কর্ণফুলীর দূষণ রোধে পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে

| মঙ্গলবার , ১১ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীর দূষণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গত ৯ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে। ‘কর্ণফুলী নিয়ে ভয়াবহ তথ্য’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন শিমুল, হলুদ কৃষ্ণচূড়া, ফুলিবেত, কালমেঘ, কাঁটা বিশাল্লা, গঙ্গাতারা, উপকালিস, ছোট ছাতিম, ইছারমূল, অনন্ত মূল ও বেগুনি আমড়াসহ দেশের ৮১টি বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে। তবে শঙ্কার কথা, কর্ণফুলীর ভয়াবহ দূষণের প্রভাবে হারিয়ে যেতে পারে এসব উদ্ভিদ। একই দূষণের কারণে কর্ণফুলীর দুই তীরের অশোক, কুরুজ, শ্যমলতা, চীনালতা, খনা, বরুণ, ফুল ঝুমরি, কালিলতা, গোল তকমা ও ডুলি জবাসহ আরো ৬৩ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হতে পারে। অর্থাৎ কর্ণফুলীর দূষণ রোধ না হলে এ ১৪৪ প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে যাবে। কর্ণফুলী নদীর প্রাণ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও দূষণের কারণ নির্ণয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। এতে কর্ণফুলীর বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত দূষণের জন্য দায়ী ৮৯টি উৎস ও ৩০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত দূষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে সাতটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নদীতে নির্গত বর্জ্যে মানবদেহ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। তাই দূষণ বন্ধ না হলে উদ্ভিদের পাশাপাশি ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্তির শঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে দৈনন্দিন কাজে কর্ণফুলীর ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর ওপর চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের ধারক ও প্রাণভোমরা হিসেবে খ্যাত। এ নদী প্রকৃতির অপার দান। দেশের অর্থনীতিতে এই নদীর অবদান অপরিসীম। উদার হস্তে এই নদী দিয়ে যাচ্ছে দেশ ও জাতিকে। কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায় এই নদী এখন ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। নদীটির প্রাণস্পন্দন এখন অনেকটা ম্রিয়মাণ। ক্রমাগত দখল, দূষণ আর ভরাটের কারণে কর্ণফুলী আজ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে গড়ে উঠেছে ২ হাজারেরও বেশি অবৈধ স্থাপনা। নদীর আশপাশের শিল্পকারখানার বর্জ্য, সিটি করপোরেশনের পয়েঃবর্জ্য ও গৃহস্থালি বর্জ্যের একাংশের ময়লা-আবর্জনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকা ১৭টির বেশি খাল-ছড়া দিয়ে জাহাজের তেলবর্জ্যও সরাসরি নদীতে এসে পড়ছে। বিষিয়ে উঠেছে নদীর পানি। ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্যের দূষণে খাল-ছড়াগুলোও বলতে গেলে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নদীর আশপাশের বেশিরভাগ শিল্পকারখানায় ‘তরল বর্জ্য শোধনাগার’ বা ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন করা হয়নি। ফলে এসব কারখানার দূষিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে এসে পড়ছে। দিনের পর দিন দূষণ বাড়তে থাকায় নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে কমে গেছে। অব্যাহত দূষণের কারণে কর্ণফুলী নদীতে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। দূষণের কারণে নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থা বিনষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রা। দূষণ বাড়তে থাকায় নদী ও নদীর আশপাশের সার্বিক জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আবার দখল ও দূষণে জমছে পলি, ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। নদীতে চর পড়ে নদীর গভীরতা যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি নদীর প্রশস্ততাও কমে নদীটি ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। কর্ণফুলী নদী ও এর আশপাশের খালগুলোর নাব্যতা সংকট দূর করতে না পারলে বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম নগরীতে আবার ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।
আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দূষণ রোধে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ প্রকাশিত হয়েছে। এতে নদীর তীরে অপরিকল্পিত বসবাস ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা, নালার দূষিত পানি শোধন করে নদীতে নির্গত করার ব্যবস্থা করা, নদী ভাঙন রোধে উদ্ভিদ লাগানো এবং পলিথিন ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দূষণ রোধে কঠোর ও পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া নদী দখল বন্ধ করার পাশাপাশি সকল কলকারখানায় সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পলিথিন ও অন্যান্য সামগ্রী নদীতে না ফেলতে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত বর্জ্যে যাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান না থাকে এবং নৌযান নোঙর যত কম করা যায় তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে