কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৩ জুন, ২০২১ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

সিডিএ কি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
একসময় রাষ্ট্র ছিল নগরকেন্দ্রিক। নগরে বসবাসকারীকেই শুধু নাগরিক বলা হতো। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রে বসবাসকারী সবাইকে নাগরিক বলা হয়ে থাকে। নগরের বাসিন্দা না হলেও সবাই নাগরিক।
সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্রের সংজ্ঞা বদলেছে, কাঠামো বদলেছে। এই বদলের সঙ্গে সঙ্গে নগর ও গ্রামের তফাৎটাও নির্দিষ্ট হয়েছে। দেশে দেশে নতুন নতুন নগর তৈরি হয়েছে বা নগরায়নের ঢেউ লেগেছে। এতে একদিকে কিছু মানুষের বিশেষ করে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের কর্মসম্পাদন ও আবাসনের সুবিধা হয়েছে। বিপণন ও রাষ্ট্র তথা সরকারি কাজের সঙ্গে জড়িতরা নগরকেন্দ্রিক হয়েছে। একটি সময়ে নগরায়ন ও শিল্প প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদোগের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।এভাবে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক এলাকা ও আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার রেওয়াজ শুরু হয়। বিশ্বের সব নগরই গড়ে তোলা হয়েছে এমন পরিকল্পনার ভিত্তিতে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান এবং তারপর বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সময়ে বড় নগরগুলোতে জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে তুলেছে শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা।
পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিল্প-কারখানার প্রসার এবং সে সঙ্গে আবাসনচাহিদা মেটাতে ঢাকা, চট্টগ্রামে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা ও অভিজাত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার জন্য বড় বড় নগরে বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠন করে সরকার। যেমন- রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউক) ইত্যাদি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের যাত্রা শুরু হয় গত শতকের ছয় দশকের মাঝামাঝি। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠার অর্ধ শতক পেরিয়েও প্রতিষ্ঠানটি পরিকল্পিত ও আধুনিক চট্টগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো সাফল্য দেখাতে পারেনি। পরিবেশবান্ধব নগর গড়ে তোলার দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানের হাতে সে চউক বা সিডিএ’র বিরুদ্ধেই আছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাহাড় কাটার অভিযোগ।
পাকিস্তান আমল থেকেই আবাসন প্রকল্প হাতে নেয় সিডিএ। কিন্তু দুয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো পরিকল্পিত অবস্থায় থাকেনি শেষ পর্যন্ত। সিডিএ নিজেই নিজের শর্ত ভঙ্গ করে আবাসিক এলাকাগুলোর উপযোগিতা নষ্ট করেছে।
এ পর্যন্ত প্রায় এক ডজন আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরমধ্যে প্লটের দাম বুঝে নিয়েও এখনো আবাসিক এলাকার প্রয়োজনীয় চাহিদা সম্পন্ন করেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এবার বড় আকারের আবাসন প্রকল্প বাদ দিয়ে ছোট প্রকল্পে হাত দিচ্ছে সংস্থাটি। পত্রিকান্তরে জানা গেল,নগরীর বায়েজিদ এলাকায় ২০ একর জায়গার উপর নতুন আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সিডিএ। ইতিমধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে তারা। অনুমোদন মিললে আগামী বছর প্রকল্পটির কাজে হাত দেবে। এটি হবে সিডিএর নেয়া আবাসন প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে দামি ও অভিজাত ।
অনন্যার পর সিডিএ’র নতুন আবাসন প্রকল্প নিয়ে প্রচুর আগ্রহ ছিল। সে আগ্রহের কারণে অনন্যা দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুর কথা বলা হয়। কিন্তু এক যুগেও অনন্যা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের কোনও অগ্রগতি হয়নি। অনন্যা আবাসিক এলাকা ১-এর যথাযথ উন্নয়ন না করে, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস পয়ঃনিষ্কাশন, সড়ক যোগাযোগ, নিরাপত্তা কোনোকিছুরই ঠিক না করে, এলাকাটিকে ভুতুরে পরিবেশে নিক্ষেপ করে এরমধ্যে বায়েজিদ এলাকায় ‘বায়েজিদ বোস্তামী আবাসিক এলাকা’ নামে নতুন একটি আবাসন প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করেছে সিডিএ। অন্যান্য আবাসন প্রকল্পের ন্যায় বড় না করে ছোট আকারের প্রকল্প নেয়া হয়েছে এবার। ২০ একর জায়গার ওপর করা হবে নতুন এ আবাসন প্রকল্প। অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে এ প্রকল্পে প্লটের দাম বেশি হবে। প্রতি কাঠার দাম হবে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস গণমাধ্যমকে বলেন, বায়েজিদে আমরা ২০ একরের একটি আবাসিক প্রকল্প করার জন্য ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। দীর্ঘদিন পর আয়বর্ধক এ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। দ্রুত প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনুমোদন পাওয়ার পর জায়গা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করবো। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরে অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে পারবো। একই সময়ে বরাদ্দের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে।
তিনি বলেন, আবাসিক প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের আবাসন সমস্যার যেমন সমাধান হয় তেমনি এটি সিডিএর একটি আয়বর্ধক প্রকল্পও। তাছাড়া আবাসিক প্রকল্পের মাধ্যমে পরিকল্পিত নগরায়ণের পথ সুগম হয়। সিডিএ’র আবাসিক প্রকল্পের প্লটের প্রচুর চাহিদা আছে। অনন্যার তুলনায় বায়েজিদ প্রকল্পের প্লটের দাম বেশি হবে। নতুন এ প্রকল্পে ৩, ৪, ৫ কাঠার প্লট থাকবে। প্লটের অবস্থান ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করা হবে। কাঠাপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা হতে পারে। ভূমি অধিগ্রহণসহ যাবতীয় ব্যয় বেড়ে যাওয়াতে অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে এ প্রকল্পে ব্যয় বেশি হবে।
কোনো রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির মতো এই সিডিএ কর্মকর্তা বলেন, নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডের পাশে নতুন প্রকল্পের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০ একর আয়তনের মধ্যে ১৬৭টি আবাসিক ও ১৮টি বাণিজ্যিক প্লট থাকবে। লোকেশনের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হবে প্লটের দাম। প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ৩৫৭ কোটি ৮২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। পাহাড় না কেটেই করা হবে আবাসন প্রকল্পটি। যার মধ্যে একটি কৃত্রিম হৃদ এবং সবুজের সমারোহ থাকবে। প্রকল্পে তিন কাঠার ১২৬টি, চার কাঠার ৭টি এবং পাঁচ কাঠার ৩৪টি আবাসিক প্লট, ১৮টি বাণিজ্যিক প্লট এবং ৩৬ দশমিক ৫ কাঠার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক থাকবে। তাছাড়াও দুটি ইউটিলিটি ব্লক রাখা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় সিডিএ’র নিজস্ব জায়গা রয়েছে। তাছাড়া খাস জায়গা ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে জায়গা হুকুমদখল দ্রুত সম্পন্ন করার যাবতীয় প্রস্তুতিও আছে সিডিএ’র। চলতি বছর প্রকল্প অনুমোদন পেলে ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চৌকস কর্মকর্তার মতোই কথাবার্তা তার। এ ধরনের কথাবার্তা প্রতিবার প্লট তৈরির আগে বলা হয়ে থাকে। মানুষ তাতে আকৃষ্ট হয় তবে খুব কম মানুষই সিডিএ থেকে প্লট কিনে জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পেরেছেন।
আমার এক আত্মীয় ১৯৯৫ সালে সিডিএ’র ‘কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা’য় প্লট বরাদ্দ পান। সে সময় তিনি জমির দাম বাবদ পরিশোধ করেন মোট ৩ লাখ বিশ হাজার টাকা। কর্ণফুলী নদীর ওপারে গড়ে তোলা সিডিএ’র এই আবাসন প্রকল্পটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় গোচারণ ভূমিতে পরিনত হয়েছে। আমার আত্মীয় সে টাকা ব্যাংকে রাখলে এতদিনে তা অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত। আর জমি কিনলে তার দাম কয়েককোটি টাকায় দাঁড়াতো।
দীর্ঘ ২৮ বছরেও সিডিএ সে আবাসিক এলাকা নিয়ে যৌক্তিক কোনো সমাধানে আসতে পারেনি। সে আবাসিক এলাকায় জমি কেনার সময় যাদের বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে ছিল তাদের কতজনের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে এখনও?
নদীর ওপারে আবাসিক এলাকার প্লট বিক্রি শেষ হওয়ার পর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এখানে বহুতল ভবন নির্মাণে আপত্তি জানায়। বলা হয় শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে এই আবাসিক এলাকার বহুতল ভবন ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে। এখানে দোতলার ওপর ভবন নির্মাণ করা যাবে না। এরপর আবাসিক এলাকাটি একপ্রকার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
সিডিএ পরিকল্পনা করলে এই আবাসিক এলাকাটিকে একটি বিশেষ আবাসিক এলাকায় পরিণত করতে পারত। প্রতিটি বাড়ি নির্দিষ্ট ডিজাইন, রং ও আয়তনে ডুপ্লেঙ ভবনে গড়ে তোলা যেত। অথবা প্লট গ্রহীতাদের টাকা সুদসহ ফেরত দিয়ে এখানে পার্ক, স্টেডিয়ামের মতো বিনোদনকেন্দ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারত। সিডিএ তো কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, তাহলে কেন বারবার আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিতে হবে?
২০০৭ সালে অঙিজেন কুয়াইশ সংযোগ সড়কের পাশে অনন্যা আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করে এক হাজারেরও বেশি প্লট বরাদ্দ দেয় সিডিএ। দেড় দশক হয়ে গেলেও সেখানে বাড়ি করতে আগ্রহী হচ্ছে না অনেকেই। কারণ সে আবাসিক এলাকায় যাওয়া আসার একটিমাত্র সড়ক তা-ও এত ভাঙাচোরা যে পারতপক্ষে কোনো যানবাহন সে পথে যেতে চায় না।
এখনও দেখলে মনে হয় খালি জমি পড়ে আছে।
এরপর বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি আবাসিক প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে আলোচনা হলেও কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৬ সালে অনন্যা-২ আবাসিক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি একনেক সভায় ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে। নগরীর পাঁচলাইশ, কুয়াইশ ও বাথুয়া মৌজার ৪১৮ দশমিক ৭৩ একর জমির ওপর এ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ভূমিমূল্য বিবেচনায় হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া ও শিকারপুর মৌজায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নানা জটিলতায় প্রকল্পটি হিমাগারে চলে যায়।
আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা ছাড়াও সিডিএ আরও অনেক কাজ করতে পারত কিন্তু করেনি। ৭২ সালে যে নগরীর লোকসংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক লাখ সেখানে আজ নগরীর লোকসংখ্যা অন্তত ৭০ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক নাগরিকের জন্য পার্ক, খোলা ময়দান, লেক এমনকি কবরস্থানেরও পরিকল্পনা করেনি সিডিএ।
শুরুতে বলেছিলাম, বিশ্বের প্রতিটি আধুনিক নগরী গড়ে তোলা হয়েছে সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক। আবাসিক এলাকার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেই তারা প্লট বিক্রি করে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেখানে বাড়ি করার বাধ্যবাধকতা করে দেয় আর আমাদের দেশে জমি অধিগ্রহণ করেই প্লট বিক্রি করে টাকা কামিয়ে নেওয়া হয়। এতে জমি অধিগ্রহণের ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুহারা হয়, অন্যদিকে টাকা দিয়ে জমি কিনে অনেকে জীবদ্দশায় বাড়ি করার স্বপ্ন পূরণ করতে না পেরেই পরলোকে পাড়ি জমান। এই অমানবিক কর্মকাণ্ডের অবসান হওয়া দরকার।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশু যখন সহিংসতার শিকার
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম