কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২২ এপ্রিল, ২০২১ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

মহামারিকালে প্রকৃত মানুষ বনাম রূপান্তরিত মানুষ
মনটা ভীষণ খারাপ ও অস্থির। মন স্থির না থাকলে কোনো কাজ গুছিয়ে করা যায় না। প্রতিদিন মৃত্যুসংবাদ শুনতে শুনতে মনটা ভেঙে যাচ্ছে। বন্ধু-স্বজনের মৃত্যুর পাশাপাশি দেশের বরেণ্য সন্তানদের মৃত্যু দেখতে দেখতে ভাবি দেশ কি তবে মেধাশূন্য হয়ে পড়বে? ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানিরা এদেশে গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি দেশের বরেণ্য, কৃতী সন্তানদেরও হত্যা করেছিল। একাত্তরের পর এটা আরেকটি বিপর্যয় বলে বিবেচিত হবে এদেশের ইতিহাসে। এমন পরিস্থিতিতে সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা দায়।
ধরে নিয়েছিলাম, মহামারীকালে মানুষের বোধের কিছু পরিবর্তন হবে। মানুষ মানুষের প্রতি আরও বেশি সহানুভূতিশীল হবে। মানুষে মানুষে মেলবন্ধন সুদৃঢ় হবে। মানুষ অনুধাবন করতে পারবে জীবন কত ঠুনকো। ধন-দৌলত, ক্ষমতা-প্রভাব কিছুই মানুষকে রক্ষা করতে পারে না। নভেল করোনা নামক এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে মানুষ কত অসহায়। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশের বড় বড় ক্ষমতাধররা পর্যন্ত কী অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করছে ভাইরাসের কাছে। পৃথিবী নামক গ্রহটিকে অনেকবার ধ্বংস করার মতো পারমানবিক অস্ত্রসম্ভারের মালিক ক্ষমতাশালীদের অবস্থা আজ তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো ফকির-মিসকিনের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভেবেছিলাম, যে ভাইরাস ধনী-গরিব দেখছে না, সাদা-কালো দেখছে না, নারী-পুরুষ দেখছে না, আস্তিক-নাস্তিক দেখছে না, মুসলিম-অমুসলিম দেখছে না সে করোনাভাইরাস নামক অভিন্ন শত্রুকে মোকাবেলায় বিশ্বের সব মানুষ এক কাতারে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে তার উল্টোটি।
বরং করোনাকালে বিশ্বে হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কলহ-বিবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ অব্যাহত আছে। দেশে লকডাউন চলায় গরিব দেশের গরিব মানুষগুলো অভাবে পতিত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ নিরন্ন ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। অন্যদিকে এই মহাদুর্যোগকালেও কিছু মানুষ বিপুল অর্থ-সম্পত্তির মালিক হয়েছে। সমপ্রতি প্রকাশিত ফোর্বসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির মধ্যেই বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় ২০২১ সালে বিশ্বে বিলিয়নিয়ার বেড়েছে ৬৬০ জন। এক বছরে এতজন এই শত কোটি ডলারের ক্লাবে এর আগে কখনো ঢুকতে পারেননি। এবার তালিকায় নতুন করে যুক্ত হওয়াদের মধ্যে ৪৯৩ জনই প্রথমবারের মতো বিলিয়নিয়ার হয়েছেন। অর্থাৎ বিশ্বে প্রতি ১৭ ঘণ্টায় একজন ব্যক্তি বিলিয়নিয়ার হয়েছেন।
বিশ্বে মহামারিতে ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে তিন মিলিয়নের বেশি মানুষ। মহামারির দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অবস্থা টালমাটাল। মহামারির টিকা আবিষ্কার হলেও অনেক দেশ এখনো টিকা পায়নি। ভবিষ্যতে এইসব দেশের মানুষ টিকা পাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ টিকা কেনার সামর্থও সেসব দেশের নেই। এরইমধ্যে টিকা নিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্বরাজনীতি। এই চক্করে পড়ে কোটি কোটি মানুষ টিকা নিতে না পেরে অরক্ষিত থেকে যাবে।
এই লেখা যেদিন লিখছি সেদিন বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১১২ জন। দেশে করোনায় মৃত্যুসংখ্যা দশ হাজার অতিক্রম করেছে। গত একবছরে আমরা হারিয়েছি দেশের অনেক বরেণ্য সন্তানকে। এই পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে দেশে মেধাবী মানুষের অভাব হবে, জাতি মেধাশূন্যতায় পতিত হবে। কিন্তু এমন ঘটনা দেশের একশ্রেণির মানুষকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি, ব্যথিতও করেনি। বরং অনেক বরেণ্য সন্তানের প্রয়াণের পর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের প্রতিক্রিয়া দেখে হতবাক হয়েছি মানুষ এত নির্মম, অসভ্য, অভব্য কী করে হতে পারে তা ভেবে।
অন্য ধর্মাবলম্বী এবং মুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসামপ্রদায়িকতা, মানবতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদির পক্ষে বলেছেন বা মত দিয়েছেন তাদের মৃত্যুসংবাদে এদেশের একশ্রেণির মুসলমান প্রকাশ্যে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলেছেন। অনেকে ফেসবুকে তাদের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে মন্তব্যও করেছেন। অনেকে কারো কারো জানাজা না পড়ানোর জন্যেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
ধর্মীয় উসকানি ও অপব্যাখার বিরুদ্ধে সোচ্চার বেসরকারি টেলিভিশনগুলোও এদের আক্রমণের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে এরা প্রতিনিয়ত প্রপাগান্ডা চালায় এবং বয়কটেরও ডাক দেয়। এই টিভি চ্যানেলগুলোর সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টারও এদের আক্রমণের শিকার। কয়েকদিন আগে একাত্তর টিভির এক নারী প্রযোজক সন্তান প্রসবকালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের ধর্মান্ধগোষ্ঠীর কুৎসিত, নোংরা ও হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখে আমি মর্মাহত। বিষয়টি দেশের যেকোনো সুস্থ মানুষকে আহত না করে পারে না। একজন মৃত মানুষকে নিয়ে এমন কুৎসিত মন্তব্য করা কীভাবে সম্ভব তা ভেবে পাই না। আমার ভাবতে কষ্ট হয় এমন মানুষও আমাদের সমাজে আছে, আমাদের চারপাশেই আছে।
একাত্তর টিভির প্রযোজক মুসলিম ছিলেন তাই তাকে আক্রমণকারী সবাই ছিলেন মুসলিম। কিন্তু কবরীর মৃত্যুর পর প্রতিক্রিয়াশীলরা ছিল দু’সমপ্রদায়েরই। দেশবরেণ্য শিল্পী ও রাজনীতিক কবরীর মৃত্যুর পর একদল বলেছে, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আরেকদল ঘৃণা প্রকাশ করেছে তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন বলে।
কয়েকদিন আগে আমাদের অগ্রজতুল্য এক বন্ধু কভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশের খ্যাতিমান কবি ও শিল্পী প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। আজ থেকে অন্তত সাড়ে তিন দশক আগে দেশের প্রচলিত আইনে তাঁকে বিয়ে করতে হয়েছিল। ফলে তাঁর স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল। এই উপমহাদেশে সাধারণত যা হয় হিন্দু-মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে যিনি হিন্দু তাঁকেই ধর্মান্তরিত হতে হয়। অন্য ধর্ম ত্যাগ করে সনাতন ধর্ম গ্রহণের কোনো সুযোগ সনাতন ধর্মমতে নেই। অবশ্য বর্তমানে ধর্ম ত্যাগ না করে বিয়ে করার আইনি সুযোগ আছে।
