ে তাদের আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকবছর আগে ‘জলাবদ্ধতা নিরসন; একটি সিম্পল ম্যাথ’ শিরোনামের কলামে লিখেছিলাম, ‘জলাবদ্ধতা কেন হচ্ছে? এর কারণ অনুসন্ধানে কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পন্থা বের করতেও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। অঙ্কটি বেশ সোজা। পানিকে তার গন্তব্যে যাওয়ার রাস্তা করে দিন। সে কোথাও জমবে না। রাস্তা ডোবাবে না, কারো বাড়ি ঘর ডোবাবে না। নগরায়ণের ফলে জলাশয় ও নিম্নভূমি যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকার সুযোগ ছিল, তা ভরাট করে দালানকোটা তৈরি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি জমার ক্ষেত্র সংকীর্ণ হয়েছে। নগরায়নের ফলে সড়ক প্রশস্ত হয়েছে, খাল ও নালার ওপর সড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হয়েছে ফলে খাল ও নালাগুলো ভরাট ও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। বক্স কালভার্ট করে খালগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। খালের দু’পাশে অবৈধ দখলকারীরা স্থাপনা নির্মাণ করে খালকে সরু করে তুলেছে। অর্থাৎ নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু পানি চলাচলের পথ দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতম হয়েছে। মহাশয়রা সড়ক বড় করবেন তার সাথে নালা বড় করবেন না, ইমারত বানাবেন খালের জায়গা ছাড়বেন না তো সে পানি যাবে কোথায়। তারতো যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে দিতে হবে। সড়কে যানজট না হওয়ার জন্য ট্রাফিক সিগন্যাল বসাবেন, কনস্টেবল-সার্জেন্ট নিয়োগ দেবেন আর পানি চলাচলের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখবেন না তা কী করে হয়। সড়কে ময়লা পড়লে তা পরিষ্কার করবেন, দোকানদার বসলে তাদের তাড়াবেন আর পানি চলাচলের পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকবেন তাতে পানি না জমে কি শরবত জমবে?
দখল দূষণের পরও বর্তমানে যে খাল ও নালাগুলো আছে তা শুধু পরিষ্কার রাখলেও জলাবদ্ধতা ৮০ শতাংশের বেশি কমে যেত। একটি নালা বা খালও নেই শহরে যেটি পরিষ্কার আছে এবং তার ধারণ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার হয়। সবক’টি নালা ও খাল বিভিন্ন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। শুধু এই আবর্জনা তুলে খাল ও নালাগুলোর ধারণ ক্ষমতা ফিরিয়ে আনলেই জলজটের সমস্যা কমে যাবে। আর এই কাজটি বর্ষার আগে আগে নিয়মিত করলে হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের প্রয়োজন হতো না। খালগুলোকে আবর্জনার ভাগাড় বানিয়ে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করতে যারা প্রতি বছর সড়ক উঁচু করে করে আশেপাশের বসবাসকারীদের বারোটা বাজিয়েছেন তাদের নির্বুদ্ধিতা বা অসৎ উদ্দেশ্যের নিন্দা না করে পারি না।
মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরা কোত্থেকে এবং কীভাবে কাজ শুরু করবেন জানি না, তবে আমি মনে করি, মেগা কাজের ফল পেতে আমাদের হয়ত মেগা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে এখন থেকেই নালা ও খালগুলো সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কারের উদ্যোগ নিন। এখনো যেটুক আছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার অর্থাৎ খাল ও নালার ধারণ ক্ষমতা পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনুন। সড়কের পানি দ্রুত নালায়, নালার পানি খালে এবং খালের পানি নদীতে নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। এই পথটুকু যেতে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করার উদ্যোগটি আগে নিন। খাল এবং নালাগুলোকে পরিষ্কার রাখতে নিয়মিত ব্যবস্থা নিন। যার বাড়ির অংশের নালা ও খালে আবর্জনা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’।
জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পে অধীনে কাজ চলছে ৩৬টি খালে। এর বাইরে (সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে) আরও ২১টি খাল আছে। এগুলোর অধিকাংশই ভরাট হয়ে কোনো কোনো স্থানে পাশের রাস্তার চেয়েও উঁচু হয়ে গেছে। এই খালগুলোতে দুই দশকেও হাত দেয়নি সিটি কর্পোরেশন তা খাল দেখেই বোঝা যায়। এবার মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সে বিষয়েও কথা বলেছেন। একই সভায় তিনি একটি প্রস্তাব দিয়ে বলেন, মেগা প্রকল্পের আওতায় ৩৬ খালে প্রকল্পের কাজ চলছে। এর বাইরে ২১টি খাল রয়ে গেছে। এগুলোকে যদি প্রকল্পের আওতায় আনতে না পারি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না। অনেক খালে স্থাপনা হয়ে গেছে, ভরাট হয়ে গেছে। একটা খালের সাথে অন্য খালের সম্পর্ক আছে। ৩৬টি খালের লিস্টটা আমাদের দেন। এর বাইরে ২১টি খালের লিস্ট মাস্টার প্ল্যানে আছে, সেটাও দেন। আমরা মাটি উত্তোলন করব। তিনি বলেন, যদি সিডিএ বলে খালগুলো সিটি কর্পোরেশন করবে, তাহলে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাাব দিতে পারব। যদি সিডিএ তাদের প্রকল্পে অর্ন্তভুক্ত করতে চায় এতেও রাজি। মূল কথা হচ্ছে, যে সংস্থাই করুক আমরা যেন জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাই।
জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ শুরুর এত বছর পরও সিডিএ কোন কোন খালে কাজ করছে তার ‘লিস্ট’ সিটি করপোরেশনের হাতে না থাকাটা বিস্ময়কর নয় কি?
এই যখন পরিস্থিতি অর্থাৎ যে খালগুলো আছে সেগুলোরই যখম সংস্কার করতে পারছে না সিটি করপোরেশন তখন নতুন খাল খননের উদ্যোগ নিচ্ছে সিটি করপোরেশন। শুধু তাই না একই খাল খননের উদ্বোধন হয়েছে দু’বার।
গত ২৭ নভেম্বর একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ছিল এমন, ‘দেড় বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্পটি দুই বার উদ্বোধন করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। অথচ সাবেক মেয়র মনজুর আলমের সময়ে অনুমোদন পাওয়া এ খাল খননের কথা ছিল আরও সাড়ে ৬ বছর আগে।
মূলত জলাবদ্ধতা দূর করতে ২০১২ সালে এই খাল খননের উদ্যোগ নেয় চসিক। বারইপাড়া হাইজ্জারপুল থেকে শুরু হয়ে খালটি নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজের পাড়া, বলিরহাটের বলি মসজিদের উত্তর পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশবে। খাল খনন শেষ হলে পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ শুলকবহর, চান্দগাঁও, মোহরা এবং পূর্ব ও পশ্চিম ষোলশহর এবং সংলগ্ন এলাকাসহ মোট আটটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে বলে কর্মকর্তারা আশা করছেন’।
কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা আর জনগণের দাবির মধ্যে ফারাক আছে। নাগরিক তথা ভুক্তভোগীদের দাবি হলো, আগে যে খালগুলো আছে তা দূষণ ও দখলমুক্ত করা। খালগুলোর ধারণক্ষমতা ফিরিয়ে আনা। তারপর দেখা যাবে নতুন খালের প্রয়োজনীয়তা। প্রয়োজন হলে খাল খনন হবে তাতে কারো আপত্তি নেই তবে তার আগে দরকার পুরনো খালগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। তা না হলে হাজার কোটি টাকার নতুন খালকেও পুরনো খালের ভাগ্য বরণ করে নিতে হবে।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিউটনের কোয়ারেন্টাইনে যেসব আবিষ্কার পেয়েছিল বিজ্ঞান
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম