কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের প্রেরণা

ড. আনোয়ারা আলম | মঙ্গলবার , ২৪ মে, ২০২২ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ


“নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয় এটা কথা সত্য। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী তা স্পষ্টই বোঝা যায়। আমরা কখন যুদ্ধে যাবো-তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো তখন সেখানে যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখনও তার গান গাইবো। …কবি নজরুল স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা শুধু তার নিজের স্বপ্ন নয়, সমস্ত বাঙালি জাতির স্বপ্ন।”
—-সুভাষচন্দ্র বসু

উনবিংশ শতাব্দীর সীমান্তে যে কবির জন্ম, একুশ শতকে এসে সে কবির জন্মবার্ষিকীতে নতুন আবেগ, ভালোবাসা দিয়ে এটিই উচ্চারিত হচ্ছে-তিনি আমাদের কবি, কালোত্তীর্ণ এক চির যৌবনের কবি।

নজরুল বাংলাভাষার এক সার্বভৌম কবি, মানুষের কবি, পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণকারী এক বিদ্রোহী কবি, হিন্দু মুসলমানের মিলনের কবি, বাংলা ও বাঙালির সম্মিলিত সংস্কৃতির এক ঐকতানের কবি। তিনি বাঙালি মানসের এমন এক প্রতীক, এমন এক প্রতিচ্ছবি, যাঁর কাব্য ও জীবনে এই মিলনের কল্পধারা বাস্তবরূপ পেয়েছে অত্যন্ত চমৎকার ভাবে। বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির অপূর্ব সম্মিলন যেমন ঘটেছিল তার সমগ্র সাহিত্যে তেমনি বাঙালি হিন্দু মুসলমানের ধর্মের গৌরবগাথাও তাঁর কাব্যে সমানভাবে স্থান পেয়েছিল। তাঁর কাব্যে সাম্যবাদ, নিপীড়ত মানুষের জন্য বেদনাবোধ, অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতি যে প্রবল আঘাত ও বিদ্রোহ-সবই তাঁকে মানুষের অতি কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রশাসিত বলয়ে এ কবির আবির্ভাব কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো। হাতে ছিল বিদ্রোহের নিশান, গলায় ছিল টালমাটাল করা যৌবনের গান এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে তিনি এলেন যখন পুরো বিশ্বে অবলুন্ঠিত সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ।

কবি নজরুল এমন এক ক্রান্তিকালে জুলিয়স সিজারের কথিত প্রবাদবাক্যের মতো-‘আমি এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম।’ এ এভাবেই তার প্রবল উপস্থিতি-এ সেই ডাক দিলেন ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়। তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ রাখালিয়া গানের বাঁশের বাঁশী নয়-অগ্নিবীণা আর বিষের বাঁশি’ হাতে নিয়ে তার সদর্প চরণে প্রবেশ। বিদ্রোহের আকাশস্পর্শী অহংবোধ, বিপ্লবের এক চেতনা ছন্দ ও সুর ঝংকারের এমন এক স্পন্দন প্রবল আবেগে জেগে ওঠে পাঠক সমাজ।

প্রথম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) এবং রুশ বিপ্লব (১৯১৭) এর পরে পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতা, সাম্য ও গণতন্ত্রের দাবি-শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল শ্রমিক, কৃষক ও সর্বহারা মানুষেরা এমন এক উত্থান পরিবেশে বিদ্রোহী কবি নজরুলের কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে পূর্ণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, সাম্যের চেতনা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবেদন। তাঁর স্বাধীনতার চেতনা, জাতীয়তাবোধ, মানবতার অহংকারে-উচ্চকন্ঠ প্রতিবাদী প্রকাশ পেল কবিতায় ও গানের ছন্দে যার আঘাতে শংকিত বিদেশী শাসক গোষ্ঠী বাজেয়াপ্ত হলো তাঁর বই ও কবিতা-বন্দিত্ব বরণ করে নিতে হলো।

নজরুলের পূর্বসূরিরা বললেন জাগো দেশ, জাগো জাতি, নজরুল বললেন-জাগো নিপীড়িত, জাগো কৃষক, জাগো শ্রমিক, জাগো নারী। স্তালিন যেমন বলেছিলেন-
“নারীদের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে মানব জাতির ইতিহাসে নিপীড়িত জনগণের কোনরূপ আন্দোলনই সফল হতে দেখা যায়নি-এ কথারই প্রতিধ্বনি নজরুলের কবিতায়-“সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে নারী পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই।”
এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট এবং এখানেই তিনি যুগান্তর।

এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক চেতনার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা যে সাম্প্রদায়িকতা নজরুল তা অতিক্রম করেছেন- এ পৃথিবীকে তিনি বলেছেন সব মানুষের তথা সাম্যবাদী স্থান।” সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। চন্ডীদাসের এই সত্যোপলব্ধিকে অনুভব করে একই সাথে নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা বাল্যকালে বিপ্লবীদলের যোগাযোগে আসার এবং সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতায় ভেতরে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে সাম্যবাদী চেতনা-মানুষ কবিতায় তাই লিখলেন-
“গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান।”

শুধু কবিতায় গানে নয় প্রত্যক্ষভাবে তিনি সাম্যবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর পরিচালিত ‘লাঙল’ এদেশের প্রথম সাম্যবাদী পত্রিকা কৃষক মজুরের মুখপত্র। বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত হওয়াই বড়ো কথা জাতীয় রাজনীতির শেষ কথা নয়- এটি অনুধাবনে ধুমকেতু পত্রিকায় ঘোষণা করেছিলেন-“বলো কারুর অধীনতা মানিনা-স্বদেশীর না বিদেশীর না।”

বিদ্রোহী কবিতাটি তৎকালীন বিপ্লববাদীদের ইস্তেহারে পরিণত হয়েছিল। সে সময়ের তরুণ প্রজন্মের সংগ্রামী চেতনাকে জাগ্রত করার। এমনকি মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করতে সাহস জুগিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম দেশাত্মবোধক গানের সংগে যুক্ত করলেন বিপ্লবী সংগীত “কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট, শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল, আমরা শক্তি/ আমরা বল-ইত্যাদি অনেক রণসংগীত আর গানের সুরগুলো আয়ত্ত করেছিলেন সৈনিক বৃত্তিতে থাকাকালীন-হয়ে গেল একেবারেই নতুন এবং বিপ্লবী সংগীত।

সৈনিক জীবন তার বিশ্বচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছিল একই সাথে সাংস্কৃতিক চেতনাকেও। যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সান্নিধ্যে এসে মার্কসবাদী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। অবিভক্ত বাংলায় বিপ্লববাদ প্রসারে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি চেয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা। ১৯২৬ সালে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদে কৃষ্ণ নগরে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীতে লিখেছিলেন-‘কান্ডারী হুঁশিয়ার।’
তথাগত হিসেবে নজরুলের জন্ম উনবিংশ শতাব্দীতে। কিন্তু তাঁর ঋদ্ধি বৃদ্ধি বিকাশ বিংশ শতাব্দীতে। ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে যখন নজরুলকে জাতীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়-তিনি বলেন-“বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরি অভিযান-সেনাদলের তূর্য বাদকের একজন আমি-এই হোক আমার সবচেয়ে বড়ো পরিচয়।”

সংবর্ধনার সভার সভাপতি আচার্য প্রফুল্লকুমার রায় ফরাসি বিপ্লবের কথা তুলে বলেছিলেন, এই বিপ্লবের দার্শনিক ভিত্তি রচয়িতাদের রচনা পড়ে ফ্রান্সের একেকজন মানুষ তখন অতি মানুষে পরিণত হয়েছিল এবং তাঁর আশা নজরুলের কবিতা পড়ে এদেশের মানুষও অতিমানবে পরিণত হবে। এর চাইতে বড়ো শ্রদ্ধা নিবেদন আর কিছুই হতে পারে না।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ভাবতে হয়-যে স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের কথা কাজী নজরুল ইসলামের পাঠ থেকে জেনেছি-তা কতোটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে। ভোগবাদিতার মোহে আমরা এখন পরিণত হচ্ছি রোবটে। যন্ত্র সভ্যতার কারণে আক্রান্ত বিচ্ছিন্নতায় অসহিষ্ণুতায় মানব সমাজ ক্ষত বিক্ষত-বিশ্বের প্রেক্ষিত তথাকথিত বৃহৎ রাষ্ট্রের আধিপত্যবোধে আক্রান্ত অনুন্নত অনেক দেশ যুদ্ধের ডামাডোল এখনো থামেনি আজও বৃহদাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে। দেশ বা সমাজের নিয়ন্ত্রণ কিছু লোভী মুনাফা খোর দুর্নীতিবাজদের কবলে। শোষিত বঞ্চিত মানুষের হাহাকার এখনো আকাশ বাতাসে-যতোদিন মানুষের অসম্মান ঘটবে মানুষের হাতে ততোদিন নজরুলের বাণী প্রতিরোধ ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র : উন্নত মমশির-মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। বিশ্ব সাহিত্যে নজরুল-সানাউল্ল্যাহ নূরী, শতাব্দীর পদক্ষেপ্ল-আতাউর রহমান, বিপ্লববাদ থেকে সাম্যবাদ-কল্প তরুণ সেনগুপ্ত, সার্বভৌম কবি-শফিউল আলম, কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশত
বার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ-আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামের মৌলিক শিক্ষার আলোকে মাইক ব্যবহারে সংযম-সতর্কতা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাথমিক শিক্ষকদের টাইম স্কেল নিয়ে আনা আপিল খারিজ