আমাদের সে বন্ধুটি ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসামপ্রদায়িক, উদার ও মানবতাবাদী মানুষ। ধর্ম নিয়ে তিনি কখনো মানুষকে বিচার করেননি। জীবনে কাউকে আঘাত করে কথা বলেননি। দেশে বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্যচর্চা করেছেন অথচ তাঁর সহযোগিতা পাননি এমন ঘটনা বিরল। বড়ই দুঃখজনক যে আমাদের সে বন্ধু এবং সদ্য বিধবা হওয়া তাঁর স্ত্রীও এমন হেটারদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাননি। প্রায় চল্লিশ বছর আগে ধর্ম ত্যাগ করার অপরাধের(!) শাস্তি তাকে দেওয়া হচ্ছে। আর এমন ন্যাক্কারজনক কাজটি করছেন মুখে মানবতার জন্য ফেনাতোলা কতিপয় ‘বিশিষ্টজন’। তাঁদের সে বক্তব্য এতই স্থুল ও অশোভন যে তার উদ্ধৃতি দিতেও আমার সংকোচবোধ হচ্ছে। এদের কাছে ধর্মীয় পরিচয়টিই প্রধান। প্রেম, ভালোবাসা, দয়া-মায়া, মানবতাবোধ কোনোকিছুরই মূল্য নেই এদের কাছে। অন্যের দুর্বল স্থানে আঘাত করে, অন্যের মুখ ম্লান করে দিয়ে এরা একধরনের অনাবিল আনন্দ লাভ করেন।
সম্ভবত সমাজ এখন এধরনের বিকৃত, হিংস্র, নিষ্ঠুর মানুষে পরিপূর্ণ। এরা সমাজে অনবরত ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে এক বিকৃত আনন্দলাভ করছে। এই কাজটি এখন শুধু ইসলামী মৌলবাদীরা করছেন তা নয়। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের কিছু লোকজনও। সামপ্রদায়িক আচরণের বিরুদ্ধে সামপ্রদায়িক আচরণ করা কিংবা মন্দকে মোকাবেলায় মন্দ হওয়া নীতিতে আমি বিশ্বাসী নই। কাজেই একটি মৌলবাদী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে আরেকটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর সহযোগিতা নেওয়ারও বিপক্ষে আমি।
লেখাটি শেষ করব একটি চীনা উপকথা দিয়ে। ঈশ্বর মানুষ বানিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে সহকারীদের বললেন, আমি বিশ্রামে যাচ্ছি, তোমরা জন্তুজানোয়ার বানিয়ে রাখবে। একসময় বিশ্রাম শেষে ঈশ্বর এসে দেখলেন তার সহকারীরা হিসাবের বাইরে প্রচুর জন্তুজানোয়ার বানিয়ে ফেলেছে। ঈশ্বর বললেন, আমি পৃথিবীতে সবকিছুরই একটি ভারসাম্য রাখতে চাই। তোমাদের বানানো এতবেশি পশু যদি পৃথিবীতে পাঠাই তাহলে সেখানে ভারসাম্য নষ্ট হবে।
সহকারীরা দেখলো একটা ভুল হয়ে গেছে। এত বিপুলসংখ্যক পশুকে পৃথিবীতে পাঠানোর আগে বধ করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা নিয়ে কেটে গেল কয়েকদিন। অবশেষে তারা একটি উপায় খুঁজে পেয়ে ঈশ্বরের কাছে গেল এবং বলল, ঈশ্বর আমরা একটা উপায় বের করেছি। যেহেতু বাড়তি পশুগুলো এখানে বধ করতে পারছি না তাই ওদের পৃথিবীতেই পাঠাব তবে পশুর চেহারায় নয়। ওদের চেহারাটা শুধু মানুষের মতো করে দেব। ফলে মানুষ দু’প্রকার, একদল মৌলিক মানুষ অর্থাৎ যাদের মানুষ হিসেবেই বানানো হয়েছিল। আরেকদল চেহারাটা মানুষের কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা পশু।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিয় প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম