আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | বুধবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

গ্রামে কল্যাণমূলক সংগঠন থাকলে বাংলাদেশের আরও উন্নতি ঘটবে

প্রায় নয় মাস পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে খুব আনন্দ লাগছে। বিদেশ থেকে এসে ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে বাংলাদেশের আকাশ, রোদ, পরিবেশ যেমন মনে স্বদেশ প্রেমের আবেগে ছলছল করে ওঠে, তেমনি চট্টগ্রামে এসেও চট্টগ্রামের আলো বাতাস শ্যামল পরিবেশ আমার শোকার্ত অন্তরকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করে তুলেছে। এ ক’মাস ফোনে সবাই আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন। সত্যি এদেশের মানুষের তুলনা নেই। সবার অন্তরে এতো ভালবাসা, মায়া মমতা। আত্নীয়স্বজন, বান্ধবী, প্রাক্তন সহকর্মী, লেখক এবং পরিচিত সবার স্নিদ্ধ প্রীতি শুভেচ্ছায় আমি অভিভূত হয়েছি। সবাইকে তাই অন্তরকে থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
চট্টগ্রামে এসে মনে হয়েছে করোনার বিভীষিকা যেন হঠাৎ উধাও হয়েছে। সবাই, উৎফুল্ল মুখে চলাফেরা করছে। কারও মুখে মাস্ক, কারও মুখে মাস্ক নেই। কিন্তু সবাই যেন করোনা পূর্ববর্তী জীবনে ফিরে গিয়েছে। বাই রোডে যখন চট্টগ্রামের পথে রওনা দিয়েছিলাম তখন সারা রাস্তা শোকে দুঃখে ভারাক্রান্ত ছিলাম। এ দু’বছর কত প্রিয়জনকে হারিয়েছি। চট্টগ্রামের মানুষ সব দুঃখ ভুলে জীবনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সজীব, প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে দেখে আমার মন পুলকিত হয়ে উঠেছে। বান্ধবী জাহান আখতার আঙ্গুর নিমন্ত্রণ করলো, সেখানে বান্ধবী ও সহকর্মীদের সাথে দেখা হলো। প্রাক্তন সহকর্মী আনোয়ারা বেগমের আমন্ত্রণে পতেঙ্গা নেভির বীচে চাঁদনি রাতে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করে আমরা কয়েকজন সহকর্মী অনেক মাস পর আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলাম। মহান সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
চট্টগ্রাম মঞ্চের সাহিত্য সম্পাদক অমিত বড়ুয়া আমার কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন, স্মৃতিমূলক গ্রন্থের আলোচনার আয়োজন করলেন (দীর্ঘ দেড় বছর আমার আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন) নিজ উদ্যোগে। এরকম শুভাকাক্সক্ষী বিরল। তাঁর প্রতি অশেষ ধন্যবাদ। অধ্যক্ষ রীতা দত্ত এবং অধ্যাপক বিচিত্রা সেন বইটি এমন চমৎকারভাবে বর্ণনা করলেন মনে হলো বইটি আমি লিখিনি যেন বিখ্যাত কেউ লিখেছেন। তাদের বিশ্লেষণের নিপুণতায় সাধারণ লেখা অসাধারণ হয়ে উঠেছে।
এ রকম একবার চট্টগ্রাম টেলিভিশনে সর্বজন প্রিয় আবৃত্তি শিল্পী আয়েশা হক শিমু আমার একটি কবিতা তাৎক্ষণিকভাবে আবৃত্তি করেছিল। তার আবৃত্তির কুশলতাগুণে আমার কবিতাটি অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছিল। গুণী মানুষের সংস্পর্শে পরশ পাথরের মত সাধারণ লেখাও সোনার মত ঝক্‌মকে হয়ে ওঠে। করোনায় লেখালেখির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু শুভাকাক্সক্ষীর তাগিদে কিছু লিখতে গিয়ে শোকার্ত নির্জীব হৃদয় বাস্তব জীবনের চেতনায় ফিরে এসেছিল। গোফরান উদ্দীন টিটু ‘কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন’ ‘আমার দেশ আমার শহর’ বই দুইটি প্রকাশ করেছেন। বলাকার প্রকাশক কবি শরীফা বুলবুল ‘রিনির মুক্তিযোদ্ধা মামা’ এবং ‘ফাগুন হাওয়ার রঙ’ এ দুটো বই প্রকাশ করেছেন। করোনার মধ্যেও তাঁরা আমার বই প্রকাশ করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। শৈলী আমার বিশাল উপন্যাস ‘রৌদ্র দহন’ প্রকাশ করেছে। সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা রইলো। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় বলতে পারি ‘অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা/ সবুজ ঘাসের দেশ, যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর’ তেমনি অনুভব করেছি অগুনতি শুভাকাক্সক্ষীর মায়া মমতা আমার অন্তরের অশেষ ক্রন্দনের মাঝে যা আমার মনে বেঁচে থাকার সার্থকতা সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেছে।
৬ নভেম্বরে অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি আমার প্রিয় জন্মস্থান হাটহাজারি থানার উত্তর মাদার্শা গ্রামের জমসেদিয়া তরুণ সংঘের ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ অনুষ্ঠানে সম্মাননা লাভ করে। নিজের জন্মস্থান থেকে সম্মান পাওয়ার সুখানুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। গ্রামের মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসা যেন বিশাল সমুদ্রের উর্মিমুখরতা। উত্তর মাদার্শা গ্রামে আমি তরুণ বয়সে যখন চট্টগ্রাম লায়নেস ক্লাবের সভানেত্রী ছিলাম তখন থেকে নানা ধরনের কল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িত হয়েছিলাম। একবার একটি অনুষ্ঠানে সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ প্রধান অতিথি এবং আমি বিশেষ অতিথি হয়েছিলাম। তরুণ বয়সের সে আনন্দ আজও অক্ষয় হয়ে রয়েছে। উত্তর মাদার্শা গ্রামের জমসেদিয়া তরুণ সংঘ তরুণদের জন্য নতুন পথের দিশারী, নতুন চিন্তা চেতনার প্রেরণা। গ্রামের তরুণদের নিয়ে তারা প্রতি বছর গ্রামে শিক্ষাদান ও দারিদ্র দূর করার মত বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করে আসছে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে। কৃতী পুরুষদের সাথে আমাকে সম্মাননা দিয়ে তারা নারীদের উত্তরণের পথ বিকশিত করে দিল। গ্রামের বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের সাথে অংশগ্রহণ করার সাথে সাথে আমি আব্বার স্মৃতিকে স্মরণ করে জমসেদিয়া তরুণ সংঘের কার্যালয় কক্ষে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। সবাই বলে এখন ইন্টারনেটের যুগ। কেউ বই পড়ে না, আসলে কথাটা সত্যি না। যারা প্রকৃত অর্থে নানা ধরনের বই পড়তে আগ্রহী তারা ঠিকই বই ক্রয় করে অথবা সংগ্রহ করে নিয়মিত বই পড়েন। বিশেষ করে আমাদের দেশের নারীরা। তারা ঈদ বা কোন উপলক্ষ্যে একটি শাড়ি অথবা এমনকি কাচের চুড়িও উপহার পায় না। সেক্ষেত্রে বালিকা বা কিশোরী অথবা নারীদের বই উপহার পাওয়া তো স্বপ্নের মত অবাস্তব ঘটনা। আমাদের দেশের সাধারণ পরিবারের নারীরা প্রায় সবাই ‘জি বাংলা’র সিরিয়াল দেখে অভ্যন্ত। সেখানে কি কখনো বই উপহার দিতে দেখেছেন? লাল গোলাপ, ফুলের তোড়া, লাখ টাকার শাড়ি গয়না ইত্যাদি উপহার দেওয়ার দৃশ্য সাধারণ মানুষের মনকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। এদেশের ক’জন প্রেমিক বা স্বামী ভালবাসা দিবস, জন্মদিন বা বিয়ে বার্ষিকীতে লাখ বা কোটি টাকার উপহার দিতে পারে বা দিয়ে থাকে? টেলিভিশনের অবাস্তব চিত্র আজ মানুষের মনকে লোভাতুর করে তুলতে উৎসাহ দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে গ্রামে আমি দেখেছি নারীদের অনেকে বই পেলে খুব খুশি হয়। বিশেষ করে জানতে পেরেছি লাইব্রেরি থেকে নারীরাই বেশি বই নিয়ে পড়েছেন। শুনে খুব আনন্দিত হয়েছি। আমার ভাষণে সেদিন তাই বলেছিলাম সবাই যদি বছরে অন্তত একটি করে বই লাইব্রেরিতে প্রদান করে বিশেষ করে জমসেদিয়া তরুণ সংঘের প্রায় তিনশ সদস্য প্রত্যেকে একটি করে বই লাইব্রেরিতে প্রদান করলে লাইব্রেরি সহজেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। আমার কথা শুনে প্রধান অতিথি জনাব এম এ সালাম, চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ (সভাপতি- চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ), গ্রামবাসীকে লাইব্রেরি সমৃদ্ধ করার জন্য অনেক সুন্দর বাণী ও কবিতার চরণের উদ্ধৃতি দিয়ে উৎসাহিত করলেন। তিনি বললেন, গ্রন্থাগারের গ্রন্থ যুগ যুগ ধরে মানুষের মানসিকতা ও চরিত্র গঠনে সহযোগিতা করে। তিনি উৎফুল্ল চিত্তে আমাকে বললেন আমি যেন তাঁকে একশত মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের লিস্ট দেই তিনি সে একশত বই “মুফিজুল হক স্মৃতি” গ্রন্থাগারে প্রদান করবেন। কেউ প্রধান অতিথি হলে তাঁর কাছে সবাই অনেক চাওয়া পাওয়ার দাবী করেন। আমার পছন্দ না। আমাদের প্রত্যেকের নিজের কিছু করা উচিৎ। আমার আদর্শ হলো “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে”। তারপর দেখা যায় একের সাথে অনেকে এসে যায়। তবু প্রধান অতিথি নিজের থেকে বই দেবেন বলেছেন তাই আমরা সবাই অনুপ্রেরণা ও আনন্দিত হয়েছি। বিশেষ করে তিনি বলেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর দলাদলি ও স্বার্থসন্ধান না করে জমসেদিয়া তরুণ সংঘের সদস্যরা প্রতি দু’বছর পর কার্যপরিষদ বদলে একসাথে কাজ করেছেন, তা বাংলাদেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। সত্যি বলতে কি জমসেদিয়া তরুণ সংঘের মত প্রতি গ্রামে কল্যাণমূলক সংগঠন থাকলে বাংলাদেশের আরও দ্রুত উন্নতি সম্ভব। সদ্যদের কল্যাণে গ্রামে মাদকসেবি, জুয়া খেলা ইত্যাদি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা শিক্ষাক্ষেত্রে এবং গ্রামের মানুষের দু:খে সবসময় পাশে থেকে সহযোগিতা করেন।
গ্রামে যারা জনপ্রতিনিধি আছেন তারা সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে অনেকে গ্রামের জন্য কিছু করতেন পারেন। কিন্তু গ্রামের চিত্র সহজে বদলায় কি ? নিজ গ্রামের প্রতি সবাই যদি মায়া প্রদর্শন করেন তবে তো গ্রামের উন্নতি অবশ্যাম্ভাবী।
ঢাকায় পদ্মাসেতু দেখতে গিয়েছিলাম। দেখে অভিভূত হয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। রাস্তাটি প্রশস্ত ও মসৃণ দেখে আনন্দিত হয়েছি। স্পীড বোটে করে পদ্মা নদীতে ঘুরে বেরিয়েছি। পদ্মা সত্যি প্রমত্তা নদী। যা বিশাল ঢেউ। অনেক সময় মনে হচ্ছিল বোট বুঝি ডুবে যাবে। চট্টগ্রামের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু ধীর গতিতে। কক্সবাজার যাবার রাস্তার আবারও সংস্কার হচ্ছে। কর্ণফুলি ব্রীজের রাস্তার সংস্কার কতবার হলো তার হিসাব নেই। চট্টগ্রামে সারা বছরই বড় বড় রাস্তার সংস্কার চলে। একবার শেষ হয় আবার পরের বছর সংস্কারের কাজ শুরু হয়। আমাদের বাসার আরাকান রোড এর তো বিশ বছর ধরে সংস্কার চলছে। এখানো চলছে। খোলা নর্দমা পৃথিবীর কোনও দেশে দেখেছেন কি? আরাকান রোডের পাশে বিরাট নর্দমা রয়েছে বর্ষাকালে তা ফুলে ফেঁেপ কালো নদীর মত হয়ে যায়। তিলোত্তমা চট্টগ্রামের সৌন্দর্য বহদ্দারহাটের জনস্রোতে (কারণ জ্যামে অনেকক্ষণ আটকে থাকবেন) এবং আরাকান রোডের দুর্গন্ধময় নর্দমার পাশে বসে উপভোগ করতে পারবেন। এ রকম দৃশ্য চট্টগ্রামের মত একটি বিখ্যাত ও সুন্দর শহরের জন্য কতটা কলংকময় তা কি চিন্তা করে দেখার বিষয় নয়?
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে করোনায় ১ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ৬