অপেক্ষা

শেখ আবদুল মুকিত | শুক্রবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আক্কেল আলী আখন্দ যখন বয়সে যুবক, বাইশ-তেইশ, তখন পর্যন্ত ওর মনে প্রচণ্ড একটা ক্ষোভ ছিল নিজের নামটা নিয়ে। এ কেমন নাম, আক্কেল আলী আখন্দ! এর চেয়ে তো ওর বাবার নামটা প্রায় চার যুগের পুরোনো হয়েও তুলনামূলক ভাবে আধুনিক – আকবর আলী আখন্দ। আকবর আলী আখন্দ,পিতা আক্কেল আলী আখন্দ হলেই তো মানানসই হতো। তা না হয়ে এখন বরঞ্চ হয়েছে এর উল্টো -আক্কেল আলী আখন্দ, পিতা আকবর আলী আখন্দ!
পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই ছিল আক্কেল আলী আখন্দ। স্কুলের শেষ পর্যায়ে এসে একদিন ইংরেজি একটা প্রবাদ কানে আসে আক্কেল আলী আখন্দের, হোয়াট’স ইন দ্য নেম, নামে কি আসে যায়। ব্যস, সেই থেকে নিজের বিদঘুটে নামের মোক্ষম একখানা যুক্তি খুঁজে পায় আক্কেল আলী আখন্দ। হোয়াট’স ইন দ্য নেম – নামে কি আসে যায়। আক্কেল আলী আখন্দ তখন কলেজে পড়ে। একদিন ছুটির দিনে অলস দুপুরে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় একটা ব্যাপার মাথায় আসে ওর। আরে, নিজের নামটা আর সেই সাথে বাবার নামটাতেও তো অনায়াসে আধুনিকতার লেবাস পরানো যায়! ট্রিপল এ, সান অফ ট্রিপল এ। সেই থেকে আক্কেল আলী আখন্দ হয়ে গেল ট্রিপল এ।
ট্রিপল এ’র বয়স হয়েছে। ষাট পেরিয়েছে। ট্রিপল এ বেশ বুঝতে পারে সংসারে তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। এখন সংসারে সে অপাংক্তেয়,কারণ সে অবসরপ্রাপ্ত। আয়-রুজি হ্রাসের সাথে সাথে স্ত্রী- সন্তানদের সাথেও দূরত্ব বেড়েছে। এখন আর ওরা আগের মতো কাছে ঘেঁষে না। ট্রিপল এ একদিন ভাবতে লাগলো, বয়স তো মোটামুটি হয়েছে। আজরাইল আলাইহিস সালাম যে কোনো মুহূর্তে তশরিফ আনতে পারেন। সহায়-সম্পদও তো তেমন কিছু নেই, যা স্ত্রী সন্তানদের জন্য রেখে যেতে পারবে। তার চেয়ে একটা কাজ করলে কেমন হয়, এমন একটা উপদেশ তাদের দিয়ে গেলে কেমন হয়, যা তাদের সারা জীবন কাজে আসবে!
ট্রিপল এ ভালো করেই জানে যে এখন আর উপদেশের কথা বলে স্ত্রী-সন্তান সবাইকে একসাথে করা সম্ভব নয়। তাই ট্রিপল এ একদিন অসুখের বাহানা ধরে। কিন্তু কি আশ্চর্য, তাতেও তো কাজ হয় না। সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। ছাড়া ছাড়া ভাবে দু-একজন আসে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করে চলে যায়। অতঃপর ট্রিপল এ তার শেষ অস্ত্র ব্যবহার করে। ট্রিপল এ নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে কাজ হয়। একদিন ট্রিপল এ স্ত্রী-সন্তানদের একসাথে কাছে পায়।
ট্রিপল এ বলতে শুরু করে, দেখো, এ যাত্রায় যদিও আমি রক্ষা পাই, তারপরও তো আমার বয়স হয়েছে। কতদিন আছি, জানি না। তোমাদের সবাইকে আজকে কাছে পেয়েছি। তোমাদের আমি একটা গল্প শোনাতে চাই। সম্ভব হলে এ থেকে তোমরা কিছু শিক্ষা নিও।
এক সময়ে এই অঞ্চলে পাশাপাশি দুটো রাজ্য ছিল। এক রাজ্যের রাজা ছিলেন দুর্বল শাহ আর অপরটির রাজা ছিলেন সবল শাহ। ওই দুই রাজার মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। রাজা দুর্বল শাহ রাজ্য পরিচালনায় দুর্বল ছিলেন। তাঁর রাজ্যে প্রায় বিশৃঙ্খলা লেগে থাকতো। অন্যান্য রাজারা সুযোগ বুঝে তার রাজ্যে আক্রমণ করে বসতো। অন্যদিকে রাজা সবল শাহ ছিলেন বুদ্ধিমান, রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ। রাজা সবল শাহকে প্রায়ই বন্ধু দুর্বল শাহর সাহায্যে এগিয়ে আসতে হতো।
একদিন রাজা দুর্বল শাহ হঠাৎ করে বিপর্যস্ত বদনে, মলিন বেশে রাজা সবল শাহর দরবারে হাজির হলেন। জানালেন রাতের অন্ধকারে প্রতিবেশি এক রাজা বিপুল সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আক্রমণ করে তাঁর রাজ্য দখল করে নিয়েছে। তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদ এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে কোনো রকমে জান বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছেন। রাজা সবল শাহ রাজা দুর্বল শাহর কাছে জানতে চাইলেন,বেশ, এখন তুমি বলো, তুমি আমার কাছে কি চাও? জবাবে রাজা দুর্বল শাহ বললেন, আমি চাই তুমি তোমার সৈন্য-সামন্ত দিয়ে দুশমনদের পরাস্ত করে আমার রাজ্যটি আমাকে উদ্ধার করে দাও। এই কথা শেষ না হতেই রাজা সবল শাহ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, এই মুহূর্তে রাজা দুর্বল শাহকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হোক। রাজা দুর্বল শাহ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না, ভাবলেন তিনি ভুল শুনছেন। কিন্তু তিনি অবাক দেখলেন কিছু সৈন্য এসে সত্যিই তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে গেল।
দিন যায়, মাস যায়, রাজা দুর্বল শাহর কারাগারেই দিন কাটে। এর মাঝে বার কয়েক তিনি ফরিয়াদ জানিয়েছেন রাজা সবল শাহ যেন দয়া করে কিছু সময়ের জন্য তাঁকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন। এক সময়ে রাজা সবল শাহ রাজি হলেন। হুকুম দিলেন রাজা দুর্বল শাহকে দরবারে হাজির করতে। রাজা দুর্বল শাহ দরবারে হাজির হলে তিনি বললেন, বলো, কি তোমার ফরিয়াদ। রাজা দুর্বল শাহ জানালেন, কারাগারে যে মানের খাবার আমাকে দেয়া হচ্ছে, তাতে আমি সন্তুষ্ট নই। এই কথা শুনেই রাজা হুকুম দিলেন, এখন থেকে ঠিক এক সপ্তাহ পর রাজার ভাণ্ডার থেকে আর কোনো খাবার রাজা দুর্বল শাহকে দেয়া যাবে না। কোনো কাজ করে তার আয় থেকেই তিনি নিজের খাবার কিনে খাবেন। অবিশ্বাস ও বিস্ময়ে দু’চোখ কপালে উঠে গেল রাজা দুর্বল শাহর। এ কি শুনছেন তিনি বন্ধুর কাছ থেকে, মানুষ এমন পাষণ্ড হতে পারে!
কারাগার কর্তৃপক্ষ ভেবে আকুল হলেন, রাজা দুর্বল শাহকে কি এমন কাজ দেয়া যায়,যা তিনি করতে পারবেন। উজির সাহেব পরামর্শ দিলেন রাজা দুর্বল শাহকে টুপি সেলাইয়ের কাজ দিতে। রাজা দুর্বল শাহকে কয়েকদিন টুপি সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। একটু রপ্ত হলে তাঁকে কাপড়,সুই,সুতা সরবরাহ করা হলো। রাজা দুর্বল শাহ কোনো প্রকারে ফি দীন ৫/৬টা টুপি সেলাই করেন। তা দিয়েই তাঁকে দিন গুজরান করতে হয়। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়।
একদিন রাজা সবল শাহ লক্ষ্য করেন কারাগারের বাইরে মানুষের লম্বা কাতার। রাজা সবল শাহ উজিরকে তলব করে এর কারণ জানতে চাইলেন। উজির সাহেব জবাব দিলেন, হুজুর, বেশ কিছুদিন ধরেই তো এই দৃশ্য নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। প্রজারা সারা রাত ধরে হুমড়ি খেয়ে কাতারে দাঁড়াচ্ছে রাজা দুর্বল শাহর হাতে তৈরি টুপি কিনতে। রাজা সবল শাহ আদেশ দিলেন রাজা দুর্বল শাহকে দরবারে হাজির করতে। রাজা দুর্বল শাহ দরবারে হাজির হলে তাঁকে সসম্মানে পাশে বসিয়ে বললেন, তুমি আমাকে বিস্তারিত ভাবে জানাও, তোমার রাজ্য উদ্ধার করতে কি রকম লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন হবে। আমি উজিরকে এখনই হুকুম দিচ্ছি, সে যেন সকল প্রস্তুতি নিয়ে অবিলম্বে তোমার রাজ্য অভিমুখে রওনা দেয়। রাজা দুর্বল শাহ হতবিহবল হয়ে চেয়ে থাকেন রাজা সবল শাহর মুখের দিকে। অবিশ্বাসে তাঁর চোখজোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে যেন। বিস্ময়ের ঘোর তখনই কাটে, যখন রাজা সবল শাহ উজির সাহেবকে দরবারে তলব করে এই ব্যাপারে অবিলম্বে হুকুম তামিল করার আদেশ দিলেন। রাজা দুর্বল শাহ এবার সাহস করে প্রশ্ন করলেন, এই জিনিসটাই তো তোমার কাছে আগে আমি চেয়েছিলাম, তখন তুমি তা না করে আমাকে এই অমানবিক কষ্টটা কেন দিলে, বন্ধু? রাজা সবল শাহ বললেন, আমি তোমার রাজ্যের দিকে আগে থেকেই নজর রাখছিলাম। তোমার সময়টাও খুব খারাপ যাচ্ছিল। একটার পর একটা বিপদ তোমার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। সেই বিপদসমূহ কাটিয়ে ওঠার মতো দক্ষতা আর পারদর্শিতাও তোমার ছিল না। এই কয়েক মাসে তুমি শিক্ষা পেয়ে গেছো বিপদ এবং কঠিন সময়কে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয়। আর তোমার টুপি বিক্রির বহর দেখে বুঝে গেলাম খারাপ সময় কেটে গিয়ে তোমার ভালো সময় শুরু হয়েছে। তাই আমি এখন এই সিদ্ধান্ত নিলাম।
ট্রিপল এ থামলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তোমাদের প্রতি আমার একটা উপদেশ থাকবে, জীবনে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থতিতে, বিপদ-আপদে কখনও হাল ছেড়ো না। মনে রেখো, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে একদিন ঠিকই তোমাদের টুপি বিক্রি শুরু হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে
পরবর্তী নিবন্ধদু’টি কবিতা