কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বাঙালির যেমন কিছু গৌরব ও অহংকারের দিন আছে তেমনি কিছু কলংক ও বেদনার দিনও আছে। মাথা নত না করার যেমন একুশ আছে, বিদ্রোহ বিপ্লব শেকল ভাঙার ২৬ মার্চ আছে, বিজয়ের ১৬ ডিসেম্বর আছে তেমনি আছে কলংক, অপমান আর ধিক্কারের ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ১৪ ডিসেম্বর।
১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ১৪ ডিসেম্বর শুধু বাঙালির নয়, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহসেরও কলংকজনক অধ্যায়।
১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়েছিল ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের শিশু-নারী সবাইকে। ৩ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা কারাগারের অভ্যন্তরে ঢুকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছিল জাতীয় চারনেতাকে। যাঁরা ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও জাতির জনকের ঘনিষ্ঠ অনুসারী।
১৪ ডিসেম্বরও ইতিহাসের আরেকটি কলংকজনক দিন। ১৯৭১ সালে ২৫ মাচের্র মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এদেশে পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু করে। সাধারণ বাঙালিদের হত্যার পাশাপাশি তারা বেছে বেছে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, নাট্যকার, সংস্কৃতিকর্মী তথা বুদ্ধিজীবীদের। তবে বুদ্ধিজীবীদের সবচেয়ে বেশি হত্যা করা হয় ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে, যখন পাকিস্তানি সেনা শাসকরা বুঝতে পারে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে, পরাজয় তাদের সুনিশ্চিত।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হলেও দেশের সকল বুদ্ধিজীবীদের এই দিনেই হত্যা করা হয়েছে তেমন নয়। শুরুতেই পাকিস্তানিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন দেশের বরেণ্য সন্তানরা। এই হত্যাযজ্ঞ চলেছে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। নয় মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত সকল বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। বেছে বেছে দেশের বরেণ্য সন্তান তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার মতো ঘটনা বিশ্বের কোথাও সংঘটিত হয়নি। কোনো যুদ্ধে এত কম সময়ে এত লোককে হত্যা, এত নারী ধর্ষণ এবং এত বুদ্ধিজীবী হত্যা করার ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি। বাঙালির আত্মশ্লাঘার বিষয় যে, এই জাতির স্বাধীনতা দিবস ছাড়াও একটি বিজয় দিবস আছে। বাঙালির কষ্ট ও দুঃখের বিষয় যে, তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আছে।
বুদ্ধিজীবীদের কেন হত্যা করা হয়েছিল তা বলতে গেলে শান্ত, নির্বিরোধী, ঘরকুনো বাঙালিকে কেন যুদ্ধে যেতে হলো, মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তার র্পূর্বাপর বিশ্লেষণ করতে হবে।
১১৪৭ এর দেশ ভাগে বাঙালির প্রকৃত কোনো অর্জন হয়নি। বরং এক ঔপনিবেসিক শাসক থেকে আরেক নব্য ঔপনিবেশিক শাসকের কবলে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলা পরে পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানের বাংলাদেশের জনগণ। ফলে প্রকৃত স্বাধীনতার আকাঙ্‌ক্ষা এ দেশের মানুষের অন্তরে রয়েই গেল। এই আকাঙ্‌ক্ষার প্রথম অঙ্কুরোদগমন ঘটে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেদিনের সে ভাষা আন্দোলন, যা ছিল মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তা-ই বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ধাপ আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে তার চূড়ান্ত পরিণতি।
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, ইতিহাসের রাখাল রাজা, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। মাত্র তেইশ বছরের ব্যবধানে এই উপমহাদেশে আরেকটি প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধিকার, সমঅধিকার ও নিজেদের প্রাপ্য সুনিশ্চিত করতে ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি প্রণীত করেছিলেন এবং এক আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তিতে মাত্র ৪ বছরের মধ্যে স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো এক আশ্চর্য মোহনীয় জাদুতে ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে আন্দোলন ও একটি সুমহান জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রণা দিয়েছিলেন।
১৯৫২ থেকে জেগে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রাপথে রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও পরিচালিত হয়েছিল সমান্তরালভাবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সে সংগ্রাম ও আন্দোলনে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক তথা বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও নেমে এসেছিলেন রাজপথে। স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে তারাও রাজনীতিকদের পাশাপাশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেদিনের সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পালন করেছিলেন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা। যার কারণে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর কাছে দেশের এই বরেণ্য সন্তানরা হয়ে পড়েছিলেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। তাই আক্রমণের প্রথম থেকে তারা হত্যায় মেতে উঠেছিল এই বরেণ্য সন্তানদের।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর দেশের অনেক স্থান হানাদারমুক্ত হচ্ছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে পাকিস্তানি সেনাশাসন। মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে নিয়াজির বাহিনী পরাজয়ের দিন গুনছে সে সময় পাকিস্তানের দালাল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আলবদর বাহিনী এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়ন করে।
তারা যখন বুঝতে পারে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন তারা স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে একে একে ধরে এনে হত্যা করে দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের।
পাকিস্তানিরা এদেশের বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা জানতো না। এ কাজে তাদের সহায়তা করে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ ও তাদের আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। তারা টেনে-বেঁধে ধরে এনে রায়ের বাজারের নির্জন এলাকায় নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে দেশের বরেণ্য সন্তানদের।
একটি দেশের জন্যই শুধু নয়, এক সুমহান আদশের্র জন্য তাঁদের প্রাণ দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস এবং তার পরের ঘটনা যদি আমরা স্মরণ করি তাহলে দেখব, বাংলাদেশের সৃষ্টি শুধু মাত্র একটি রাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়। একটি আদর্শ, স্বপ্ন ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ নিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তা স্পষ্ট হয় যখন দেখি বিজয় লাভের এক বছরের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণীত হলো, যা বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সে সংবিধানে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ও চার স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করা হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙলি জাতীয়তাবাদকে। মুসলিম বিশ্বে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র যা ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম বলে ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তান ছিল একটি সামপ্রদায়িক রাষ্ট্র। শোষণ, অসাম্য, দমন-পীড়ন ছিল সে রাষ্ট্রের চরিত্র। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি এই রাষ্ট্রটি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছিল পাকিস্তানের অনুরূপ আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। যে সব কারণে জাতি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে সেসব কারণ নতুন রাষ্ট্রটিতে বিদ্যমান থাকতে পারে না। ফলে বাংলাদেশ হবে পাকিস্কান নামক রাষ্ট্রের ভাবধারা ও চরিত্রের বিপরীত এটাই স্বাভাবিক। এবং বাস্তবে হয়েছিলও তাই। স্বাধীন রাষ্ট্রের মূলনীতি হয়েছে সামপ্রদায়িকতার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা। শোষণ-বঞ্চনার বিপরীতে সমাজতন্ত্র। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র। এবং ধমের্র নামে রাষ্ট্র গঠনের, জাতি গঠনের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আর এগুলোই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ এই পথেই অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা এই রাষ্ট্রের অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে, বাঙালিকে নেতৃত্বহীন করতে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক ও রাষ্ট্র প্রধানকে সপরিবারে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড ছিল না। এই হত্যাকাণ্ড ছিল একটি আদশের্র, একটি স্বপ্নের।
বঙ্গবন্ধু দেশভাগের নির্মম ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি সামপ্রদায়িক দাঙ্গার নিষ্ঠুরতাও প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি অভাব-অনটন-দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি সমাজের বৈষম্য বঞ্চনা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ফলে তিনি তাঁর রাষ্ট্র থেকে এ সবকিছুকেই দূর করতে চেয়েছেন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরে যারা ক্ষমতায় এসেছিল এবং ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যারা দেশ শাসন করেছিল তারা বঙ্গবন্ধু নির্মিত পথে এগুতে দেয়নি রাষ্ট্রকে। জিয়াউর রহমান এ দেশে নতুন করে সামপ্রদায়িক রাজনীতির প্রচলন করেছিলেন। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ধর্মান্ধতা, সামপ্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন করা হয়েছিল। এক সময় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সংবিধানের চার মূলনীতিকে খারিজ করে দিয়েছিলেন।
তিনি সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ যোগ করে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ন করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরী জেনারেল এরশাদ অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম সন্নিবেশিত করে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছিলেন।
দীর্ঘ বছর দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে সামপ্রদায়িকতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করায় বর্তমান সমাজ হয়ে পড়েছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ ও অমানবিক। আওয়ামী লীগের মতো একটি অসামপ্রদায়িক দল ক্ষমতায় আছে বটে কিন্তু সমাজ হয়ে পড়েছে জামায়াতিদের দখলে। সমাজে যে কোনো অর্থে ধর্মীয় প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বটে কিন্তু সে অর্থে মানুষের সততা, মানবতা, ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়নি। উল্টো সমাজে বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্নীতি, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, চুরি-ডাকাতি, খুনোখুনি, মারামারি, অস্থিরতা, অবিশ্বাস আর অশ্লীলতা।
অর্থাৎ যে আদর্শ ও চেতনা নিয়ে দেশটি স্বাধীন হলো, এত প্রাণ উৎসর্গিত হলো, এত নারী সম্‌ভ্রম হারালো, এত সম্পদহানি হলো বাস্তবে সে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা গেল না। জাতির পিতার স্বপ্নের একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক, অসামপ্রদায়িক, বৈষম্য ও শোষণহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে আমরা অনেক দূর সরে এলাম।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅগ্রগতির বাংলাদেশ হোক অসামপ্রদায়িক চেতনার মূলভিত্তি
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম