আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণকারী

নেছার আহমদ | শুক্রবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ


আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের পরিচিতি দেওয়ার প্রয়োজন নেই, বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, ছাত্র, গবেষক, এমনকি বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত জনগণের নিকট অতি পরিচিত, সে বাংলাদেশেই হোক বা পশ্চিমবঙ্গেই হোক। চট্টগ্রামের নিভৃত পল্লীতে এক দরিদ্র সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে উচ্চ শিক্ষা লাভে বঞ্চিত এই লোক জীবনসংগ্রামে জর্জরিত হয়েও নিজ সাধনা, কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য অধ্যবসায়ের দ্বারা আমাদের সংস্কৃতির এমন অমূল্য রত্নরাজি আবিষ্কার ও সংগ্রহ করেন, যার ফলে গোটা দেশ ও জাতি অপূর্ব গৌরবে গৌবরান্বিত। তিনি সাহিত্যবিশারদ নামেই সুপরিচিত।
‘সাহিত্য সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ দেশের বিদ্বৎসমাজ ও সংস্থা যে উপাধি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছিলেন সেই উপাধিতে তিনি আজও একক ও অনন্য হয়ে আছেন, যেমন আছেন বিদ্যাসাগর তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে। সাহিত্যবিশারদ উপাধি আরও অনেকে পেয়েছেন, যেমন বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন অনেকেই, পাপড়ি খসে যাওয়া ফুলের মত তাঁরা অকালে ঝরে গেছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর ও সাহিত্যবিশারদ আজও তাঁরা এককভাবে কর্মক্ষেত্রের ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করেও প্রদত্ত উপাধির মর্যাদা রক্ষা করে চলেছেন’। সাহিত্যবিশারদ সৃজনধর্মী লেখক ছিলেন না, তিনি প্রাচীন সাহিত্যকর্ম আবিষ্কার করেন ও সংগ্রহ করেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের হারিয়ে যাওয়া বাংলা সাহিত্য তিনি বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে মধ্যযুগের এই সাহিত্য ছিল উপেক্ষিত, কিন্তু এই সাহিত্যেই লুকায়িত ছিল বাংলার সংস্কৃতির এক বিশেষ বাহন। সাহিত্যবিশারদ অল্প শিক্ষিত হয়েও এই সাহিত্যের মূল্য অনুধাবন করেন এবং এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। [আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কৃতিত্ব মূল্যায়ন সম্পর্কে কিছু কথা, ড. আবদুুল করিম]
তিনি ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। সাহিত্যবিশারদ যখন সাহিত্য জগতে প্রবেশ করে, তখন কোনো দ্বিতীয় মুসলমান সাহিত্য ক্ষেত্রে তেমন অগ্রসর ছিল না। কিন্তু কলকাতা এবং ঢাকায় অনেক উচ্চশিক্ষিত হিন্দু, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিধারী, সংস্কৃত ও বাংলা পুঁথি সংগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিউজিয়ামের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাচীন পুঁথি সংগৃহীত হতো। সেই সংগ্রহের সিংহভাগ ছিল হিন্দু রচিত। মুসলমান রচিত কাব্য বা পুঁথি যে পাওযা যেতে পারে তা সংগ্রাহকদের জানা ছিল না। সাহিত্যবিশারদ হিন্দু-মুসলিম বিভক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সংগ্রহ না করলে মুসলমানদের রচিত কাব্য সংগৃহীত হতো না এবং বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসের কয়েকটি মূল্যবান অধ্যায় অলিখিত এবং অপ্রকাশিত থেকে যেত।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১০ অক্টোবর ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আশ্বিন ১২৩৩ মঘীসন পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম সূচক্রদণ্ডীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী নুরুদ্দিন এবং মাতার নাম মিশ্রীজান। আবদুল করিম যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁর পিতা মুন্সী নুরুদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স যখন সতের বছর তখন তিনি তাঁর মাতা মিশ্রীজানকেও হারান। পিতামহ মুহাম্মদ নবী ও পিতৃব্য মুন্সী আইন উদ্দিনের স্নেহাশ্রয়ে অনাথ আবদুল করিম লালিত পালিত হন। পিতৃহীন আবদুল করিম যাতে পারিবারিক সম্পত্তি হতে বঞ্চিত না হন সে জন্য পিতামহের ইচ্ছাই ও ব্যবস্থাপনায় পিতৃব্য আইন উদ্দিনের জৈষ্ঠ্যা কন্যা বদিউন্‌ নিসারের সাথে ১৮৮২ সালে তাঁর বিয়ে হয়। এ সময় আবদুল করিমের বয়স ছিল এগারো বছর এবং বদিউন্‌ নিসার বয়স মাত্র ছয়।
পারিবারিক পরিমণ্ডলেই আবদুল করিমের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর তিনি ভর্তি হন সূচক্রদণ্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে। আবদুল করিম পটিয়া স্কুল হতে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে এট্রান্স পাস করেন। কিন্তু আজহার উদ্দিন খাঁনের মতে, আবদুল করিম কুড়ি বছর বয়সে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীর বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। তবে ড. আহমদ শরীফের মতে, ১৮৯৩ সালেই তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন এবং ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। যতদূর জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্ব প্রথম এন্ট্রান্স পাস করা ব্যক্তি ছিলেন। এন্ট্রান্স পাস করে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ. ক্লাসে পড়াশুনা শুরু করেন কিন্তু টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁর চুড়ান্ত পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয় নাই। ফলে এখানেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে।
আধুনিক, আমৃত্যু উদার ও মানবিক বোধের প্রেরণায় তিনি ছিলেন মানবতাবাদী মানুষ। অসামপ্রদায়িক মনের ও মননের অধিকারী এ মহান সাধক জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুল। তিনি মাত্র কয়েকমাস এখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি সীতাকুণ্ড মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে এক বছরের জন্য (১৮৯৫-৯৬) অস্থায়ী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। ১৮৯৬-৯৭ সালে প্রথমে তিনি চট্টগ্রাম সাব জজ আদালতে, পরে পটিয়া মুন্সেফ আদালতে শিক্ষানবীস হিসেবে কাজ করেন। কবি নবীন চন্দ্র সেনের (১৮৪৭-১৯০৯) আগ্রহে ও আনুকুল্যে ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসের কেরানি পদে তিনি নিয়োগ পান। কিন্তু পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পুঁথি সংগ্রহের এক প্রয়াসে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আবদুল করিম চাকরিচ্যুত হন। বেশ কিছুকাল কর্মহীন থাকার পর তিনি আনোয়ারা মধ্য-ইংরেজী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৮৯৯ সাল হতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
১৯০৬ সালে আবদুল করিম শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে চট্টগ্রাম বিভাগের ইন্সপেক্টর অব স্কুল এর অফিসে দ্বিতীয় কেরানির পদে চাকরিতে যোগ দেন। দীর্ঘ ২৮ বছর চাকুরীর পর ১৯৩৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে আবদুল করিমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। সক্রিয় কর্মজীবন হতে অবসর নিয়ে তিনি সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক কর্মকাণ্ডেও অংশ নেন। স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য ও বেঞ্চের প্রেসিডেন্ট, পটিয়া ঋণ সালিশি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘকাল পটিয়া উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি। বিপদে, সম্পদে, শোকে-আনন্দে, সুখে-দুঃখে তিনি ছিলেন এলাকাবাসীর মমত্বশীল অভিভাবক, উপদেশক ও সহায়ক।
পুঁথি সংগ্রহ সংরক্ষণ চর্চার প্রেরণা তিনি পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন। তাঁদের পরিবারে কিছু প্রাচীন পুঁথির সংগ্রহ ছিল। তাঁর পূর্বপুরুষ কাদির রাজা ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ দৌলত কাজীর ‘সতী ময়না লোর চন্দ্রানী কাব্যটি পুত্রের শিক্ষার প্রয়োজনে স্বহস্তে নকল করেছিলেন। সে সূত্র ধরেই তাঁর পুঁথি সংগহের প্রেরণা। তিনি প্রায় ২০০০ পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। যা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রত্ন হিসেবে বিবেচিত।
সাহিত্য জগতে আবদুল করিমের খ্যাতি ছিল অপরিসীম। তিনিই একমাত্র লেখক যাঁর একাধিক প্রবন্ধ একই সময়ে বিভিন্ন উচ্চ মানের সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হত। তিনি নিজে কোনো পত্রিকা প্রকাশ করেননি। কিন্তু তাঁর খ্যাতির কারণে সাময়িক পত্রিকার মান ও গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য একাধিক সাময়িক সাহিত্য পত্রিকা আত্ম প্রকাশ করলে তাকে অবৈতনিক সম্পাদক নিযুক্ত করা হতো।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাঙালির ঐতিহ্য চর্চার এক নিরলস সাধক। তাঁর অনুসন্ধিৎসা ও আগ্রহ ছিলো বহুমুখী ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত। স্বচ্ছ ও গভীর ছিল তাঁর দৃষ্টি। এই জ্ঞানতাপস জীবিতকালেই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ চর্চার প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। তবে মধ্যযুগের ধূসর পাণ্ডুলিপির অভ্যান্তরেই কেবল তাঁর মনোযোগ নিবন্ধ ছিল না। স্বদেশ সমাজ ও সমকাল ও তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। অসামপ্রদায়িক চেতনায় লালিত, উদার মতালম্বী সাহিত্যবিশারদ সারা জীবনই ঐতিহ্য সন্ধান ও জ্ঞানের সাধনায় ছিলেন নিবেদিত। সাহিত্য ও সাংস্কৃতি সাধনা ছিলো তাঁর জীবন চর্চারই নামান্তর। সমাজ ও জীবনে আবদুল করিমের সাহিত্য কীর্তি অক্ষয় হয়ে থাকবে। যা সাহিত্যপ্রেমী ও সাহিত্যের ছাত্রদেরকে নিরন্তর পথ দেখাবে।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রচণ্ড আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন, ‘বাংলার মুসলমানদের পৈতৃক জন্মভূমি যেখানেই হোক না কেন, বাঙলায় পদাপর্ণ করিয়া অবধি তাঁহারা খাঁটি বাঙালিই হইয়া গিয়েছেন। একথা বোধ হয় কোন শত্রুও অস্বীকার করিতে পারে না। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মে বটে, বাংলাদেশের প্রচলিত বাঙালা ভাষা ও তাহাদের মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষার স্থানাধিকার মরিয়া এত যুগযুগান্তর পর্যন্ত নির্বিবাদে চলিয়া আসিতেছে।………’ আবদুল করিম কিশোর বয়সে যাকে বালিকা বধু হিসেবে নিজ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন এবং যার সঙ্গে দীর্ঘ ৭১ বছর ঘর সংসার করেছিলেন সেই প্রিয়তমা জীবন সঙ্গিনী ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ ইন্তেকাল করেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে আবদুল করিম অনেকটা অসহায় ও মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েন। নিঃসঙ্গ সাহিত্যবিশারদ ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রামের নিজ বাড়িতে ৮২ বছর বয়সে লেখনীরত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক স্বনামধন্য লেখক উল্লেখ করেছেন, “লিখতে বসে তাঁর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। মহান সাধকের এই ধরনের মরণই কাম্য। তিনি ‘চট্টগ্রামের অলিখিত কাহিনী’ লিখতে ছিলেন তখন তাঁর এই অলিখিত কাহিনী অলিখিত রয়ে গেল’।
চিত্ত, বিত্ত, জীবন এবং যৌবন এসমস্তই চঞ্চল। কিন্তু কীর্তিমান ব্যক্তি চিরজীবী। র্কীতিমান সাহিত্যবিশারদও তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে আজও জীবিত। [সূত্র : আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কিত ড. আহমদ শরীফ রচিত প্রবন্ধাবলি এবং বাংলা একাডেমি হতে প্রকাশিত ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের জীবন ও কর্ম’ ]।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক-শিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধএমপি নদভীকে নিয়ে কটূক্তি, ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা